12/12/2023
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস : প্রচলিত মিথ ও ইতিহাসের বাস্তবতা :
নালন্দা মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রাচীনকাল থেকেই জ্ঞানচর্চা হতো। যার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হয় না, বরং ধ্বংসের ইতিহাসচর্চা হয় ব্যাপকভাবে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, এই বিহারটির প্রতিষ্ঠাতার অনুসন্ধান করেন না ঐতিহাসিকগণ। বরং গবেষণা করেন ধ্বংসকারীর পরিচয় সনাক্তকরণে!
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগটি বহুল চর্চিত ও প্রচলিত। ২০১৪ সালে ভারতের রাজ্যসভায় কংগ্রেস-সদস্য করণ সিং ও সিপিএম-সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের বিষয়ে বিতর্ক হয়। করণ সিং অত্যন্ত জোর গলায় এবং শক্ত ভাষায় দাবি করেন— বখতিয়ার খলজির হাতে বিহারটি ধ্বংস হয়েছে। আমরা এই লেখায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের প্রকৃত ইতিহাস পর্যালোচনা করার প্রয়াস চালাব।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়
===============➤
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা থেকে ৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং আধুনিক রাজগিরের ১১ কিলোমিটার উত্তরে বড়গাও নামক গ্রামের কাছে পাওয়া যায়। ভৌগোলিকভাবে প্রাচীন বাংলার সীমানার বাইরে হলেও এই অঞ্চলের সাথে তার যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই বাংলার ইতিহাসচর্চার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাসও খুব চর্চিত হয়।
ধারণা করা হয় গুপ্ত সম্রাটগণই সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নির্দিষ্ট করে কোনো সম্রাটের কথা উচ্চারণ করতে চাইলে রাজা কুমারগুপ্তের নামটি সামনে আসে। সাধারণভাবে প্রচলিত ইতিহাসের বিবরণী এর প্রতিষ্ঠাকাল বুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত নিয়ে যায়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে গুপ্ত যুগের আগের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।[১] গবেষক মুসা আল হাফিজ মনে করেন, নালন্দা মহাবিহার নির্মাণ করেছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ। তিনি নির্মাণের সময়কাল উল্লেখ করেছেন ৪২৭ খ্রিস্টাব্দ। [২] শুভজ্যোতি ঘোষ বলছেন ৪১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা।[৩] শেষোক্ত মতটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
এই মহাবিহারের নাম নালন্দা হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন, গ্রামটির নাম ছিল নালন্দা। মহাবিহারটি নালন্দা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়
এর নামকরণ করা হয়—নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বা মহাবিহার। ‘নালন্দা’ শব্দের অর্থ ‘দানে অকৃপণ’। জ্ঞান বিলাবার ক্ষেত্রে সত্যিই অকৃপণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি।[৪]
ইতালির বোলোনিয়াতে যখন ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তখন নালন্দার বয়স ছাড়িয়ে গিয়েছে ছয়শ বছর। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এই নালন্দা।[৫] পুরো কমপ্লেক্সটি ছিল লাল ইটের চওড়া ও উঁচু দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত। পনেরো বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছিল এর বিস্তৃতি। তার মধ্যে কেবল দশ শতাংশ খনন করা হয়েছে, বাকি অংশ এখনও মাটির নিচেই রয়ে গেছে। যে সময়ে পৃথিবীতে পারিবারিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষার বাইরে অন্য কোনো পঠনপাঠন পদ্ধতি চালু হয়নি, সেই সময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার এবং শিক্ষকের সংখ্যা দুহাজার! তৎকালে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষণ ভবনটি ব্যবহৃত হতো গ্রন্থাগার হিসেবে। শত-সহস্র বইপুস্তক ছিল পাঠাগারটিতে। একটি গ্রন্থাগার-ভবন ছিল নয় তলা উঁচু। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে জানা যায়, নালন্দার শিক্ষাদীক্ষা ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। থাকা,খাওয়া, চিকিৎসা, সব কিছুই ছিল বিনিময়হীন। মূল ব্যয় বহন করা হতো রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। জনসাধারণও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সন্ন্যাসী ও ছাত্রদের জন্য খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র ইত্যাদি দান করত। এখানে মূলত স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান করা হতো। দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করত৷ ফলে ভর্তি প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ। [৬]
পাল বংশীয় রাজাদের শাসনামলে (আট থেকে বারো শতক) এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এই সময়ে এর শিক্ষাদীক্ষার মান সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। কারণ পাল রাজাদের অকুন্ঠ ও উদারহস্থ পৃষ্ঠপোষকতা এবং দান-দক্ষিণা এমন ছিল, যা গুপ্তদের কৃতিত্ব ছাড়িয়ে গিয়েছিল। [৭]
তথ্যসূত্র
===============
১. আকসাদুল আলম: বাংলাপিডিয়া, ২ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, http:/ /bitly.ws/CFPs
২. মুসা আল হাফিজ: বাংলাদেশ ও ইসলাম; আত্নপরিচয়ের ডিসকোর্স, শোভাপ্রকাশ,ঢাকা,আগস্ট, ২০২২,পৃ: ১১৭।
৩.শুভজ্যোতি ঘোষ: বিবিসি নিউজ বাংলা, ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪,. http:/ /bitly.ws/CFUo
৪.পারভেজ সেলিম : আলোর দেশে, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, অনলাইন, http:/ /bitly.ws/D৩ch
৫. শুভজ্যোতি ঘোষ: বিবিসি নিউজ বাংলা, ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪,. http:/ /bitly.ws/CFUo
৬. সুদেব কুমার বিশ্বাস : http:/ /bitly.ws/CFWp
৭.আজসাদুল আলম : বাংলাপিডিয়া, ২ ফেব্রুয়ারি,২০১৫, http:/ /bitly.ws/CFPs
বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার ৬৯-৭০