19/02/2024
৩৮ বছর বয়সে এসেও রাস্তাঘাটে ইভটিজিংয়ের স্বীকার হতে হয় প্রায়শই। তাও, আবার নিজের সন্তানের বয়সী ছেলেপেলেদের দ্বারা। লজ্জায় এসব কথা কাউকে বলিও না। কিন্তু, আজ একটু বেশি বেশিই করে ফেললো কয়েকটা ছোকড়া। যা মুখে আসছিল বলে যাচ্ছিলো।
আমি প্রথমে ধমক দিলাম। কিন্তু, শেষে মাথা নিচু করে চলে এলাম। কারন, রাস্তায় আমি একা যাচ্ছি। আর এদের মধ্যে নূন্যতম ভদ্রতাও নেই!
বাড়ি ফিরে কি মনে করে সকল লজ্জা বিসর্জন দিলাম। আমার ১৫ বছর বয়সী ছেলেকে নিজের ঘরে ডাকলাম। বললাম, ‘জানিস বাবা! রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় প্রায়ই টিজিং এর স্বিকার হই। হয়তো কোন ছেলে শিষ বাজালো, কিংবা গান গেয়ে উঠলো। অথবা তার চেয়েও খারাপ কিছু ইঙ্গিত করলো। খুব কষ্ট হয় জানিস! ওরা এমন করে কি মজা পায়?’
বলতে বলতে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো।
দেখলাম আমার ছেলে রাগে কাঁপছে।
আমি বললাম,
- 'রাগছিস নাকি? তুই তো মেয়ে না। এতো রাগার কি আছে?'
ও বললো,
- 'কি যে বলো মা... তোমার সাথে এমন করেছে আমার তো রাগে গা পুড়ছে। ওদের পেলে খু'ন করবো আমি।'
আমি হাসলাম। বললাম,
- 'বাবা তুইও বড় হয়েছিস। পথে ঘাটে, বাসে অনেক মেয়ে দেখবি। কখনো তারা দূর্বল দেখে, একলা দেখে সুযোগ নিয়ে অশ্লীল কথা বলবি না। মনে রাখবি তারাও কারো না কারো মা-বোন হয়। তাদের যদি তুই টিজ করিস তাহলে তুই আর আজ আমাকে যারা আজ টিজ করায় তুই রেগে গেলি তাদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
কোনো মেয়ে যদি খারাপও হয় তবুও তোর কোনো রাইট নেই যে তুই তাদের খারাপ উক্তি করবি। আমাকে আজকে কথা দে যাদের ব্যবহারে তোর মা'র চোখে পানি এসেছে তুই তাদের মতো হবি না।'
আমার ছেলে বললো,
- 'মা আমি কখনোই এমনটা করবো না। তোমার কি আমাকে এতো খারাপ মনে হয়?'
----
-----------
-----------------
আমার পাশের বাসার ১ প্রতিবেশীরও আমার ছেলের বয়সী ১টা ছেলে আছে। প্রায়ই ওদের ঘর থেকে ঐ ছেলের বিশ্রী ভাষায় করা গালিগালাজ আমি শুনতে পাই। ছেলেটা গালি দেয় তার বড় বোনকে, ছোট ছোট ব্যাপারে।
একদিন আমি ঐ বাসার ভাবীকে বললাম,
- 'আপনার ছেলে বড় বোনকে গালি দেয় আর আপনি কিছু বলেন না?'
উনি পান চিবোতে চিবোতে বললো,
- 'ছোট ছেলে একটু আধটু ভুল তো করবেই ভাবী!'
কয়দিন পর শুনি সেই ছেলে আছাড় মেরে ১২ হাজার টাকা দামের ১টা ফোন ভেঙেছে। কারন, সেটা নাকি কমদামি। সে আরো দামি ফোন চায়। আর বাবা কিনে দিতে রাজি নয় বলে সে রাগ করে এই ফোনটা ভেঙেছে।
আমি এবারও ছেলের মাকে বললাম,
- 'আপনার উচিত ছিলো ওকে কষিয়ে দুটো থাপ্পর মারা।'
উনি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
- 'পুরুষ হয়ে জন্মেছে, রাগ তো থাকবেই। মেয়েদের মতো হবে নাকি?'
