14/02/2024
আজকের ভালোবাসা দিবসে আমার কিছু আগের ছোটো(!) একটা লেখা পরিমার্জিত করে আবার দিচ্ছি:
প্রায় সবাই একটা বয়স থেকে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কেনো? এর নানা ধরণের উত্তর পাওয়া যায়:
১. যার সাথে সম্পর্ক করতে চাই তার প্রতি এক ধরণের বিশেষ অনুভূতি এবং আকর্ষণ হচ্ছে, যেটাকে ভালোবাসা বলে মনে হচ্ছে এজন্য।
কথাটা অবশ্যই ঠিক। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে কাউকে ভালো লাগা শুরু হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এই সময়টায় শারীরিক এবং মানসিক অনেক দ্রুত পরিবর্তন হয়। কিন্তু একটু নিজেকে প্রশ্ন করেন যে, এই পরিবর্তনগুলোতো একটা বয়সে এসে স্থির হবেই, তখন কি আপনি নিশ্চিত যে এই পরিবর্তনের সময়টুকুতে যে আপনার আবেগ সৃষ্টি হবে সেটা আপনি বজায় রাখতে পারবেন? এটি শুধু যে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করার যে শিহরণ (বিশেষত উঠতি বয়সে) তা নয়তো? এবং পরবর্তীতে জীবনের নানা ক্ষেত্রে যেয়ে যে বিভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, যেমন আপনার ও আপনার পছন্দের মানুষটির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে এরকম আরো অনেক কিছু, এগুলোর জন্য যে সম্পর্কটি করতে চাচ্ছেন বা যে সম্পর্কটি হয়ে গিয়েছে সেটিকে কি বজায় রাখতে পারবেন? নাকি সমাজিক দায়বদ্ধতার কারণে ভালোবাসা না থাকলেও তা ভালোবাসা নামে চালিয়ে যাবেন?
২. এটা এক ধরণের অনুভূতি যা প্রকাশ করা যায় না।
অবশ্যই এটা এমনই অনুভূতি। ভালোবাসা বিষয়টি শারীরিক, এমনকি মানসিকও নয়। এখন আপনি কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন অল্প বয়সেই যে অনুভূতিটি অনুভব করছেন সেটা মূলত কি? যে অনুভূতি আপনি অনুভব করছেন সেটা পরর্বতী জীবনে যেয়ে নানা পরিস্থিতিতে, নানা পরিবর্তনে আপনি সেই অনুভূতিটিকেই ভুল অনুভূতি ছিলো, অনুভূতিটি যখন হয়েছিল তখন সত্যি ছিলো এখন নয় প্রভৃতি এমনটি বলবেন না? ভালোবাসার অর্থ সবার কাছে এক নয়। আপনি ভালোবাসাকে যে অর্থে সংজ্ঞায়িত করেছেন তা সারাজীবন ভাববেনতো? আর আপনার ভালোবাসার মানুষটি সেইভাবেই ভালোবাসাকে ভাববেতো বা মানিয়ে নেবে আপনি নিশ্চিত? কোনো পরির্বতন হলে আপনারা মানিয়ে নিতে পারবেনতো? এমনকি ধরে নিলাম, এক তরফাভাবে হলেও আপনার যে অনুভূতি অনুভব হচ্ছে (যে অনুভূতি বদলাতেও পারে) জীবনের নানা সময়ে তা আপনি নিজে বজায় রাখলেও বাহ্যিক কোনো পরিস্থিতিতে বা আপনার ভালোবাসার মানুষটির কোনো পরিবর্তনে সেটা ঠিক রাখতে পারবেনতো?
