![](https://img3.medioq.com/410/163/122181129044101631.jpg)
12/12/2024
ছড়ামর্শ
জনি হোসেন কাব্য
ছড়ামর্শ, ছড়া লেখার পরামর্শ । এখানে শুধুমাত্র ছড়া নিয়েই কথা হবে । ছড়া এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্য আছে । কবিতায় রহস্যময়তা থাকে, কিন্তু ছড়ার বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হ়য় । কবিতা এবং ছড়া দুটোতেই ছন্দ বিদ্যমান । ছড়ামর্শে আমরা শুধু ছড়ার ছন্দ, গঠন, আকার, এবং ছড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপাদান সম্পর্কে জানবো । জেনে রাখা জরুরি, ছড়ামর্শে উদাহরণ দেওয়া বেশিরভাগ ছড়াই স্বরবৃত্ত ছন্দের ।
★ এক।
'ছড়া লেখার নিয়মকানুন'ত
যারা ছড়াজগতে একেবারেই নতুন অথবা ছড়া লেখার নিয়মকানুন আয়ত্বে নেই তাদের জন্যে এই ছড়ামর্শটি । এটি জানা এমন কোনো কঠিন বিষয় নয় । খুবই সহজ, মজার, উপভোগ্য ।
ছন্দ সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদেরকে প্রথমেই ছন্দের কিছু উপকরণ সম্পর্কে জানতে হবে ।
ছড়াংশের মাধ্যমে সেসব উপকরণের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
পর্ব :
ছড়ায় ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাল বা অংশকে পর্ব বলে ।
উপরোক্ত ছড়াংশটির মাধ্যমে পর্ব চিনতে চেষ্টা করি-
আমের পাতা (এক পর্ব) + বাঁশের পাতা (এক পর্ব) + মুড়ে বানাই (এক পর্ব) +বাঁশি (অন্ত্যমিল পর্ব=এক পর্ব), = চার পর্ব ।
মিষ্টি অতীত (এক পর্ব) + তোমায় ভেবে (এক পর্ব) + কষ্ট পেয়ে (এক পর্ব) + হাসি (অন্ত্যমিল পর্ব = এক পর্ব) ।= চার পর্ব ।
সুতরাং ছড়াংশটির প্রতিটি লাইনই চার পর্বের ।
অন্ত্যমিল :
ছড়ায় ব্যবহৃত একটি বাক্যের শেষ পর্বের সাথে আরেকটি বাক্যের শেষ পর্বের যে মিল তাকে অন্ত্যমিল বলে ।
উদাহরণ দেওয়া ছড়াংশটির মাধ্যমে অন্ত্যমিল চিনতে চেষ্টা করি-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
এখানে, প্রথম বাক্যের শেষ পর্বটি হচ্ছে 'বাঁশি' এবং দ্বিতীয় বাক্যের শেষ পর্বটি হচ্ছে 'হাসি' । সুতরাং 'হাসি' শব্দের সাথে 'বাঁশি' শব্দের যে মিল সেটিকেই বলা হয় অন্ত্যমিল ।
স্বর :
ছড়াংশে ব্যবহৃত দুটি শব্দ উদাহরণ দিয়ে স্বর দেখাচ্ছি-
পাতা= পা + তা = দুটি স্বর
মিষ্টি= মিষ্ + টি = দুটি স্বর ।
স্বর দু' প্রকার-
১। মুক্তস্বর
২। বদ্ধস্বর
মুক্তস্বর-
যেসব স্বর টেনে স্বাধীনভাবে পড়া যায়, কোথাও আটকে যেতে হয় না, সে সব স্বরকে মুক্তস্বর বলে ।
'পাতা' শব্দটি উচ্চারণ করি-
পা..., তা..., = এখানে, দুটি উচ্চারণ । সুতরাং দুটি স্বর । দুটি স্বরই স্বাধীনভাবে পড়া যায় কোথাও আটকে যেতে হয় না । দুটি স্বরই মুক্তস্বর ।
বদ্ধস্বর-
যেসব স্বর স্বাধীনভাবে পড়া যায় না, পড়তে যেয়ে আটকে যেতে হয়, সেসব স্বরকে বদ্ধস্বর বলে ।
'মিষ্টি' শব্দটি উচ্চারণ করে দেখি-
মি...ষ্, টি... = এখানে দুটি উচ্চারণ । সুতরাং দুটি স্বর । কিন্তু 'মি...ষ্' স্বরটি বদ্ধস্বর । কারণ এই স্বরটি পড়তে গেলে (মি থেকে শুরু করলে ষ্-এ এসে) আটকে যেতে হয় । বাকী 'টি...' স্বরটি স্বাধীনভাবে পড়া যায় তাই এটি মুক্তস্বর ।
মোটামুটি এসব উপকরণ নিয়েই ছন্দ গঠিত হয় । এবার আসি মূল বিষয়ে ।
ছন্দ :
ছড়ার শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল স্বরবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে ।
ছন্দ তিন প্রকার-
১। স্বরবৃত্ত ছন্দ
২। মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
