20/11/2023
https://muslimbangla.com/article/507
তিনটি বড় গুনাহ- বদযবানী, বদনেগাহী, বদগুমানী
লেখকঃ আল্লামা কারী আমীর হাসান রহ.
মুরাদাবাদ। একটি প্রসিদ্ধ শহর। ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা। এ শহরেই অবস্থিত প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসা। মাদরাসায়ে শাহী। গোটা মাদরাসা জুড়ে সেদিন ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। থানবী বাগানের সর্বশেষ ফুল হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব রহ.। তারই দীর্ঘ ষাট বছরের অধিক সোহবতপ্রাপ্ত দীনী রাহবার ও হযরত শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এর প্রথম সারির খলীফা হযরত মাওলানা কারী আমীর হাসান রহ.। তিনি জামি'আয় আগমন করেছেন। সে সুবাদে পুরো জামি'আ জুড়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে চলছে। মসজিদ প্রাঙ্গনে আসাতিযায়ে কেরাম ও তলাবায়ে ইযামের একটা বড় মজমা তার মুখনিঃসৃত কিছু নসীহত শোনার জন্য সমবেত হয়েছে। পিনপতন নীরবতা। হযরত রহ. হামদ ও সালাতের পর সেদিন যা বলেছিলেন তার সারসংক্ষেপ এই-
তিনটি বড় বড় গুনাহ এমন রয়েছে, যদি আল্লাহর কোন বান্দা সতর্ক হয়ে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারে তাহলে তার জন্য অন্যান্য সকল গুনাহ হতে বেঁচে থাকা সহজ হবে। সে আল্লাহ তা'আলার ওলী ও নৈকট্যশীল হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে। গুনাহ তিনটি এই- ১. বদযবানী অর্থাৎ কুকথা।২.বদনেগাহী অর্থাৎ কুদৃষ্টি ।৩.বদগুমানী অর্থাৎ কুধারণা। এরপর হযরত প্রতিটি গুনাহের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেন।
বদযবানী
মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাঝে যবান তথা জিহ্বার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। ছোট এ অঙ্গটি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয় তাহলে তা মহাসম্মান ও সুমহান মর্যাদা হাসিলের মাধ্যম ও উসিলা হয়। পক্ষান্তরে যবান তথা জিহ্বা যদি নির্লজ্জ হয় ও খোদাভীতির পরোয়া না করে নিষিদ্ধ কথাবার্তা বলে বেড়ায় তাহলে তা মানুষের লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও বঞ্চনার কারণ হয়।হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إذا أصبح ابن آدم فإن الأعضاء كلها تكفر اللسان فتقول اتق الله فينا فإنما نحن بك فإن استقمت استقمنا وإن اعوججت اعوججنا
অর্থ : মানুষ যখন ঘুম থেকে ওঠে, অন্যান্য সকল অঙ্গ জিহ্বাকে লক্ষ্য করে বিনয়াবনত হয়ে বলে, আল্লাহকে ভয় করো। কারণ আমরা তোমার সঙ্গী। তুমি সঠিক পথে চললে আমরাও সঠিক পথে চলব। আর তুমি বাঁকা পথে চললে আমরাও বাঁকা পথে চলব। (সুনানে তিরমিযী ২/৬৬)এ হাদীস দ্বারা জানা গেল, মানব জীবনে জিহ্বার গুরুত্ব অপরিসীম। এর সহীহ ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ জরুরী। আর এজন্যই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোর তাকীদ দিয়ে জিহ্বা হেফাযতের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। ইরশাদ করেছেন,'যে ব্যক্তি (ভুল বা অন্যায় কথা না বলে) চুপ থাকল সে নিরাপদ থাকল।' (সুনানে বাইহাকী; হা.নং ৪৯৮৩) ‘জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখো। তোমার ঘরই যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয় (অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে না) এবং নিজের গুনাহের কারণে ক্রন্দন করো।' (সুনানে তিরমিযী ২/৬৬) এ রকম বহু হাদীস দ্বারা একথা প্রতীয়মান হয় যে, জিহ্বার ব্যবহারে প্রতিটি মানুষকে খুব সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। নতুবা সামান্য অসতর্কতায় বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতে পারে।