৩. অনেককেই করতে দেখি তাই আমারও এরকম করতে হবে। বিশেষত সিনেমা-নাটক দেখে, গল্প-উপন্যাস পড়ে উৎসাহিত হয়ে।
এটাতো সহজেই বোঝা যায় যে এটা এক ধরণের কৌতুহল। এখন কথা হচ্ছে অনেকেই অল্প বয়সে অনেক কিছুই কৌতুহলের জন্য করে থাকে যেমন কোনো কিছু সংগ্রহ করা, কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা, চিত্র-কলার নানাদিকে আগ্রহ, এমনকি পড়াশোনাও আগ্রহ নিয়ে করা। সময়ের সাথে সাথে এরা এগুলোর থেকে অনেকটাই আগ্রহ হারিয়ে দূরে সরে পড়ে। আপনিও কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন ভালোবাসার ক্ষেত্রে আপনার এই কৌতুহল সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলবেন না? সিনেমা-নাটকে, গল্প-উপন্যাসে ভালোবাসাকে অনেকটাই রঙিনভাবে সাজিয়ে কল্পনা মিশিয়ে দেখানো হয়। এগুলো দেখে বা পড়ে আপনি যে এরকম ভালোবাসা চাইছেন তা কি নিজের জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছেন না দেখে এরকম কোনো সম্পর্ক জড়াতে চাচ্ছেন কি? নিজের জীবনের বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে এরকম সম্পর্কে আদৌ জড়াতে পারবেন কি? এবং এর ভিত্তি আপনার মতে কি খুব মজবুত? এই সম্পর্ক কি যাবে বহুদূর?
৪. আমি এমন কাউকে চাই যাকে পেতে চাই আজীবনের জন্য। তাকে আমার পেতে হবেই, যে কোনো ভাবে। সেটা প্রচলিত সমাজের বিরোধী বা নিষিদ্ধ কোনো সম্পর্ক হলেও হোক।
এটাতো অবশ্যই এক ধরণের জেদ, নিজের কাছে নিজেকে এবং মানুষের কাছেও এক ধরণের প্রমাণ করতে। ভালোবাসার সম্পর্কগুলো কখনওই জেদ থেকে হয় না। কারণ একবার ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে গেলে (এখানে পেয়ে যাওয়া বলতে সমাজের চোখে মূলত পাওয়া, রিলেশনশীপে জড়ানো, বিয়ে হওয়া এরকম। প্রকৃত ভালোবাসায় প্রাপ্তির কিছু আছে কি?) এক ধরণের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় এবং তারপর আগ্রহ আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলতে হয়। পরে সামাজিক দায়বদ্ধতা এমনকি নিজের কাছে নিজেকে সৎ দেখানোর জন্য আগ বাড়িয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভালোবাসা আছে এটি দেখাতে হয়। এখন যা ভেতর দিয়ে হচ্ছে না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসছে না তার নামই কি ভালোবাসা? আবার আরেকটা বিষয় আছে, ধরেন যে সম্পর্কটি আপনি করতে চাইছেন তা সমাজ ঠিকভাবে মেনে নেবে না বা নিষিদ্ধ। এখন আপনি এই সম্পর্কটি কেনো করতে চাইছেন? আপনি আপনার ভালোবাসা সত্যি মনে করেন বলে এজন্য? নাকি নিষিদ্ধ বা সমাজে প্রচলিতভাবে যে সম্পর্কগুলো হয় না তার প্রতি এক ধরণের কৌতুহল আছে এজন্য? নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরার জন্য সম্পর্কটি যাতে হয় এজন্য এক ধরণের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন? একেই আপনি বলছেন ভালোবাসা? সম্পর্কটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত প্রতিকূলতা আপনি সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবেনতো? করলে কি জন্য করবেন? ভালোবাসার জন্য বা একটা বিষয়ের সাথে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে এখনতো এগুলো করতেই হবে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে এজন্য? ভালোবাসার দোহাই দেয়া এবং ভালোবাসা কি এক?
৫. উঠতি বয়সে একটুতো মজা করবোই! nothing serious! এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা অনেকের সাথেই!
