08/06/2024
ফেসবুকের প্রোফাইলে নীল টিক মার্ক ও আমাদের অহংকারে ভরা ভেরিফায়েড চরিত্র!
………এস জে রতন
‘কই একদম অর্ডিনারি। উনার তো পেইজ/প্রোফাইল ভেরিফায়েডই না। উনারে দিয়া কাজ করুম ক্যামনে?’ হাতে থাকা সিগারেটের সামনের জ্বলে যাওয়া অংশটা লম্বা হয়ে এই মাত্র খসে পড়লো জমিনে। আহা ধন্য হলো জমিন, এই মাটি, সবুজ ছোট ছোট গুল্ম-ঘাস। ঐ সিগারেটখোরের প্রোফাইলে যেয়ে দেখা গেলো ৭,৩৫,২৩৯ জন ফলোয়ার! হায়রে শালার ব্যাটা কতো বড় সেলিব্রেটি। ইস/রা/য়ে/লি এই প্ল্যাটফর্মটি শেখাতে পেরেছে- নীল মার্ক করা থাকলে ঐ লোক সবচেয়ে বড় মাপের একজন মানুষ। শুদ্ধ, অর্গানিক ও বিশ্বস্ত। ডাকসাইটে প্রচার মাধ্যমে বা কাজে নানাভাবে সম্পৃক্ততা থাকলে কিছু ডকুমেন্টস্ দাখিল করা সাপেক্ষে নানা শর্ত মেনে তারা/ফেসবুক কর্তৃপক্ষ একসময় নীল টিক মার্ক দিতো। এটা পাওয়া যেন ছিল বেহেশতের এক টিকেট পাওয়া। বেহেশতের না হলেও পৃথিবীতে তাদের মতো নীল টিক-মার্ক পাওয়া ব্যক্তিরাই সফল, নামকরা এবং যথাযথ/প্রকৃত/জাতে-ওঠা ব্যক্তি, তারা ছাড়া বাকিরা ব্লাডি-সিভিলিয়ান!?
এক উঠতি সেলিব্রেটি (নিজেকে ভাবেন, এবং সেভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন), তিনি সবসময় তার যাবতীয় কাজ সম্পর্কে (সাংস্কৃতিক, চাকরি সম্পর্কিত, নামকরা সেলিব্রেটিদের সাথে মেশা) ফেসবুকে কিছুক্ষণ পরপরই আপডেট দেন। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সেলিব্রেটির সাথে তাকে দেখা যায়। বড় অর্জন তো আছেই, ছোট ছোট অর্জনগুলো নিয়েও তিনি দারুণভাবে পোস্ট দেন। তারও লাখ লাখ ফলোয়ার। একদিন হঠাৎ তার এফবি’তে নামের পাশে নীল রঙের টিক মার্ক দেখা গেলো। আশ্চর্য হয়ে গেলাম, এমন একটি অর্জন নিয়ে তিনি একটি কথাও বললেন না? পরে শুনলাম, এক্সপার্ট দিয়ে টেকনিক্যাল নানা কসরত করে অনেকঘাট ঘেঁটে তিনি ঐ ভেরিফায়েড মার্ক বাগিয়ে নিয়েছেন। যেহেতু বিষয়টা তার সাথে ঘনিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন, তাই তিনি ‘ভেরিফায়েড হয়েছেন নিয়ে’, ‘এটা তার গুণের ক্রেডিট বলে’ কোনো পোস্ট দিতে পারেননি।
কিছু মানুষকে তার একেবারেই সামান্য/নগণ্য গুণ নিয়ে এতো অনিন্দ্য-পোস্ট দিতে দেখি, যা দেখলে স্তব্ধ হয়ে যাই! কিছু মানুষ আছে যারা নীল-মার্ক-ওয়ালা ফেসবুক বা ইউটিউব ছাড়া কথাই বলতে চান না। এখন তো ওটা কিনতে পাওয়া যায়। মাসে মাসে বা বছরে সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে সহজেই নিজের নামের পাশে নীল মার্ক করা ভেরিফায়েড টিক কিনে নিতে পারবেন। তাহলে আম-জনতাকে বোঝাতে পারবেন আপনি সঠিক মানুষ, দামি মানুষ, সেলিব্রেটি এবং বিশ্বস্ত। অথচ কী তাই? এদের সাথে মিশেছেন? এদের কাজ-কর্ম দেখেছেন? এদের আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন? এক অহংকারী ও বেইজ্জত টাইপের প্রজন্ম/কাল-মেট আমরা রেখে যাচ্ছি এ বিশ্বে। বলতে পারবেন, আপনার পোস্টে কতজন নীল-টিক-ওয়ালা মানুষ আপনাকে লাইক দেয়, কমেন্ট করে, মন্তব্য করে? গুনলে দেখবেন পরিচিত এক/দু’জন ছাড়া আর কেউ না।