জিহ্বার মাধ্যমে যেসব গুনাহ প্রকাশ পায় সেগুলোর বিবরণ একত্রে লিপিবদ্ধ করা কঠিন। তা সত্ত্বেও ইমাম গাযালী রহ. এর ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন কিতাবের আলোকে কিছু উল্লেখ করা হল-১. অপ্রয়োজনে কথা বলা।২. প্রয়োজনাতিরিক্ত কথা বলা।৩. হারাম জিনিসের পর্যালোচনা করা। যেমন চলচ্চিত্র কাহিনী, নাজায়েয খেলাধুলা ইত্যাদি। ৪. অশ্লীল কথাবার্তা বলা।৫. উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা।৬. অন্যকে অভিশাপ দেয়া।৭. অবৈধ হাসি-ঠাট্টা করা।৮. গান ও অশ্লীল কবিতা আবৃত্তি করা। ৯. অন্যকে বিদ্রুপ করা।১০. অন্যের গোপন বিষয় প্রকাশ করা। ১১. মিথ্যা ওয়াদা করা।১২. পরনিন্দা করা। ১৩. দু'মুখো কথা বলা ।১৪. অযোগ্য ব্যক্তির প্রশংসা করা ইত্যাদি।তবে জিহ্বার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ভয়াবহ ও ব্যাপক গুনাহ আছে যার কিছু এই- মিথ্যা জিহ্বার দ্বারা সংঘটিত গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ও নির্লজ্জ গুনাহ হল মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। পবিত্র কুরআনে মিথ্যাবাদীকে অভিশাপ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
অর্থ : অতঃপর আমরা মিথ্যাবাদীকে আল্লাহর লা'নত দিই। (সূরা আলে ইমরান- ৬১)
إذا كذب العبد تباعد عنه الملك ميلا من نتن ما جاء به؟ অর্থ : যখন বান্দা মিথ্যা কথা বলে তখন মিথ্যা কথার দুর্গন্ধে রহমতের ফেরেশতা তার থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়। (সুনানে তিরমিযী ২/১৮)এ হাদীস থেকে বোঝা যায় মিথ্যা কত জঘন্য অপরাধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদীসে ইরশাদ করেন,
ويل للذي يحدث فيكذب ليضحك به القوم ويل له ويل له
অর্থ : যে ব্যক্তি মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে সে ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক। (আবূ দাউদ শরীফ; হা. নং ৪৯৯২)আজকাল মানুষ অন্যকে হাসানোর জন্য নতুন নতুন কৌতুক তৈরি করে। শুধু মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। উল্লিখিত হাদীসের সতর্কবাণী তাদের জানা থাকা উচিত এবং এ ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। আরেক হাদীসে আছে,
كبرت خيانة أن تحدث أخاك حديثا هو لك مصدق وأنت به كاذب
অর্থ : এটি খুব বড় খেয়ানত যে, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে তুমি এমন কথা বলবে, যে বিষয়ে সে তোমাকে সত্যবাদী মনে করবে অথচ তুমি মিথ্যাবাদী। (সুনানে আবূ দাউদ; হা. নং ৪৯৭৩) আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে হেফাযত করুন।
সত্যের মাঝেই মুক্তি
আল্লাহ তা'আলার নৈকট্যশীল হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হল, প্রত্যেক কাজে সততা অবলম্বন করা ও মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা। এ গুণের উসিলায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে লজ্জা করার অনুপ্রেরণা জাগ্রত হয় এবং সৎ কাজের তাওফীক পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে মিথ্যা কথা বললে চরম ক্ষতি ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়। মিথ্যার মাধ্যমে হয়ত সাময়িক কোন ফায়দা হয়; কিন্তু পরিণাম বিবেচনায় তা মুক্তির মাধ্যম হতে পারে না। অন্যদিকে অনেক সময় সত্য বলার কারণে সাময়িক ক্ষতি অনুভূত হলেও পরিণাম খুবই কল্যাণকর ও উপকারী হয়ে থাকে।হযরত উমর ফারূক রাযি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণী বর্ণনা করেন যে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত হাসি-তামাশায়ও মিথ্যা ছেড়ে না দেয় এবং ঝগড়া-বিবাদ ত্যাগ না করে; যদিও সে ন্যায়ের পথেই থাকুক না কেন। (মুসনাদে আহমাদ; হা. নং ৮৬৩০)