এটা যে ভুল এটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। কয়েকবছর গেলেই এর প্রভাব কি হতে পারে তা আপনি আপনার বন্ধু মহলে এমনকি পরিবার-আত্মীয়স্বজনের কাছেও তা উপলব্ধি করতে পারবেন। পরবর্তীতে নিজেকে শুধরালেও লোকের মুখে এই ব্যপারে আপনাকে শুনতে হবে বলতে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত। ভালোবাসার বিষয়টি মজার বিষয় না এবং তা মজার হিসেবে নিলে পরবর্তী ক্ষেত্রে মানুষ আপনাকে হালকা হিসেবে নিবেই এবং আপনার পরিস্থিতি হয়ে উঠবে অনেকটা মিথ্যা বলা রাখাল বালকের মতো। সত্যিকার অর্থে যখন কাউকে ভালো লাগবে সে আপনার আগের এই ইতিহাস সম্পর্কে জেনে আপনাকে ভালোবাসাতো দূরের কথা, ভালো করে বোঝারও মানসিকতা রাখবে না। আপনার পরবর্তীতে জীবনে অনেকের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার আগ্রহের বীজে তৈরি হতে পারে এর কারণে। এটা ঠিক শুরুর দিকে এরকম কিছুটা করলে সমাজ আপনাকে মজার ছলেই নেবে, তবে পরর্বতীতে এরকম বজায় রাখলে এর প্রভাব আপনার জন্য হবে বিভিন্নভাবে খুবই খারাপ।
৬. জীবনে বিশেষ কাউকে পেলে নিজের মনের কথাগুলো শেয়ার করতে পারবো (বিশেষ করে দুঃখ-কষ্টগুলোর), নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো ঐ মানুষটির সাথে কিছু সময়ের জন্য কাটালেও দূর করে রাখতে পারবো। নিজের ভেতরে এক ধরণের অপূর্ণতা কাজ করে, যেটা আমি ভালোবাসা পেলে পূর্ণ করতে পারবো।
এই বিষয়টিকে অনেকেই ঠিক মনে করতে পারেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায় যে এটাও এক ধরণের মারাত্মক ভুল। নিজের কথা অনেকেই শেয়ার করে থাকে অন্যদের সাথে স্বাভাবিকভাবে বন্ধু ভেবেই। প্রথম কথা হচ্ছে, যাকে আপনি বন্ধু ভাবছেন তিনি আপনার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলেও তিনি আপনাকে সত্যিকার অর্থে বন্ধু নাও ভাবতে পারেন। পরবর্তীতে তিনি তার অন্যান্য বন্ধু মহলে যেয়ে আপনার বলা বিষয়গুলো নিয়ে হাসি-তামাশা করতেই পারেন এমনকি এর সুযোগগ্রহণও করতে পারেন, সম্মিলিতভাবেও। যার সাথে আপনি সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছেন, তার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগেও কথাগুলো বললে বিষয়টি সমভাবে প্রযোজ্য। এমনকি সম্পর্কে জড়ানোর পরেও নিজের মনের কথাগুলো অবাধভাবে বলতে থাকলে সমস্যা হতে পারেই এবং আপনি যাকে ভালোবাসার মানুষ ভাবছেন সে আপনার প্রতি ভালোবাসা নাও অনুভব করতে পারে এমনকি ভালোবাসা অনুভব করলেও আস্তে আস্তে কম অনুভব করতে থাকবে এবং একটা সময় তিনি বিরক্ত হবেনই। নিজের খারাপলাগা, দুঃখ-কষ্টগুলো নিজের থেকেই সমাধান করতে হয়, মূলত তা মানসিকভাবেই। নতুবা আপনার সম্পর্কের মধ্যেই এই খারাপলাগা, দুঃখ-কষ্টগুলো একটা সময় অবশ্যই আসতে থাকবে বিভিন্ন রূপে। একইভাবে নিজের ভেতরের অপূর্ণতাগুলো নিজের থেকে ঠিক করতে না পারলে (মূলত মনের ভেতর থেকে) তাহলে একটা সময়ে এসে আপনি আপনার সম্পর্কেও নানা ধরণের অপূর্ণতা খুঁজে পেতে থাকবেন।
৭. জীবনে বিশেষ কাউকে পেলে নিজেকে motivated এভাবে রাখতে পারবো যে ভালো করে পড়াশোনা করা লাগবেই, ভালো একটা জবে ঢোকা লাগবেই, তাই ঐ মানুষটিকে পেলে আমি জীবনে সফল হবোই।
এক্ষেত্রে আপনার পড়াশোনায় ভালো করা, ভালো একটা জবে ঢোকা এগুলোর জন্য ভেতর থেকেই একটা urge থাকতে হবে, বাহ্যিক কোনো বিষয়ের উপর না। বাহ্যিক সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তা নেচিবাচক কিছু হলেতো খারাপ হবেই এমনকি ইতিবাচক কিছু হলেও মানুষ সহজে তা মেনে নিতে নাও পারে। তাই বলে কি আপনি পড়াশোনায় ভালো করা, ভালো কোনো ক্ষেত্রে যাওয়া, জীবনে সফল হওয়ার স্পৃহা হারিয়ে ফেলবেন? আপনি কি আসলেই জীবনে সফল হওয়ার জন্য (যেটা প্রচলিত অর্থে হোক বা গূঢ়ভাবে হোক) কোনো সম্পর্কের সাথে সংযুক্ত হতে চাইছেন?