৩। অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
স্বরবৃত্ত ছন্দ-
ছড়ায় বহুল ব্যবহৃত হয় বলে, এই ছন্দকে ছড়ার ছন্দ বলা হয় । স্বরবৃত্ত ছন্দে স্বরের হিসেব করে মাত্রাগণনা করা হয় । একেকটি স্বর একেকটি মাত্রা । মুক্তস্বর যেমন এক মাত্রা তেমনি বদ্ধস্বরকেও এক মাত্রাই গণনা করা হবে ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের ছড়ায়, প্রতিটি বাক্য চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত হয় । চারটি পর্বের পর পর তিনটি পর্বকে বলা হয় মূল পর্ব । আর শেষ পর্ব অর্থাৎ চতুর্থ পর্বকে বলা হয় অন্ত্যমিল পর্ব ।
আগের উদাহরণটি দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
প্রথম বাক্যে লক্ষ করি,
বাক্যটি চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত । প্রথম তিনটি মূল পর্ব । এবং শেষের পর্বটি অন্ত্যমিল পর্ব ।
'আমের পাতা + বাঁশের পাতা + মুড়ে বানাই = তিনটি মূল পর্ব ।
বাঁশি = অন্ত্যমিল পর্ব ।
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত ।
সুতরাং প্রতিটি বাক্যের কাঠামো একই হবে ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের ছড়ায়, প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার হয় । অন্ত্যমিল পর্বগুলি এক মাত্রার হয়, দুই মাত্রার হয়, তিন মাত্রার, চারমাত্রারও হয়ে থাকে ।
পূর্বের উদাহরণটি দিয়েই বিশ্লেষণ করা যায়-
'আমের পাতা/ বাঁশের পাতা/ মুড়ে বানাই/ বাঁশি,
মিষ্টি অতীত/ তোমায় ভেবে/ কষ্ট পেয়ে/ হাসি ।'
ছড়াংশে প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার । আর বাকী অন্ত্যমিল পর্বগুলি দুই মাত্রার ।
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি-
'আ(মুক্তস্বর) + মের(বদ্ধস্বর)+ পা(মুক্তস্বর)+তা(মুক্তস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
বাঁ(মুক্তস্বর) + শের( বদ্ধস্বর) + পা(মুক্তস্বর) +তা(মুক্তস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
মু(মুক্তস্বর) + ড়ে(মুক্তস্বর) + বা(মুক্তস্বর) + নাই(বদ্ধস্বর) = চারটি স্বর । সুতরাং, চারটি মাত্রা ।
বাঁ(মুক্তস্বর) + শি(মুক্তস্বর) = দুটি স্বর। দুটি মাত্রা ।
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোর ।
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৪+৪+৪+২, (প্রথম বাক্য)
৪+৪+৪+২।(দ্বিতীয় বাক্য)
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
জেনে রাখা ভালো-
স্বরবৃত্ত ছন্দে " জড়িয়ে/চড়িয়ে/মাড়িয়ে/তাড়িয়ে/হারিয়ে/জ্বালিয়ে/পালিয়ে/জুড়িয়ে/পুড়িয়ে/লুকিয়ে/শুকিয়ে/লুটিয়ে" প্রভৃতি শব্দগুলো যদি বাক্যের শুরুতে বা মাঝে থাকে, তাহলে দ্রুতলয় উচ্চারণের কারণে শব্দগুলো তিনমাত্রার হলেও সেসব দুমাত্রা ধরা হবে । আর যদি বাক্যের শেষে থাকে, তাহলে তিনমাত্রা ধরা হবে ।
কবি আল মাহমুদ একটি জনপ্রিয় ছড়ার আটটি লাইন দেখি-
‘আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে ।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর পুলটায়,
দুধ ভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায় ।'
এখানে 'লুকিয়ে,ঘুমিয়ে' শব্দদুটি বাক্যের মাঝখানে থাকায় দুমাত্রা ধরা হয়েছে ।
মূলত, স্বরবৃত্ত ছন্দ এগুলাই ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ-