ব্যবসায়ী ভাইয়েরা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন
আজকাল ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মন খুলে মিথ্যা কথা বলা হয় এবং এতে কোনরূপ গুনাহ হওয়ার অনুভূতি থাকে না। ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, পণ্য বিক্রি হতে হবে। এতে মিথ্যা বলার দরকার হলে তা-ও বলতে হবে। গ্রাহককে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। আর সামান্য লাভের আশায় নিজের আখেরাতকে ধ্বংস করে ফেলে। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إن التجار يبعثون يوم القيامة فجارا إلا من اتقى وبر وصدق
অর্থ: মুত্তাকী, সৎ ও সত্যবাদী ব্যবসায়ী ব্যতীত অধিকাংশ ব্যবসায়ীকে কিয়ামতের দিন গুনাহগার অবস্থায় উঠানো হবে। (আল-মুসতাদরাক লিলহাকেম; হা.নং ২১৪৪)
আমাদের অভ্যাস
১. বর্তমানে সাধারণত দোকানদার নিজের পণ্য বিক্রির জন্য নিম্নমানের পণ্যকে উত্তম বলে। ২. মূল্যের ক্ষেত্রে বেধড়ক মিথ্যা বলে। এভাবে বলে যে, এ দামে তো আমি কিনতেই পারিনি; যাতে গ্রাহক প্রভাবিত হয়ে অধিক মূল্যে ক্রয় করে। ৩. গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট কোন কোম্পানীর পণ্য চায় আর তা দোকানীর কাছে না থাকে তাহলে সে একথা বলে না যে, আমার নিকট এই কোম্পানীর পণ্য নেই আপনি অন্য দোকান থেকে সংগ্রহ করে নিন। বরং নিজের পণ্য চালিয়ে দেয়ার জন্য একথা বলে গ্রাহককে ধোঁকা দেয় যে, আপনি যে কোম্পানীর পণ্য চাচ্ছেন তা এখন বাজারে পাওয়া যায় না; অন্য কোম্পানীরটা নিন।৪. পুরাতন পণ্যের গায়ে নতুন লেভেল বা স্টিকার লাগিয়ে দেয়। ৫. পণ্যের প্রশংসায় আসমান-যমীন এক করে ফেলে।মোটকথা, এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা যাতে গ্রাহক বা ক্রেতা পণ্য ক্রয়ে বাধ্য হয় এবং ব্যবসায়ী এতেই নিজেকে সফল মনে করে। এটা দীনের প্রতি অনাগ্রহ, অনাসক্ত ও লা-পরওয়া হওয়ার প্রমাণ। মিথ্যা সর্বদাই মিথ্যা। মিথ্যা যে সময়ই বলা হোক, যে অবস্থায়ই বলা হোক গুনাহ হবেই। কাজেই ব্যবসায়ী ভাইদের উচিত নিজেদের জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ করা। যদি তারা এক আল্লাহর উপর ভরসা করে সততা ও দীনদারীর সাথে রোযগার করে তাহলে দুনিয়াতেও আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বে-হিসাব বরকত দান করবেন এবং আখেরাতেও তাদের হাশর করাবেন আম্বিয়া, সিদ্দীকীন, শুহাদা ও নেককার বান্দাদের সাথে।
গীবতও এক ধরনের বেহায়াপনা
জিহ্বার সাহায্যে যেসব গুনাহ প্রকাশিত হয় এবং যে গুনাহর সাহায্যে স্পষ্টত আল্লাহর সঙ্গে নির্লজ্জতার প্রমাণ পাওয়া যায় তেমন একটি মারাত্মক গুনাহের নাম হল গীবত। গীত নামক ব্যাধি আজকাল চা-স্টল থেকে শুরু করে দস্তারবন্দীর মোবারক মাহফিল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আজকাল গীবত ব্যতীত মজলিস জমে ওঠে না। আলোচনা চটকদার করার জন্য সাধারণত গীবতের আশ্রয় নেয়া হয়। এ ব্যাধিটি এত ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, তা গুনাহ ও অন্যায় হওয়ার অনুভূতিও অন্তর থেকে বের হয়ে গেছে। সমাজের এই অধঃপতিত অবস্থা শুধু হতাশার নয়; বরং রীতিমত ভয়াবহ। গীবত থেকে বেঁচে থাকা এবং তা থেকে বিরত থাকার অনুপ্রেরণা তখনই জাগ্রত হতে পারে যখন উল্লিখিত হাদীস ( فليحفظ الرأس وما وعى) এর বিষয়বস্তু সর্বদা মাথায় থাকবে এবং সর্বদা আল্লাহ তা'আলাকে লজ্জা করার প্রচেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি এ ভয়াবহ ও জঘন্য আত্মিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সর্বদা মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে বিনয়াবনত হয়ে দু'আ করতে হবে। বর্তমানে আল্লাহ তা'আলার বিশেষ রহমত ব্যতীত এ ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
