23/01/2021
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্থায়ী প্রভাব রাখতে যাচ্ছে করোনাকালীন যে ৪টি ট্রেন্ড
মানুষ সংকটে পড়লে সেখান থেকে উত্তরণের জন্যে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে থাকে। চলমান মহামারিতেও একই চিত্র দেখা গেছে।
এখন পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি দেশের সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কোভিড-১৯ মহামারির সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলে ছোট-বড় প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানেই নতুন অনেক কিছুর প্রচলন শুরু হয়েছে।
বহুজাতিক সার্ভিস কোম্পানি ‘অ্যাকসেনচার’-এর মতে, এবারের মহামারির সুদূরপ্রসারী প্রভাব ব্যাংকিং খাতেও এসে পড়েছে। ফলে ব্যাংকিং-এর ব্যাপারে মানুষের মনে থাকা অনেক ধারণাতেই পরিবর্তন আসছে। এতে করে ব্যাংকের কর্মী এবং গ্রাহক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবার অভ্যাস ও আচরণে কিছু পরিবর্তন এসেছে।
অ্যাকসেনচার ‘ব্যাংকিং টেকনোলজি ভিশন ২০২০’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যাংক সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রেই কয়েক মাসের মধ্যে এমন অনেক পরিবর্তন এসেছে, যেসব পরিবর্তন আসতে বছর খানেক সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতর কারণে সেসব পরিবর্তন ও উদ্ভাবন অনেক দ্রুত সামনে এসে পড়েছে। বাসা থেকে কাজ করা, হাতের স্পর্শ ছাড়াই পেমেন্ট পদ্ধতি কিংবা অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনার মতো বিষয়গুলির প্রচলন মহামারির পরেও থেকে যাবে। অর্থাৎ, বর্তমানের প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে ভবিষ্যতের জন্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করাটাই এখন সব ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
অবশ্য, এবারের মহামারির ফলে গ্রাহকদের প্রত্যাশা এবং আচরণে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সংখ্যা খুব বেশি না। বরং সংকটের এই সময়ে পূর্ব থেকে প্রত্যাশিত পরিবর্তনগুলিই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের আগে অ্যাকসেনচার যে গবেষণা পরিচালনা করেছে, সেজন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মোট ৬৭০ জন কার্যনির্বাহী সদস্যের উপরে জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপ অনুসারে, মহামারির ফলে প্রযুক্তি খাতে শুরু হওয়া ৪টি ট্রেন্ড সামনের দিনগুলিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এই ট্রেন্ডগুলি সম্পর্কেই একে একে জেনে নেয়া যাক এবার।
#১. গ্রাহকদেরকে পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করা
ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণত তাদের গ্রাহকদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ই নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে ব্যাংকিং-এর ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা গ্রাহকের সুবিধা এবং পছন্দ অনুসারে সেবা দেয়ার জন্যে প্রোডাক্ট পার্সোনালাইজ করার প্রচলন থাকলেও সেই সম্পর্কে গ্রাহকদেরকে তেমন কিছু জানানো হয় না। এর ফলে গ্রাহকদের নিজেদের হাতে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অথচ প্রোডাক্ট বা সার্ভিস পার্সোনালাইজ করার জন্য ঠিক এর বিপরীতটাই করা দরকার। পার্সোনালাইজেশনের জন্যে গ্রাহকদের অংশগ্রহণ ব্যাপক হারে বাড়ানো প্রয়োজন।
জরিপে অংশ নেয়া ব্যাংক কর্মকর্তাদের অধিকাংশই গ্রাহকদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন। কর্মকর্তাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশের মতে, পার্সোনালাইজেশন-এর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। আবার, জরিপে অংশ নেয়া ৮৩ শতাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, ডিজিটাল এই যুগে সব ব্যাংকেরই উচিৎ তাদের গ্রাহকদেরকে পার্টনার হিসেবে বিবেচনা করা।
অ্যাকসেনচার-এর সিনিয়র ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যালান ম্যাকইন্টায়ার-এর মতে, সফলভাবে পার্সোনালাইজেশন-এর জন্যে ব্যাংকগুলির দুটি কাজ করা উচিৎ।
এক, গ্রাহকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যই তাদেরকে জানানোর মাধ্যমে প্রোডাক্ট বাছাইয়ে সাহায্য করা। এবং দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেয়া শর্তের মধ্যে থেকেই গ্রাহকদের নিজেদের প্রোডাক্ট কাস্টোমাইজ করার সুযোগ খোলা রাখা।
#২. ব্যাংকিং খাতে মানুষ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এর একযোগে কাজ করার সম্ভাবনা
সম্প্রতি অনেক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানই তাদের বিভিন্ন কাজ সহজে করার জন্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ক্রেডিট রিস্ক মডেলিং, গ্রাহদের সাথে যোগাযোগের জন্যে চ্যাটবট কিংবা জালিয়াতি শনাক্তকরণের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির সাথে মানুষের কাজের সমন্বয় আনার ব্যাপারে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছেন। পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তিকে সম্ভাবনা হিসেবেই দেখছেন তারা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৭ শতাংশ কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যেই তাদের প্রতিষ্ঠানে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করা হচ্ছে। ২৯ শতাংশ জানান, আগামি এক বছরের মধ্যেই তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে এআই প্রযুক্তি কাজে লাগাবেন।
#৩. গ্রাহকদের অভিজ্ঞতায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ
ব্যাংক অফ আমেরিকার একজন কার্যনির্বাহী সদস্যের মতে, ২০২০ সালে মাত্র ৮ মাসের মধ্যেই ব্যাংকটি তাদের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে ৮০০টিরও বেশি পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলিও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। জরিপে অংশ নেয়া ৭৭ শতাংশ কর্মকর্তা জানান, ডিজিটাল প্লাটফর্মে তারা যেসব প্রোডাক্ট বা সেবা দিয়ে থাকেন, আগামি ৩ বছরের মধ্যেই সেগুলি উল্লেখযোগ্য হারে আপডেট করা হবে। এবং ৭১ শতাংশের মতে, নতুন নতুন সফটওয়্যার আপডেট নিয়ে এলে তাদের গ্রাহকরা কোনো ধরনের অভিযোগ করেন না। বরং অনেকে আপডেটকে ইতিবাচক হিসেবেই ধরে নেন।
# ৪. সবসময়ই নতুন নতুন উদ্ভাবন সামনে নিয়ে আসা
নতুন সব আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনই একটা সময় পুরাতন হয়ে যায়। তাই মহামারির ফলে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যেই গতিতে উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের প্রচলন শুরু হয়েছে, সেটা ধরে রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবেদন অনুসারে, এই প্রচলন ধরে রাখার জন্যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, ক্লাউড-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন তৈরির দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ৪টি প্রযুক্তি পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। এই ৪টি প্রযুক্তিকে একসাথে DARQ বলা হয়। ডিসট্রিবিউটেড লেজার, এআই, এক্সটেন্ডেড রিয়ালিটি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি একসাথে বোঝানোর জন্যে DARQ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
আলোচিত ৪টি ট্রেন্ডই মহামারি পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করবে। এগুলির মধ্যে কোন ট্রেন্ডটি এদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখবে বলে আপনার ধারণা?
#ব্যাংকিং #করোনা #ট্রেন্ড