৮. ঐ বিশেষ মানুষটিকে জীবনে পেলেই আমার জীবন সার্থক, আমি সারাজীবন খুশিতে-আনন্দে কাটিয়ে দিতে পারবো।
এভাবে চিন্তা করাও এক ধরণের জেদ। কোনো কিছু পেয়ে গেলে মানুষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেটা বস্তুগত হলেতো অবশ্যই, কোনো মানুষের সাথে জড়িয়ে রাখলে তার প্রতিও যে আগ্রহ হারাবে না তার নিশ্চয়তা কি? ধরে নিলাম নিশ্চয়তা আছে। এখন আপনিই বলেন আপনার জীবন সার্থক হওয়া কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানোর মধ্যেই আপনি নিচ্ছেন, এটাকে কি আপনি সত্যিই জীবন সার্থক হওয়া হিসেবে নেবেন? জীবনের শেষ পর্যন্ত এই ধারণা আপনি বজায় রাখতে পারবেন? আর জীবনে খুশি থাকাটাই আসল? দুঃখ কি জীবনে আসবেই না? সেটা মানিয়ে নেয়ার মানসিকতা আপনার থাকতে হবে না? হাঁ বলতে পারেন যে জীবনে দুঃখ আসলেও সেটাকে আপনি খুশি-আনন্দে আরো ভালো করে মানিয়ে নিতে পারবেন আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে পেলে। কিন্তু আপনি নিশ্চিত যার সাথে আপনি সম্পর্কে জড়াচ্ছেন সেই মানুষটি আপনাকে কখনোই কষ্ট দেবে না বা তার কিছুতেই আপনি কষ্ট পাবেন না? সে শুধু আপনার পাশে আছে এমনটি হলেও আপনি জীবনের পাওয়া ঘাত-প্রতিঘাতগুলো ভালো করে মোকাবেলা করবেন? আপনার ভালোবাসার মানুষটি ঐ ঘাত-প্রতিঘাতগুলোতে আপনাকে কোনো সাহায্য না করলেও? ঐ ব্যাপারগুলোতে তার বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ, উদাসীনতা, হতাশা প্রভৃতি আসলেও? ওনার কাছ থেকে বা জীবনের বিভিন্ন মোড়ে কষ্ট পাওয়ার পরও আপনি সারাজীবনের জন্য আপনার জীবন সার্থক এমন মনোভাব বজায় রাখতে পারবেন? বলবেন যে আপনি তার দেয়া কষ্টগুলোকে অগ্রাহ্য করে চলবেন। এগুলোও কি এক ধরণের নিজেকে ও মানুষের কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার এক ধরণের অভিনয় হয়ে যাচ্ছে নাতো?