উলামায়ে কেরাম সম্পর্কে গীবত করা
উলামায়ে কেরাম তথা দীনের কাণ্ডারী ব্যক্তিবর্গের গীবত করা জনসাধারণের গীবত করার তুলনায় জঘন্য ক্ষতিকর। এর কারণ হল, উলামায়ে কেরাম আল্লাহ তা'আলার নিকট অতি মর্যাদাবান। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
من عادى لي وليا فقد آذنته بالحرب
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করি। (সহীহ বুখারী; হা. নং ৬১৩৭)উলামায়ে কেরামের গীবত করলে মানুষ চরম শাস্তির সম্মুখীন হয়। যার শাস্তি আল্লাহ তা'আলা শুধু আখেরাতে নয়; বরং দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। যারা এ ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেয় তারা কুদরতীভাবে অপদস্থ হয়। কাজেই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজেকে আল্লাহর তা'আলার আযাব থেকে বাঁচানো।ইমাম গাযালী রহ. ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন গ্রন্থে লিখেছেন, কারো গীবত বা নিন্দা শুনলে ছয়টি কাজ করবে- ১. চোগলখোরের কথা কখনো বিশ্বাস করবে না। কারণ সে শরীয়তের দৃষ্টিতে ফাসেক।২. চোগলখোরকে তার হীন কর্মের জন্য সতর্ক করবে এবং তাকে লজ্জা দিবে। ৩. চোগলখোরের কাজকে মন থেকে ঘৃণা করবে । ৪. যার চোগলখোরী করা হয়েছে তার পক্ষ থেকে মন্দ ধারণা যেন না হয়। ৫. চোগলখোরের কথার ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণে যাবে না এবং তার সত্যতা যাচাই করবে না।৬. চোগলখোরের এ কাজকে অন্যত্র বর্ণনা করবে না। অন্যথায় নিজেই চোগলখোর হয়ে যাবে।
গালি-গালাজ এবং অশ্লীল কথাবার্তা
জিহ্বা থেকে প্রকাশ পায় এমন জঘন্য গুনাহের মধ্যে অশীল কথাবার্তাও অন্তর্ভুক্ত। অশ্লীল কথাবার্তা কোন মুমিন ব্যক্তির মুখে মানায় না। জিহ্বার সাহায্যে যারা অপরকে কষ্ট দেয় কুরআনে কারীমে তাদেরকে কঠিন গুনাহে লিপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا
অর্থ: যারা মুমিন নর-নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয় তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে। (সূরা আহযাব- ৫৮)
বদনেগাহী
শরীয়তের দৃষ্টিতে মাথা হেফাযতের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হল দৃষ্টিকে গুনাহ থেকে হেফাযত করা। চোখের একটি অসতর্কতা মানুষকে বড় বড় গুনাহে লিপ্ত করে ফেলে। বর্তমান পৃথিবীতে বেহায়াপনা-অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার যে ছড়াছড়ি এর সবচে বড় কারণ হল কুদৃষ্টি। শয়তান মানুষের হাতে কুদৃষ্টির অস্ত্র তুলে দিয়ে ফুরফুরে মেজাযে রয়েছে। এখন মানুষের মাধ্যমে বড় বড় কুফরীর কাজ করাতেও তার বেশি কষ্ট করতে হয় না। কুদৃষ্টিই শয়তানের মনোবাসনাকে পরিপূর্ণরূপে আঞ্জাম দেয়ার কাজ দেয়। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে সহজেই অনুমেয় যে, বর্তমান পৃথিবীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সত্তর শতাংশ এ কারণে সংঘটিত হয় যে, এখন সন্তানদেরকে যথারীতি সিনেমা হল, টিভি প্রোগ্রাম ও ভিডিও সিডির মাধ্যমে লালন-পালন করা হয়। এসব চিত্তাকর্ষক বস্তুর মাধ্যমে শয়তান মানুষের দিল-দেমাগ থেকে লজ্জার বীজ মূলোৎপাটিত করেছে। মর্যাদাবান লোকদের মান-মর্যাদা ধুলোয় ধুসরিত করেছে। দীনদার লোকদের সম্ভ্রম কালিমাযুক্ত করেছে। এ কুদৃষ্টির কারণে তাকওয়া পরহেযগারীর সুউচ্চ মিনারে ফাটল ধরে এবং একটু অসতর্কতার কারণে সারা জীবনের নেক কাজগুলো তুষানলে ভস্ম হয়ে যায়। ইসলাম কুদৃষ্টি নামক জঘন্যতম গুনাহের অশুভ পরিণাম ও ভয়াবহতাকে অনুভব করে কুদৃষ্টির সকল পথকে বন্ধ করার জোর নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফে দীপ্তমান নির্দেশনা এ বিষয়ে আমাদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ
অর্থ : হে নবী! মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। (সূরা নূর- ৩০) এমন নির্দেশ মুসলমান নারীদেরকে দেয়া হয়েছে, 'তারা যেন নিজেদের ভূষণ অন্যদের কাছে প্রকাশ না করে'। এছাড়া সূরা আহযাবের আয়াতসমূহে পর্দার যে বিধান দেয়া হয়েছে তা-ও কুদৃষ্টির পথ বন্ধের ভূমিকা পালন করে। ইসলাম এ সকল বিধানকে ওয়াজিবের স্তর দান করার মাধ্যমে দীন ইসলামকে একটি সমৃদ্ধশীল ও সত্যিকারার্থে আমলযোগ্য মাযহাবরূপে প্রকাশ করেছে। ইসলাম সকল অপরাধ কর্মকাণ্ডের মূলোৎপাটনে বদ্ধপরিকর। তাই এর ব্যবস্থাপনাও ইসলাম প্রস্তুত করে রেখেছে। বর্তমান পৃথিবীর খ্যাতনামা সভ্য সুশীল সমাজের মত নয়, যারা অশ্লীলতা রোধে কনফারেন্স, র্যালি ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ডুবে থাকে। কুরআন ও হাদীস অশ্লীলতার মূলভিত্তি তথা অসতর্ক দৃষ্টিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা দেয়। এটা এমন এক শিক্ষা, যদি শুধুমাত্র দৃষ্টিকেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে পৃথিবী থেকে সকল নির্লজ্জতার অপসারণ ঘটবে। এ কারণে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুদৃষ্টিকে শয়তানের বিষাক্ত তীর সাব্যস্ত করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন,
النظرة سهم مسموم من سهام الشيطان فمن تركها مخافتي أعقبته عليها إيمانا يجد طعمه في قلبه
অর্থ : কুদৃষ্টি শয়তানের একটি বিষাক্ত তীর। যে আমার ভয়ে তা বর্জন করবে আমি এর বিনিময়ে তাকে এমন ঈমান দান করব, যার স্বাদ সে অন্তরে অনুভব করবে। (আত-তারগীব ৩/২৩)
বদগুমানী বা কুধারণা
আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'হে মুমিন সকল! তোমরা অনেক রকম ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ।' (সুরা হুজুরাত- ১২ )আয়াতে কারীমার মধ্যে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের পারস্পরিক হক ও সামাজিক রীতি-নীতির ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি তার বান্দাদেরকে তিনটি বিষয়ে সতর্ক করেছেন যা সম্পূর্ণ হারাম। প্রথমতঃ ظن তথা ধারণা সম্পর্কে বলেছেন যে, অনেক রকম ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ হিসেবে বলেছেন, কতক ধারণা পাপ। সুতরাং আয়াত থেকে বোঝা যায়, সব ধারণাই পাপ নয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, কারো প্রতি সুধারণা রাখা সওয়াবের কাজ। অতএব কারো প্রতি কুধারণা রাখা হারাম ও নিষিদ্ধ হবে। আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। যে সকল মুসলমান বাহ্যিক অবস্থার দিক দিয়ে সৎকর্মপরায়ণ দৃষ্টিগোচর হয় তাদের ব্যাপারে প্রমাণ ছাড়া কুধারণা পোষণ করা হারাম। হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. এর রেওয়ায়াতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إياكم والظن فإن الظن أكذب الحديث
অর্থ : তোমরা কুধারণা হতে বেঁচে থাকো। কেননা বদগুমানী তথা কুধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। (সহীহ বুখারী; হা. নং ৪৮৪৯, আল-আদাবুল মুফরাদ, হা. ১২৮৭, সুনানে আবূ দাউদ; হা. নং ৪৭২১, মুসনাদে আহমাদ ৩/১০২)এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন প্রমাণ ব্যতিরেকে কারো প্রতি কুধারণা পোষণ করা কত বড় জঘন্যতম অপরাধ। অথচ সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন প্রত্যেক মুসলমানের প্রতি সুধারণা রাখে। যেমন তিনি বলেন,
