17/07/2024
আমাদের ব্যর্থতা-
নিরবে চলে গেলেন উদীয়মান প্রতিভাবান এক সংঘসদস্য। যেন হঠাৎ এই জ্বলে উঠে, হঠাৎ-ই নিভে গেল। কোথাও যেন কারো ক্ষতি হয়েছে কিংবা বিশেষ কেউ হারিয়ে গেছে তেমন কোনো অনুভুতির প্রকাশও নাই।
কী ভিক্ষুসমাজ! কী গৃহীসমাজ! সবাই নিরব।
যেন কোথাও কিছুই ঘটেনি।
আসলে এই সমাজ, এই জাতি বড়ই অকৃতজ্ঞ।
অথচ গত তিনদিন আগেও শত শত মানুষের সমাগম হতো। দূরদূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ যেত শুধু একটুখানি পুণ্য লাভের আশায়। কতো কতো ধর্মোপদেশ, কতো কতো দান-দক্ষিনা। ঢাকা-চট্রগ্রাম থেকে পালাক্রমে সেবক-সেবিকারা যেতো। বৌদ্ধ সমাজের উচ্চশিক্ষিত, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার থেকে শুরু করে কোটিপতিরাও যেতো। ফুল-ফলেও ভান্তের পুজা হতো। ভান্তের পাশে বসে, ভান্তের সান্নিধ্যে গিয়ে শুধু একটি ছবি তোলার কতোই উদ্গ্রীব থাকতো। মুখে মুখে কতোই কীর্তিগাথা প্রচলন ছিল। ভান্তের কতো ত্যাগের মহিমা গুণকীর্তন হতো। ভান্তের সাথে দু”এক শব্দ কথা বিনিময় করতে পারলে নিজেদেরকে সুভাগ্যবান মনে করতো। অনলাইনেও নিয়ম করে ধর্মোপদেশ চলতো। শত শত মানুষেরাও তা দেখতো।
মাত্র একদিনের ব্যবধানে এতো শত ত্যাগ, যশ-কীর্তি, প্রসংশা সবই নিমিষে অতীত হয়ে গেল।
হয়তো মাস খানিকের মধ্যে অবশিষ্ট যা আছে- তাও আর থাকবে না।
শুধু গৃহী সমাজ কেন, ভিক্ষু সমাজেও এই নিয়ে সিকি পরিমানও আগ্রহ, প্রচেষ্টা, কর্তব্যবোধ টুকুও চোখে পরল না।
বরং কিছু কিছু ভিক্ষু পেইজবুকে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে আনন্দ উদযাপনের অনুভুতি শেয়ার করছে। কেউবা দামী ও রসালো খাবারে ছবি পোষ্ট করছে। কেউবা ভ্রমনের ছবি পোষ্ট করে স্বর্গীয় সুখের অনুভুতি প্রকাশ করছে।
মোদ্দা কথা- সবাই যেই যার মতোই ভিনদাস আছে। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি।
এতে এটাই পরিস্কার যে- এ রকম দীপঙ্কর ভান্তে শুধু একটা কেন! দশটা দীপঙ্করও যদি হত্যা হয়, আমাদের বিবেকের কোনো পরিবর্তন হবে না।
আবার অন্যদিকে একশ্রেনীর অতি আবেগী দল- ঢালাও ভাবে পাহাড়ি-সমতল বিভাজন করে করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে লাগল। (এই নিয়ে পূর্বে একটি পোষ্টও করেছি)
অথচ উচিত ছিল আসল রহস্য বের করে উপযুক্ত আইনানু ব্যবস্থাও নেওয়ার।
কই সেদিকে কারো তেমন প্রতিক্রিয়া চোখেও পরল না।
অথচ আমাদের বৌদ্ধসমাজে আইনজীবি, বুদ্ধিজীবি সহ সাংঘটনিক পদ-পদবীধারী ব্যক্তির অভাব নেই। নিজেদেরকে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী দাবীকারীরও অভাব নেই।
সভাসমিতিতে তাদের ভাষণ-বক্তিতায় জোসেরও কমতি নেই।
কিন্তু বিপদ কালে ……সবাই নিরব।
আসলেই মানুষের পুরো জীবনটাই এমন। দিনশেষে আপন বলতে এখানে কেউ থাকে না। একমাত্র নিজের কর্মই একমাত্র সঙ্গী।
মৃত্যুর পরে কে সুনাম করল, কে বদনাম করল তা মৃতব্যাক্তির কিছু আসে-যায় না।