ওরা নিজেদেরকে পৃথিবীতে নিজেকে ইস/রা/য়ে/ল বা পশ্চিমা পাপিষ্ঠ-নরাধমদের কর্তৃক শুদ্ধ ও পবিত্র ভাবে। অথচ আমার ফেসবুকে লাখ লাখ বা মিলিয়ন ফলোয়ার নেই। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র বন্ধু আছে, তাদের সাথে মিশেছি- কী দারুণ তাদের মূল্যবোধ, বিরাট একটা মন, গুণী ও উন্নত মানুষ তারা। আর নীলদের বেশিরভাগই নিজেকে জাহির করা, বড় মনে করা, অহংকারী, ঔদ্ধত্য আচরণের মানুষ। খুব সামান্যই পেয়েছি- সত্যিকার অর্থেই যাদেরকে মানুষ পছন্দ করে এবং ভালবেসে তাদের জন্য লাখ লাখ ফলোয়ার হয়েছে, বা ঐ ব্যক্তির কোনো বিপদে দৌড়ে পাশে দাঁড়াবে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসর, উনি তখন ঢাবি’র আইবিএ’র চেয়ারম্যান। খুব নামকরা ব্যক্তি। তার বই দেশসেরা, এবং অনার্স-মাস্টার্সের পাঠ্যপুস্তক। একসময় তাঁর প্রাইভেট-কারে করে ক্লাস শেষে তাঁর সাথে ফিরতাম। পথেই আমার মেস পড়তো, তিনি নামিয়ে যেতেন। খুব পছন্দ করতেন আমাকে। খুব লজ্জাই লাগতো যখন এমবিএ’র ক্লাসে তা-ও পরীক্ষার হলে আমার কাঁধে আদর-মাখা হাত রেখে সবাইকে বলতো- অ্যাই দেখো রতন, ওর মতো হও। কত চুপচাপ পরীক্ষা দিচ্ছে, আর রেজাল্টের সময় ছক্কা মারছে। যেন নীরবেই এক কঠিন সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, বুঝতেই পারছে না কেউ। অথচ ফলাফলের সময় সবাই তার সফলতা দেখতে পাচ্ছে।
আমাদের ঠিক অমন মানুষ হতে হবে, যার সাথে মিশলে বোঝা যাবে তিনি সবচেয়ে বিনয়ী, ভদ্রজন, গুণী, পরিমিতি-বোধ সম্পন্ন এবং মেধাবী। তার নীল মার্ক দিয়ে তো ধুয়ে পানি খেয়ে লাভ নেই। আমাদের সেই প্রিয় অধ্যাপক স্যারের এফবি প্রোফাইলে ঢুকলে দেখা যায় মাত্র কয়েক হাজার ফ্রেন্ড। অথচ তিনি যে-মাত্রায় জ্ঞানী- অবলীলায় তাঁর অ্যাকাউন্টে বিলিয়ন ফলোয়ার থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না।
আমরা প্রায় সবাই নিজেকে জাহির করতেই ওস্তাদ। একটা সূত্র শিখিয়ে দিয়েছে বেনিয়াদের মার্কেটিং সিস্টেম, তা হচ্ছে ‘প্রচারেই প্রসার’। ‘যার যা কিছু আছে তা নিয়েই নেমে পড়া’র অভিপ্রায়ে তাই সবাই প্রচার করতেই ব্যস্ত। আসলে আমার মধ্যে কতটুকু আছে, তা দিয়ে আমার প্রচারটা বাড়িয়ে দিতে যেয়ে আসল জিনিসটা না পেয়ে মানুষ ঠকছে না তো? বঞ্চিত হচ্ছে না তো? তা কখনো ভাবি না। এভাবেই চলছে। তাই তো অখাদ্য, কুখাদ্যও আমাদের হজম করতে হচ্ছে। এই স্রোতেই তাই ভেসে বেড়াচ্ছে হিরো আলম, ড. মাহফুজুর রহমান, জায়েদ খানসহ আরো অনেকে। যারা আজ সেলিব্রেটি এবং পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধতম ভেরিফায়েড মানুষ। এ পৃথিবী তাদেরকে পেয়ে ধন্য।