ظنوا بالمؤمنين خيرا
অর্থ: তোমরা মুমিনদের ব্যাপারে সুধারণা রাখো। (তাফসীরে কাবীর ১৪/১৩৪) উলামায়ে কেরাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, যদি কারো সম্পর্কে কুধারণার পক্ষে নিরানব্বইটি প্রমাণ থাকে, আর একটিমাত্র পথ থাকে সুধারণা পোষণের পক্ষে, তবে তুমি সুধারণা পোষণের রাস্তা অবলম্বন করো। এটাই তোমার জন্য নিরাপদ।
বদগুমানকারী দরবারে ইলাহীর আসামী
কুধারণার ফলে কিয়ামতের দিন স্বয়ং আল্লাহ পাক কুধারণাকারীর বিরুদ্ধে মুকাদ্দামা দায়ের করবেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করবেন, “তুমি যে আমার এ বান্দার প্রতি কুধারণা করেছিলে, বলো, সে ধারণার পক্ষে তোমার কাছে কি কি দলীল আছে?'কত বড় চিন্তার কথা! আল্লাহর মুখোমুখি হওয়া! অথচ কারো প্রতি সুধারণা করলে বিনা দলীলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন। সুধারণার জন্য দলীল-প্রমাণ ছাড়াই সওয়াবের অধিকারী হবে। কেননা সুধারণা রাখা প্রিয় নবীজীর হুকুম।আর যে ব্যক্তি প্রিয় নবীজীর হুকুম পালন করবে নিঃসন্দেহে সে পুরস্কার ও কুধারণা করে নিজেকে নিজে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা'আলার আদালতের আসামী করা এবং কঠিন বিপদের সম্মুখীন করা বড়ই নির্বুদ্ধিতা ও আহাম্মকী। (হযরত হেসে বলেন,) ‘কত বড় আহাম্মক ও বেওকুফ ঐ ব্যক্তি, যে বিনা পরিশ্রমে সওয়াব অর্জনের পরিবর্তে নিজেই নিজের উপর আল্লাহ তা'আলার দরবারে মোকাদ্দমার ব্যবস্থা করছে।' অতএব হে ঈমানদারগণ! অন্যের প্রতি সুধারণা পোষণ করে বিনা পরিশ্রমে সওয়াব অর্জন করো এবং কুধারণা করে নিজেকে প্রমাণাদী পেশের মোকাদ্দমায় ফাঁসিয়ে দিও না।
বদগুমানী বা কুধারণা হয় কেন?
কুধারণা আসলে এক প্রকার ওয়াসওয়াসা। ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা খুবই মারাত্মক ব্যাধি। যখনই কারো প্রতি কুধারণার ওয়াসওয়াসা এসে যায় তার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে আপন নফসকে ধিক্কার দেয়া উচিত। যদি উক্ত কুধারণার ওয়াসওয়াসাকে দেমাগে বসে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে ক্রমে তা বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, পেরেশানীতে দুনিয়াবী জীবন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে এবং দুনিয়া সঙ্কীর্ণ মনে হয়। কিন্তু যখনই উক্ত কুধারণার মূল রহস্য ফাঁস হয়ে যায় অর্থাৎ যখনই কুধারণাকারী কোন বাস্তব দলীলের ভিত্তিতে জানতে সক্ষম হয় যে, আমার উক্ত ধারণার কোন ভিত্তি নেই, আমি যা ধারণা করেছিলাম বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত, তখন কুধারণাকারীর আফসোসের পর আফসোস ছাড়া আর কিছুই থাকে না। নিজের নফসকে তখন ধিক্কার দিতে থাকে যে, কেন অমুকের নির্দোষ চরিত্রের প্রতি কুধারণা করে এত দীর্ঘ সময় কষ্ট-দুঃখ ও পেরেশানীতে ব্যয় করে জীবনের একটা মূল্যবান সময়কে রেখেছিলাম? এজন্য গুনাহে ডুবিয়ে রেখেছিলাম? যখনই কারো প্রতি কোন প্রকার বাস্তব দলীল ব্যতীত কুধারণার ওয়াসওয়াসা এসে উকি দেয় তখনই সেটাকে দিল থেকে একেবারে দূর করে দেয়া জরুরী। সম্ভব হলে যে কোন খারাপ ধারণা মনে আসার সাথে সাথে তার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা করে নেয়া উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে উক্ত বড় বড় তিনটি গুনাহ থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন ও তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন।
অনুবাদ: মুফতী মুহাম্মাদ আলী কাসেমী মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামি'আ ইসলামিয়া, লালমাটিয়া, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা।
- আল্লামা কারী আমীর হাসান রহ.