01/11/2024
ব্যাংক থেকে লোন একবার নিলে সেটা আর শোধ হতে চায়না। কিস্তি দিতেই থাকি, দিতেই থাকি, দিতেই থাকি... লোন আর কমেনা- এমন অভিযোগ করেন অনেকেই।
অনেকেই বোঝেন না- লোন একাউন্ট কীভাবে টাকা কাটে, কীভাবে সুদ হিসাব করে।
আসুন, দেখি, ব্যাংকের লোন শোধ হয় কীভাবে...।
আমরা পারসোনাল লোন সম্পর্কে জেনেছি। আসুন, একটা পারসোনাল লোনের উদাহরণ দিয়েই আমরা শিখে ফেলি, কীভাবে লোন শোধ হয়।
ধরি, আপনি আজকে একটা পারসোনাল লোন নিয়েছেন বাংলাদেশের কোনো একটা ব্যাংক থেকে।
লোনের পরিমাণ ৩০০,০০০/-
লোনের মেয়াদ ৫ বছর
সুদের হার ১৫%
লোন পরিশোধ করার জন্য আপনাকে ৬০ টা কিস্তি দিতে হবে।
আপনার মাসিক কিস্তি হবে ৭,১৩৬.৯৮ টাকা।
৫ বছরে আপনি মোট পরিশোধ করবেন ৪২৮,২১৮.৭৪ টাকা। মোট সুদ ব্যয় ১২৮,২১৮.৭৪ টাকা।
আমরা এখন যে পদ্ধতিতে হিসাব করবো, সেটাকে বলে রিডিউসিং ব্যালান্স মেথড।
আমাদের আলোচনায় যে প্রসেসে আপনার লোন শোধ হবে, সেটাকে বলা হয় লোন এমরটাইজেশন। লোনটাকে আমরা ধীরে ধীরে এমরটাইজ করে ফেলবো, অর্থাৎ মেরে ফেলবো।
বাংলাদেশের ব্যাংকে অবশ্য লোন হিসাবে কোয়ার্টারলি ইন্টারেস্ট এপ্লাই হয়। অর্থাৎ মাসে মাসে ইন্টারেস্ট এক্রু হয় (হিসাব করে জমা করে রাখে), কোয়ার্টার শেষে (৩১ মার্চ, ৩০ জুন, ৩০ সেপ্টেম্বর, ৩১ ডিসেম্বর) ইন্টারেস্ট প্রিন্সিপালে রুপান্তর হয়।
রিডিউসিং ব্যালান্স মেথড আর কোয়ার্টারলি ইন্টারেস্ট এপ্লিকেশনে মোটামুটি একই রকম রেজাল্ট। সামান্য হেরফের হতে পারে।
বিদেশের ব্যাংকে রিডিউসিং ব্যালান্স মেথড ব্যবহার করা হয়। সারা দুনিয়ায় এই মেথড চলে। বাংলাদেশে কার্যরত বিদেশি ব্যাংকও রিডিউসিং ব্যালান্স মেথড অনুসরণ করে।
আসুন, হিসাবকিতাবটা ভালোমতো বুঝে নিই।
প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে, পুরো ৫ বছর ধরে আপনি যে কিস্তিগুলো দেবেন, সেগুলোর একটা অংশ যাবে সুদ পরিশোধে, একটা অংশ যাবে আসল কমাতে।
আপনি ০১/১১/২০২৪ এ লোন নিয়েছেন। পরবর্তী ৬০ মাস আপনি কিস্তি দেবেন। আপনি যদি যথাসময়ে সব কিস্তি দেন আপনার লোন অক্টোবর '২৯ এর শেষে এমরটাইজ হয়ে যাবে (মরে যাবে)।
একটা মজার ব্যাপার বলে রাখি, ইংরেজি মাস ২৮/২৯/৩০/৩১ দিনে হয়। ব্যাংক কিন্তু আপনার কাছ থেকে প্রতি মাসেই ৩০ দিনের সুদ নেবে।
নভেম্বর মাস জুড়ে আপনার মোট আউটস্ট্যান্ডিং থাকবে ৩০০,০০০ টাকা। ৩০ দিনে আপনাকে সুদ দিতে হবে ৩০০,০০০*০.১৫/৩৬০*৩০= ৩,৭৫০ টাকা।
নভেম্বরে আপনি মোট কিস্তি দেবেন ৭,১৩৬.৯৮ টাকা। এর মধ্যে সুদ বাবদ যাবে ৩,৭৫০ টাকা। আউটস্ট্যান্ডিং কমে যাবে (৭১৩৬.৯৮-৩,৭৫০)= ৩,৩৮৬.৯৮ টাকা।
ডিসেম্বর মাসে আপনার আউটস্ট্যান্ডিং কমে দাঁড়াবে (৩০০,০০০-৩,৩৮৬.৯৮)= ২৯৬,৬১৩.০২ টাকায়। এ মাসে আপনার সুদ ব্যয় হবে ২৯৬,৬১৩.০২*০.১৫/৩৬০*৩০= ৩,৭০৭.৬৬ টাকা। এই মাসে আপনার আসল পরিশোধ হবে (৭১৩৬.৯৮-৩,৭০৭.৬৬)= ৩,৪৩৯.৩২ টাকা। এ মাসে আগের মাসের চেয়ে একটু কম সুদ ব্যয় হবে, একটু বেশি আউটস্ট্যান্ডিং কমানো যাবে।