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তস্বর একমাত্রাই । কিন্তু বদ্ধস্বরকে দুই মাত্রা গণনা করা হয় । স্বরবৃত্ত ছন্দের সাথে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের পার্থক্য এতটুকুই ।
• স্বরবৃত্ত ছন্দের মতোই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছড়াতেও, প্রতিটি বাক্য চারটি পর্ব নিয়ে গঠিত হয় । চারটি পর্বের পর পর তিনটি পর্বকে বলা হয় মূল পর্ব । আর শেষ পর্ব অর্থাৎ চতুর্থ পর্বকে বলা হয় অন্ত্যমিল পর্ব ।
উদাহরণ দেওয়া যায়-
'সেই সব/ অতীতকে/ খুঁজে পাবো/ কই,
মনে সাধ/ জাগে ফের/ ছোট্টটি/ হই ।'
• মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছড়ায় প্রতিটি বাক্যের মূলপর্বগুলি চার মাত্রার, ছয়মাত্রার হয়ে থাকে । অন্ত্যমিল পর্ব এক মাত্রার, দুই মাত্রার, তিন মাত্রার, চার মাত্রার হয়ে থাকে ।
প্রতিটি বাক্যের মূলপর্ব চার মাত্রার উদাহরণ -
'সেই সব/ অতীতকে/ খুঁজে পাবো/ কই,
মনে সাধ/ জাগে ফের/ ছোট্টটি/ হই ।'
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করে দেখাচ্ছি-
শুরুতেই বলেছি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তস্বর একমাত্রাই । কিন্তু বদ্ধস্বরকে দুই মাত্রা গণনা করা হয় । যাই হোক বিশ্লেষণে যাচ্ছি,
সেই(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + সব(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা
অ(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + তীত(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + কে(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা
খুঁ(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + জে(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) পা(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) + বো(মুক্তস্বর=একটি মাত্রা) = চারটি মাত্রা ।
কই,(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = দুটি মাত্রা( অন্ত্যমিল পর্ব)
দ্বিতীয় বাক্যটিও ঠিক একই কাঠামোর ।
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৪+৪+৪+২,
৪+৪+৪+২ ।
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
প্রতিটি বাক্যের মূলপর্ব ছয় মাত্রার উদাহরণ -
'এইখানে তোর/ দাদির কবর/ ডালিম গাছের/ তলে,
তিরিশ বছর/ ভিজিয়ে রেখেছি/ দুই নয়নের/ জলে ।'
প্রথম বাক্যটি বিশ্লেষণ করি-
'এই(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + খা (মুক্তস্বর) + নে(মুক্তস্বর) তোর(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
দা(মুক্তস্বর) + দির(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + ক(মুক্তস্বর) + বর(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
ডা(মুক্তস্বর) + লিম(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) + গা(মুক্তস্বর) + ছের(বদ্ধস্বর=দুটি মাত্রা) = ছয় মাত্রা
ত(মুক্তস্বর) + লে,(মুক্তস্বর) = দুই মাত্রা (অন্ত্যমিল পর্ব)
ছড়াংশটির পর্ববিন্যাস দাঁড়ায়-
৬+৬+৬+২,
৬+৬+৬+২ ।
পরের বাক্যগুলিও ঠিক একই কাঠামোয় গঠিত হবে ।
মূলত, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এগুলাই ।
ছড়া মূলত স্বরবৃত্ত ছন্দ ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা হয় । অক্ষরবৃত্ত ছন্দে তেমন একটা ছড়া রচনা করা হয় না । একেবারে কাঁচা লিখিয়েদের আপাতত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ না শিখলেও চলবে।