৯. কারো কোনো বিষয়ে দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান, চেহারা, চাকচিক্য, স্মার্টনেস ইত্যাদি দেখে সম্পর্ক করতে ইচ্ছা হচ্ছে।
এই বিষয়টি মানুষ সরাসরি স্বীকার করে না। এরকম মানুষের ইচ্ছা হয় কারণ কিছুটা হলেও সে ভাবে না যে তা না যে এমন সম্পর্ক হওয়ার পর নানা দিক থেকে সে সুবিধা পাবে, সমাজে তার একটি অবস্থান হবে প্রভৃতি। এগুলো যে সত্যিকার সম্পর্কের ভিত্তি না এটাতো সকলেই বুঝতে পারে। যারা এগুলোকে উদ্দেশ্য করে সম্পর্ক করে তাদের সম্পর্ক কি আদৌ টিকে থাকবে? মনে হতে পারে এসব বাহ্যিক বিষয়াদি দেখে মনের অজান্তেও কারো প্রতি ভালোবাসা অনুভূত হচ্ছে। এখন নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, এটাকে কি সত্যিকারের ভালোবাসা বলবেন? এই যে বাহ্যিক বিষয়গুলো তা একটা সময়তো পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক যেমন কোনো বিষয়ে দক্ষতা, চেহারা, সামাজিক-আর্থিক অবস্থান। শিক্ষাগত যোগ্যতা কি ভালোবাসার মানদন্ড কোনোভাবে? শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে কি আপনার মনের গভীরে এরকম হিসেব হয়ে যাচ্ছে নাতো যে এ অনেক শিক্ষিত, ভালো ভালো জায়গায় পড়েছে, ভালো রেজাল্ট করেছে তাই সে ভবিষ্যতে ভালো একটা অবস্থানে থাকবেই, তাই তার সাথে যুক্ত হলে আমার জীবন secure? জীবনের নিরাপত্তা এবং ভালোবাসাকে এক হিসেবে মানছেন বা ভালোবাসার অংশ হিসেবে মানছেন? তার মানে জীবনে নিরাপত্তার কথা বিবেচনা না করলে ভালোবাসা নেই বা টিকে না? আবার স্মার্টনেসতো মানুষকে দেখানোর জন্যেও করতে পারে, তার আসল রূপ যদি অন্য হয় তখন? আচরণের পরিবর্তন যখন দেখতে পারবেন তখন কি আপনি সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য মানুষটির সাথে থেকে যাবেন? নাকি সমস্ত কারণ বিবেচনা তার সবকিছুকেই ভালো হিসেবে দেখছেন এবং যে কোনো ধরণের দোষত্রুটি অগ্রাহ্য করছেন? এমন কি সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়েও যে সুবিধাগুলো পাচ্ছেন সেগুলোর কথা চিন্তা করে (মনের অজান্তে হলেও) থেকে যাবেন? নিজের ব্যক্তি স্বার্থ এসে যাচ্ছে নাতো? এর নামই ভালোবাসা?
১০. এই বিষয়টি সবাই সরাসরি বলতে চায় না বা মানতেও চায় না, কারণ এটি ভদ্রতার খাতিরে এবং সামাজিকভাবে বলা অনুচিত। মানুষ শুধু নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে মজা করে বা খোলামেলাভাবে আলোচনা করে থাকে এগুলোL বিষয়টি হচ্ছে জৈবিক, নিজের এবং নিজের সঙ্গীর শারীরিক চাহিদা মেটানো।
এই পয়েন্টের ব্যাখায় কিছু অশোভন কথা বলবো। তাই যারা পড়তে ইচ্ছুক নয় দয়া করে এই অনুচ্ছেদটি পড়া বাদ দেবেন। বিবাহ বন্ধনের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর মাধ্যমে সামাজে স্বীকৃত এবং বৈধভাবে শারীরিক মিলনের জন্য আবদ্ধ হওয়া যায়। আদিম যুগেতো বিয়ের রীতিই ছিলো না। তখনতো মানুষ অবাধে মেলামেশা করতো। তাই আপনি বলেন আপনি কি আসলেই ভালোবাসার জন্য মানুষটিকে বিয়ে করছেন নাকি আপনার শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য? যদি আপনি বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও আদিম যুগের মতো আপনার শারীরিক চাহিদা মেটাতে পারতেন, তাইলে তখনও কি আপনি যার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করছেন