তবে কৃতজ্ঞতা পরায়ন জাতি কখনও গুরু, আচার্য্য পথপ্রদর্শকদের কথা ভুলে না। অন্ততপক্ষে আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে হলেও, জাতি-সমাজ-ধর্ম রক্ষায় এগিয়ে আসে।
আমাদের যেই সকল বড়ুয়ারা গত দু”তিন ধরে ঢালাও ভাবে পাহাড়িদেরকে দায়ী করে ক্ষোভ প্রকাশ করছে তাদের জন্যে কমেন্টে একটি ছবি সংযোজন করেছি। আশা করি দেখার পর বড়ুয়া ভিক্ষু ও গৃহীদের আসল চরিত্র আরো প্রকাশ পাবে।
আমি বলছি না, বড়ুয়া মানেই খারাপ। তবে আমরা খুবই অদূর্দশী। এবং খুব অল্পতেই বাস্তবতা ভুলে যায়।
বড়ুয়া সমাজে যেই কয়জন সাধক ও ধ্যানীর ভিক্ষুর জন্ম হয়েছে, তা পাহাড়িদের নিরব অবদানে হয়েছে। বড়ুয়ারা শুধু ঐ ধ্যানী ভিক্ষুর নাম প্রচার প্রাসার হওয়ার পরেও লাইন ধরে পুজা অর্চনা করতে, নচেৎ এর আগে তেমন কোনো সাড়া শব্দই থাকে না। যেই ভিক্ষু যতই পরিচিতি বড়ুয়াদেরকে কাছে সেই ভিক্ষুর কদরও তত বেশি।
কারণ বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজে একজন ভিক্ষু যতই শীলবান-মেধাবী ধ্যানী-সাধক হোক না কেন! সেই ভিক্ষু যদি বিহার উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্যে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টাকা বা অনুদান ভিক্ষা না চায় সেই ভিক্ষু কখনও ঐ বিহার কমিটির কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। পুজা-অর্চনা তো দূর কী বাত। তাই বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজের সাধক-ধ্যানী ও গবেষক ভিক্ষু জন্যে পরিবেশ খুবই ক্ষীন। (এভাবে বলতে গেলেই প্রসঙ্গটি অনেক দীর্ঘ হবে।)
অন্যদিকে আদিবাসী চাকমা-মারমা সমাজে ভিক্ষু-শ্রামণদেরকে বিহার উন্নয়ন বা সংস্কারের জন্যে চাপাচাপির বোঝা তুলে না দিয়ে- শীল-সমাধী চর্চার জন্যে যতটুক সম্ভব পরিবেশ তৈরী করে দেন। (পাহাড়ে অবস্থানরত বড়ুয়া ভিক্ষুদের নাম বলতে গেলেই প্রায় সকলের নামই বলতে হবে, তাই আপনারা একটু ভেবে নিবেন।)
সেই জন্যে বড়ুয়া বৌদ্ধ সমাজের কুলপুত্ররা/ভিক্ষুরা উপযুক্ত পরিবেশ প্রত্যাশায় পাহাড়ে-অরণ্যে আশ্রয় নেয়। সেই দূর্দিনে চাকমা-মারমা আদিবাসী বৌদ্ধরা তাদের শত দৈন্যতার মাঝেও ভিক্ষুদেরকে চারিপ্রত্যয় দিয়ে রক্ষা করেন।
আপনি যদি চাকমা-মারমা আদীবাসি বৌদ্ধদের সাথে মেলামেশা করেন তাহলে বিষয়টি সহজে উপলব্দি করতে পারবেন। প্রকৃত ধর্মীয় চেতনায় তারা আমাদের চেয়েও বেশী উদার। বড়ুয়াদের সিংহভাগ দান-ধর্ম হচ্ছে লোক দেখানো, নাম-সুনামের মোহ প্রত্যাশী। সেদিক থেকে পাহাড়ি বৌদ্ধরা পুরোই ভিন্ন।
তবে এটাও সত্য যে, বড়ুয়া বৌদ্ধরাও আদিবাসী চাকমা-মারমা সমাজের জন্যে অনেক অবদান রেখে যাচ্ছে। তাদের কুলপুত্রদেরকে নানা ভাবে বিহারে, আশ্রমে আশ্রয় দিয়ে লেখা-পড়া সহ প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগীতা করছে এবং করে যাচ্ছে।
সুতরাং এভাবে এক তরফা ক্ষোভ বিদ্বেষ প্রকাশ না করে, ঘটনাটির প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করাই সমগ্র বৌদ্ধজাতির মুখ্য
কর্তব্য হবে।
©️নশ্বর সুজয়