আমি আর কিছুই বললাম না।
পাশাপাশি বাসা হওয়ার কারণে প্রায়ই ওদের ঘরের কথা আমার কানে আসতো। সেই ছেলেকে বলতে শুনতাম, ‘ঐ আমার শার্ট ধুয়ে দিস নাই কেন?’ , ‘আমার প্যান্টটা ধুয়ে দে তো।’ , ‘মা, এখনো রান্না হয়নি? কি বা** করো ঘরে বসে? খাবারও পাইনা টাইম মতো?’
আরো অনেক অনেক কথা। সে তার মা-বোনকে চাকরের মতো এসব অর্ডার করে। আমি ভারী অবাক হতাম। এতো কিছুর পরেও ওর মা ওকে সেরকম কিছুই বলতো না।উল্টা উনি আমাকে বলতো, ‘আমি কেন আমার ছেলে কে দিয়ে ঘরের কাজ করাই?’
যাইহোক, একবার সেই ছেলের নামে বিচারও আসলো। সে তার ক্লাসের ১টা মেয়েকে আজেবাজে কথা বলেছে।
তখনও ঐ ভাবী ছেলের পক্ষেই ছিলেন। আমাকে বললেন, ‘মেয়েটা বেয়াদপ। যেই রঙ-ঢং করে ঘুরে পোলাপাইন পিছনে লাগবে না? আমার ছেলের উঠতি বয়স ওকে আর কি দোষ দিব বলেন?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
- 'মেয়ে যদি অভদ্র হয় তাহলে তার বাবা-মা তাকে শাসন করবে। কিন্তু, আপনার ছেলে যে এত বড় অন্যায় করলো আপনি তাকে কিছু বলবেন না?'
উনি বললো,
- 'ধুরর, আপনার সাথে আমার কথাই মিলে না। কি এমন করেছে আমার ছেলে? আপনি বেশি ই নীতি কপচান।'
উনি আমার সাথে আর কথা বলতেন না।
এভাবে দিন যায়,বছর ঘুরে। আমার ছেলের নামে আমি কোনোদিন এমন বিচার পাইনি যে মেয়েদের অসম্মান করেছে। আর সেই প্রতিবেশীর ছেলে ইভটিজিং থেকে শুরু করে এখন ধ'র্ষনেও চলে গেছে।
প্রথমে উনি ছেলের দোষ ঢাকলেও এখন আর ঢাকেন না। বোধহয়, বুঝেছেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। সেই ছেলে কবার জেলেও গিয়েছে। আরো, নানান অন্যায়ের সঙ্গেই সে জড়িত।
এখন, তার মা কপাল চাপড়ান। বাবাও ছেলেকে খুব শাসন করে। কিন্তু, এখন শাসন করে লাভ কি? ১টা মাটির পুতুল বানাতে গেলে যদি শুরুতে ভুল শেইপ হয় তাহলে কুমার সেটাকে আবার ঠিক শেইপ দেয়। কারন, মাটি তখন নরম থাকে। কিন্তু, ১বার যদি পুতুল বানিয়ে শুকানোর পর চোখে পরে আকৃতি ঠিক হয়নি, তখন তা আর ঠিক করার উপায় নেই।
ছেলের মা এখন কেঁদে কেঁদে বলে,
- 'ভাবী ১টা জানোয়ার পেটে ধরেছিলাম!'
আমি বললাম,
- 'ভাবী মানুষের পেটে কখনো জানোয়ার হয় না। মানুষ ই হয়। সেই মানুষটাকে ছোট থেকে কখনো মাত্রাতিরিক্ত আদর, কখনো মাত্রাতিরিক্ত শাসন, কখনোবা ছোট ছোট অন্যায়কে প্রশ্রয় কিংবা অধিক প্রায়োরিটি দিয়ে তার পরিবারই তাকে জানোয়ারে পরিণত করে।'
পরিবার
#লেখনীতে - শাপলা