সেটাকে ভালোবাসার নাম দিতেন? আরেকটা গরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নিজের সন্তান হওয়া। মানুষকে যদি এই বিষয়ে কিছু বলতে বলা হয় তাহলে এ জাতীয় কথা বলে যে সন্তান হওয়ার আনন্দ মুখের ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি নিজের একটা অংশ, নিজের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে কাউকে রেখে যেতে চাই পরবর্তী প্রজন্মের সর্বোপরি মানবজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা জন্য। আমার সন্তান দেশের-দশের নানা উপকার করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে প্রভৃতি। আর আপনিতো বলছেনই যে আপনি নিজের ও আপনার সঙ্গীর অপার আনন্দের জন্য সন্তান নিচ্ছেন। একেই আপনি ভালোবাসা বলছেন। অপার আনন্দকে কি আপনি ভালোবাসার সাথে মিলিয়ে ফেলছেন কি? অপার আনন্দ লাভই কি ভালোবাসার মূল উদ্দেশ্য আপনার কাছে? তাছাড়া আপনি কি নিশ্চিত যে মূলত মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন? তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে এজন্য যার সাথে আপনি বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বা হতে চাচ্ছেন তার প্রতি আপনার ভালোবাসার সঞ্চার হয়েছে বা হবে? একেই আপনি প্রকৃত ভালোবাসা বলে অভিহিত করছেন? আপনি কি মনে করেন যাদের সন্তান আছে বা একটু খারাপ করেই বলছি যারা নিয়মিত নানা ভাবে শারীরিকভাবে মেলামেশায় আবদ্ধ হয় তাদের মধ্যেই সত্যিকারের ভালোবাসা আছে? আর যারা নিঃসন্তান বা শারীরিকভাবে মেশে না মিশতে পারে না (যেমন বৃদ্ধ দম্পতি) তাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই? যাবতীয় কামভাব বয়স বাড়ার সাথে সাথে হ্রাস হতে থাকবে। তখন সামাজিকভাবে দায়বদ্ধতার জন্য যেমন সন্তানকে উপযুক্ত করা, বৃদ্ধ বয়সে আশেপাশে কাউকে দরকার প্রভৃতির কথা মনের অবচেতনে হলেও না ভেবে আপনি তখন আপনার সম্পর্কটিকে ভালোবাসার নাম দেবেন?
এই পয়েন্টের সাথে আরো একটা আনুষাঙ্গিক বিষয় তুলে ধরতে চাচ্ছি। কারো হাতে বা কাঁধে হাত রাখা, একসাথে পাশাপাশি বসা, একসাথে কোথাও যাওয়া, একসাথে ছবি তোলা প্রভৃতি বিষয়গুলো এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে, অনেক ছেলেমেয়েরাই এগুলো করে থাকে। বলে যে তারা কেবল বন্ধু বা ভাইবোনের মতো। সমাজ এই ব্যাপারগুলোর প্রতি আগের থেকে অনেক নমনীয় হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। প্রযুক্তির কল্যাণে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই সবাই একে অপরের সাথে মিশতে পারছে একে অপরের সাথে interact করছে চ্যাট করে, অডিও বা ভিডিও কলে নানাভাবেই। এরপর বিষয়গুলো আরো গভীরে মোড় নিতে পারে (দুজনের যদি ইচ্ছা হয়), সেটা অনেকদিনের জন্য হতে পারে এবং সেটা বিয়ে এবং বিয়ের পর জীবনের শেষ পর্যন্ত হতেই পারে, বা কিছু সময়ও টিকতে পারে (এই অল্প সময়ে হাত ধরা ছাড়াও আরো অনেক কিছুই হতে পারে), এমনকি কোনো দিকে মোড় না নিয়েও দুটি জীবন দুটি পৃথক পথে চলে যেতে পারে তাদের ক্ষেত্র বা মানসিকতা পরিবর্তন হলে। বিষয়টা নোংরা ও খারাপ দিকেও মোড় নেয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সহশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে হোক, আর