আমি যেখানেই গেছি। গান গেয়ে পারফর্ম করেছি। মুগ্ধ হয়েছে সবাই। বড় সেলিব্রেটিদের মাঝেও প্রশংসায় ভেসেছি। কিন্তু আমার না ফলোয়ার বাড়ে! অথচ যাদের আজ মিলিয়ন ফলোয়ার তাদের বহু আগেই অর্থাৎ এধরনের টেকনোলজির একেবারে প্রথমদিনগুলো থেকেই আমি যুক্ত। শুধু তাই নয়, যারা আমাকে চেনেন, আমার সাথে প্রফেশনালি কাজ করেছেন, তারা জানেন আমি টেকনিক্যালি কতোটা সাউন্ড। সোশ্যাল মিডিয়া তো কিছু না। এমন কিছু সোশ্যাল মিডিয়ার নাম ও কাজ বলতে পারবো- যা ঐ সকল নীল-টিক-ওয়ালা সোশ্যাল-অহংকারীরা কোনদিন শোনেওনি। যেখানেই কাজ করি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাজ করি। সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করি। তারপরও দেখবেন মুহূর্তেই সেলিব্রেটি হয়ে উঠছি না। মিজানুর রহমান আজহারী একবার ইউটিউব চ্যানেল খুললেন। একদিনেই তার ৯লাখ সাবস্ক্রিপশন পেরিয়ে গেলো। অথচ আমিও ওয়াজ শুনি, ভাল লাগে। আজহারীকেও। আমি কিন্তু সাবস্ক্রিপশন করিনি। এর অর্থ এই নয়, হিংসা করে করিনি এমনটা নয়। আজহারীর উদাহরণ টেনে আনাতে কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন হতে পারেন।
কেউ কেউ বলেন, ভাই আপনার তো ফলোয়ার কম, তাই আপনি রাগে-ক্ষোভে এমন পোস্ট লিখছেন। আমি বলবো- না, তা নয়। কিছু মানুষের ফলোয়ার কখনো বাড়ে না, বাড়তে নেই। বন্ধু খুব বেশি দরকার নেই। প্রয়োজনের বন্ধু ১/২ জন থাকলেই চলে। সেই অনেক বছর আগে, একবার এক নজরুল সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গান করে মাত্রই স্টেজ থেকে নেমেছি। আমি তখন সাহেবী ক্যাপ ব্যবহার করতাম। চেহারা কিছুটা দেখা যেতো আবার যেতো না। কিন্তু গান শুনে মুগ্ধ হয়ে এক নজরুল সঙ্গীতের প্রবীণ নারী শিল্পী আয়োজকদের বলতে লাগলো- ক্যাপ পরা শিল্পীটা কোথায় গেলেন? উনারা বললেন- কেন? নারীটি বললেন- আর বলবেন না, এতো চমৎকার করে নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা যায়! আমি মুগ্ধ। তখন ঐ অনুষ্ঠানে হিরো আলমের মতো জনপ্রিয় মানে (ফলোয়ার) বন্ধু বেশি থাকা শিল্পীও ছিলেন, কিন্তু আমার এই একটি নারীর প্রশংসায় আয়োজকরা এতো খুশি হয়েছিলেন যে, পরবর্তীতে উনারা যত অনুষ্ঠান করেছেন আমাকে নিয়ে গেছেন; এবং তারা বলেছেন- আমার জন্য নাকি তাদের আয়োজনের মান এতো উপরে উঠেছে। পরে এক অনুষ্ঠানে তারা আমার নাম ঘোষণা করে সেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
আমি বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম- বন্ধু বলুন আর প্রশংসাকারী বলুন, জাত-মতো একটা হলেই যথেষ্ট।
এক নীল-ওয়ালার এফবি’তে ঢুকলাম। অন্যের পোস্ট-ই তিনি বেশি শেয়ার করে রেখেছেন। দু’কলম লেখা কথা বা নিজের কোনো পারফর্মেন্স নেই, বা তার নিজের ক্রিয়েটিভ কিছু দেখলাম না। অথচ কেন যেন ১,৪৭,০০০ ফলোয়ার। অনেকেই এখন এগুলো ক্রয়-বিক্রয় করেন। হা হা। মানুষের মধ্যে এক ভয়ানক রোগ বিস্তার করে আছে এসব।
নীল লাগবে, সেই নীল, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল, বেনিয়া-বসতির নীল, গা/জা/য় নির্বিচার হ/ত্যা/কা/রী ইস/রা/য়ে/লি বা/হি/নী/র নীল!!
(সংক্ষেপিত)