জানুয়ারি '২৫ মাসে আপনার আউটস্ট্যান্ডিং কমে আসবে (২৯৬,৬১৩.০২-৩,৪৩৯.৩২)= ২৯৩,১৭৩.৭০ টাকায়। জানুয়ারিতে আপনার সুদ ব্যয় আরেকটু কমে যাবে। আসল পরিশোধ আরেকটু বেড়ে যাবে।
ফেব্রুয়ারি '২৫ এ আপনার আউটস্ট্যান্ডিং আরও কমে যাবে। সুদ ব্যয় আরেকটু কমবে। আসল পরিশোধ আরেকটু বাড়বে।
এভাবে, সুদ ব্যয় প্রতি মাসে কমতে থাকবে, প্রতি মাসে আসলের অংশ বেশি করে পরিশোধ হতে থাকবে।
২০২৯ সালের অক্টোবরে আপনি দেবেন শেষ কিস্তি। সেই ৭,১৩৬.৯৮ টাকার মধ্যে আপনার সুদ ব্যয় হবে মাত্র ৮৮.১১ টাকা, আউটস্ট্যান্ডিং পরিশোধ হবে ৭,০৪৮.৮৭ টাকা।
২০২৯ সালের অক্টোবরের কিস্তি প্রদান শেষে আপনি দায়মুক্ত হবেন। এই মাসে কিছু কম/বেশি টাকা দিতে হবে। লোনের স্যাংশন লেটারে লেখা থাকে যে, শেষ কিস্তিতে ব্যাংকের সমুদয় পাওনা পরিশোধ করতে হবে
এর মধ্যে আপনার সেভিংস একাউন্টে কিছু চার্জ দিতে হবে, লোন হিসেবে কিছু এক্সাইজ ডিউটি (সেভিংস আর লোন- দুই একাউন্টে ই ইডি কাটে) দিতে হবে, সেগুলো যদি আপনি সময়মতো পরিশোধ করেন, তাহলে এই লোনে আপনাকে বাড়তি কোনো টাকা দিতে হবেনা।
আপনি যদি অগ্রীম কিস্তি আপনার সেভিংস একাউন্টে জমা দেন, তাতে সাধারণত লোনের ইন্টারেস্ট কমে না। বেশিরভাগ ব্যাংক এখন সরাসরি লোন একাউন্টে টাকা জমা নেয়না। নির্দিষ্ট তারিখে সেভিংস একাউন্টে টাকা থাকলে লোন একাউন্ট সেটা টেনে নিয়ে যায়।
আপনি যদি আপনার লোনের প্রি-পেমেন্ট করতে চান, সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যাংক আরলি সেটেলমেন্ট চার্জ নেয়। এই চার্জ সাধারণত প্রিপেমেন্ট এর দিনের আউটস্ট্যান্ডিং এমাউন্ট এর ১% থেকে ২% হয়। লোন নেওয়ার আগেই এ সম্পর্কে জেনে নেবেন।
লোন দেওয়ার সময় ব্যাংক সাধারণত কিছু চার্জ নেয়। সিআইবি চার্জ (সাধারণত ১১৫ টাকা), ডকুমেন্টেশন চার্জ (সাধারণত ১,২৫০ টাকা), প্রসেসিং ফি (সাধারণত ০.২৫% থেকে ১%)- ইত্যাদি। এগুলো আপনার এককালীন খরচ।
আগেই ধরে নিয়েছি, আপনি সব কিস্তি সময়মতো দেবেন। যদি কোনো কিস্তি ওভারডিউ হয়, তাহলে একেক ব্যাংক একেকরকম জরিমানা ধার্য করে। কেউ লেট পেমেন্ট ফি (ভ্যাট সহ) নেয়, কেউ পেনাল ইন্টারেস্ট নেয়। আপনি সময়মতো কিস্তি না দিতে পারলে জরিমানা গুনবেন।
পুরা লোনের লাইফ সাইকেল সহজে বোঝার জন্য আমি কিস্তির হিসাব এবং এমরটাইজেশন শিডিউল এর ছবি যুক্ত করে দিলাম। কারও কোনো কনফিউশান থাকলে জানাবেন। চেষ্টা করবো ক্লারিফাই করার।
পুনশ্চঃ এই হিসাবকিতাব আমি আমার ফোনের ক্যালকুলেটর এ ই করেছি। লোনের টার্মস এন্ড কন্ডিশনস জানা থাকলে আপনি নিজেই নিজের লোনের কিস্তি হিসাব করে নিতে পারবেন। লোনের এমরটাইজেশন শিডিউলও বানাতে পারবেন। কেউ শিখতে চাইলে স্বাগতম।
কষ্ট করে সুদীর্ঘ পোস্ট পড়ার জন্য অগ্রীম ধন্যবাদ।
লেখা চন্দন আজিজ
সংগ্রহে Md Muhabbul Hassan