অন্য কোনো ক্ষেত্রে হোক মানুষ এগুলো সহজভাবেই মেনে নিচ্ছে বড় ধরণের খারাপ কিছু না হওয়া পর্যন্ত। অনেকে আছে যারা জীবনসঙ্গী পরখ করার জন্য হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকের সাথে মেশে হালকা-পাতলাভাবে এগুলো করে। তারপর যার সাথে সে মনে করে যে সে বেশি মনের সাঁড়া পেয়েছে তার সাথেই সে সম্পর্কে জড়ায় বা সম্পর্ক করতে চায়। এখন নিজেকে প্রশ্ন করুন ছোটোখাটোভাবে যে এই শারীরিকভাবে মেশা মানে মূলত অল্প-স্বল্পভাবে স্পর্শ করার কথা বলছি (এখানে কারোর অন্য কিছু দেখে আপনার মনকে স্পর্শ করে যাওয়াও হতে পারে), এরপর আস্তে আস্তে আপনার মনের ইচ্ছা বাড়ার কারণে যে সম্পর্কটি করতে চাচ্ছেন সেটাকে আপনি ভালোবাসা বলবেন? যদি সম্পর্ক হয়েও যায় এর ভিত্তি কেমন? এগুলোর অনেকগুলোইতো খুবই ভঙ্গুর কারণ হাল আমলের কিছু অতি পরিচিত শব্দ যেমন crush খাওয়া, relationship-এর চেষ্টা করা বা হওয়া, relation-এর পরে breakup প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই। আর সম্পর্কটি বিয়ে পর্যন্ত গড়ালেও বিয়ের পরের সাংসারিক জীবন ভালো করে চলছে কি? এই বিয়েগুলো টিকছে ঠিকমতো? নাকি কোনো মতে টিকিয়ে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটার নামই হচ্ছে ভালোবাসা? নাকি হাতেগোনা কয়েকটি সম্পর্কের নাম করে আপনিও এরকম কিছু করতে ঝাঁপিয়ে পড়তে চান? পরবর্তীতে অন্য কারো সাথে স্পর্শ আপনার হবে না (কি শারীরিকভাবে কি মানসিকভাবে) নিশ্চিত? এবং হলেও তা আপনার ভালো লাগবে না আপনি নিশ্চিত? ভালো লাগবে না কারণ যার সাথে আপনার সম্পর্ক আছে তাকে আপনি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেন? নাকি তখন ভালো লাগলেও আপনি তা মন থেকে নাকচ করে দেবেন আপনি নিজেকে একজন সৎ মানুষ হিসেবে গণ্য করতে চান এজন্য?
অনেকে এরকমও আছে যে এক তরফা ভালোবাসায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ যে তাকে ভালোবাসে না তাকে সে ভালোবেসে যাবে। আপনি কি এমন মনোভাব সারাজীবনের জন্য রাখতে পারবেন, আপনি তাকে ভালোবাসেন বলে মনে করেন এজন্য? কেউ যদি আপনার মনে পরবর্তীতে আরো গভীরভাবে রেখাপাত করে (এরকম অনেকেই হতে পারে), বা তার সাথে সম্পর্ক করতে ইচ্ছা হলে, বা চেষ্টা করলে তাহলে তাকেও কি এক তরফাভাবে ভালোবেসে যাবেন আগেরটি ভুলে যেয়ে বা না যেয়ে? পরবর্তীতে অন্য কোনো সম্পর্ক হয়ে গেলে তখন আগের মনোভাবকে কি বলবেন? নিজের মনকে নিজের মতো করে বুঝ দিয়ে পরের হওয়া সম্পর্কটিকে সত্যিকারের ভালোবাসা বলবেন? এরকম করলে বা করতে থাকলে মানুষতো আছেই যারা এগুলো জানবে সেই সাথে আপনার নিজের প্রতি নিজের মনোভাব তখন কি হবে সেটা ভেবেছেন কি? আবার কিছু মানুষ এরকম দেখা যায় যে ভালোবাসার মানুষটিকে না পেলে বা হারিয়ে ফেললে আজীবন একা থেকে যায়। এটা কি ভালোবাসার জন্যেই করা হয় নাকি ভালোবাসার নামে অন্য বেশ কিছু জিনিসও কাজ করে? যেমন ভালোবাসা ছাড়া অন্য অনেক কিছুতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া? বয়স হওয়ার কারণে, সামাজিক অবস্থানের কারণে এক ধরণের সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি হওয়া? ভালোবাসার অনুভূতি কমে যাওয়া? এগুলোই যদি মূল বিষয় তাহলে এটাকেই কি সত্যিকারের ভালোবাসা বলবেন আজীবন একা থেকে যাওয়াকে?
আরেকটা বিষয় আছে, জীবনের পথে চলতে চলতে দেখা যায় যে, একজনের সাথে বেশ কিছু সময় সম্পর্ক থাকছে, তারপর বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে তৈরি হওয়া নানা সমস্যার কারণে সম্পর্কটি ভেঙ্গে যাচ্ছে। তারপর আবার অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক হচ্ছে অন্য ক্ষেত্রে যেয়ে অন্য পরিস্থিতিতে। এরকম করে একজনের অনেকগুলো সম্পর্কই হতে পারে জীবনে। হাঁ অনেকেই বলতে পারেন নতুন যে সম্পর্কটি হচ্ছে পরবর্তী ক্ষেত্রে যেয়ে সে সময় আমি আরো বেশি ম্যাচিউর এবং নতুন যে সম্পর্ক হচ্ছে সেটা আমি বজায় রাখতে পারবো বেশ ভালো করেই। হাঁ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এটা বজায় থাকছেও বেশ ভালো করে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে। এখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, যে সম্পর্কগুলো আপনি নিজেই প্রথমে টিকিয়ে রাখতে পারেননি, সেগুলোর প্রতি কি আপনি নিজেই স্বীকার করছেন না আপনি পরিপক্ক ছিলেন না বা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি? আর নতুন যে সম্পর্ক হচ্ছে সেগুলোতে কি আপনি শুধু সঠিক ভালোবাসা অনুভব করার দিক থেকেই পরিপক্ক হয়েছেন এজন্য? সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কিছুর জন্যে নয়তো? তাইলে আপনি নিজেই কি স্বীকার করছেন ভালোবাসা পরিবর্তনযোগ্য সময়ের সাথে সাথে? স্বীকার করছেন আগে যেটাকে ভালোবাসা বলেছেন সেটা আসলে প্রকৃত ভালোবাসা ছিলো না? আর যে সম্পর্কগুলো স্বীকৃত নয় যেমন পরকীয়া, একাধিক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক সেগুলোতেওতো মানুষ জড়ায় এক ধরণের ভালোবাসা ভেবেই। আপনি এরকম কিছুতে না জড়ালেও এধরণের সম্পর্কগুলোকে আপনি কি বলবেন? এগুলোও ভালোবাসা? আপনি কি পরবর্তীতে এরকম সম্পর্কে জড়ালে এটাকেও কি সত্যিকার ভালোবাসা বলবেন? নিজেরমতো করে বৈধ করে নেবেন নিজের কাছে? মানুষের কাছে?
এগুলোতো ছিলো বেশ কিছু পয়েন্টের আলোচনা। অনেকে এগুলো পড়ে এটাও বলতে পারেন আমার ভালোবাসা হচ্ছে সবথেকে অনন্য এবং আমি সফল হবোই। এটাও কি উপরের করা আলোচনাগুলোর সাথে মিলে যাচ্ছে না? আর আপনি কি এই ব্যাপারেও নিশ্চিত সম্পর্ক তৈরি করার থেকে শুরু করে, সম্পর্ক থাকাকালীন অবস্থায় অন্যদের যে সম্পর্কগুলো হয়েছে বা ছিলো সেগুলোর থেকে ধারণা নেবেন না বা শিক্ষাগ্রহণ করবেন না? আপনি নিজের থেকেই যেটা ঠিক মনে করেন সেটাই করবেন একদম নতুনভাবে কোনো ধারণা না নিয়েই? নাকি শুধু বিরল কয়েকটি সফল ভালোবাসার সম্পর্ক, মানে যে সম্পর্কগুলোকে আপনার সফল ও প্রকৃত ভালোবাসা বলে মনে হয়েছে (যেমনটি নাও হতে পারে), সেগুলোর দোহাই দিয়ে নিজে সম্পর্ক করার চেষ্টা করবেন বা হওয়া সম্পর্ককে সেগুলোর মতো করার চেষ্টা করবেন? তারা পারলে আমি পারবো না কেনো, এই মনোভাব নিয়ে? এর নামই ভালোবাসা?
বলতে পারেন ভালোবাসতে লাগে না কারণ। কিন্তু সত্যিই কি এমনটি আপনি ভাবছেন এবং এভাবেই আপনি সারাজীবন বজায় রাখতে পারবেন? এসব সম্পর্কে জড়ানোর আগে নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্ন করুন। একটু হলেও ভাবুন। নিজের কাছেতো নিজেকে সৎ রাখা যাই-ই তাই না? :)