31/07/2022
প্রবন্ধ
নারী ও নারীমুক্তি প্রসঙ্গে
মাধবী
মেয়েরা ঠিক মানুষ নয় ; মেয়েমানুষ , আধখানা মানুষ । আজ সমাজবিজ্ঞানের আশীর্বাদে আমরা জানতে পারি মেহনতই মানুষকে মানুষ করেছে । সেই মেহনতের মাধ্যমে মানুষ হয়ে ওঠার ঘটনাটি নারী - পুরুষ নির্বিশেষেরই । অথচ সমাজবিকাশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে ঐতিহাসিক সামাজিক স্তরগুলোতে এই মেয়েদের মধ্যে সামাজিক মেহনতের মর্যাদা । নেই । আর তা নেই বলেই তার নেই মানুষের মর্যাদাও । সমকালীন পুঁজিবাদী বিশ্বে নারীর অনেক অধিকারই স্বীকৃত হয়েছে , এমনকী দাপ্তরিক নেতৃত্বেও আজ দেখা যায় তাঁকে । কিন্তু নারী কি পেয়েছে মানুষের মর্যাদা বা হয়ে উঠতে পেরেছে মানুষ , অথবা সেই নেতৃত্ব কি পেরেছে নারী মুক্তির পথ প্রশন্ত করতে ? এর উত্তর না , না এবং না !
পুরুষ পুরুষ নারীকে নানা শব্দে শনাক্ত করেছে , সংজ্ঞা রচনা করেছে , ব্যাখ্যা করেছে , অবস্থান নির্দেশ করেছে , বিধি প্রণয়ন করেছে এবং নিযুক্ত করেছে কামসঙ্গী ও পরিচারিকার পদে । সব সময় নির্দেশ করে মানুষের সদ্গুণগুলো আর নারী নির্দেশ করে । নঞর্থকগুলো ! আসলে পুরুষের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব রক্ষার্থে যে সামাজিক বিধি - ব্যবস্থা যাকে আমরা সবাই পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র বলে অভিহিত করি ; সেই পুরুষতন্ত্রের খোলসটা অবমুক্ত করলেই হয়তো আমরা পেতে পারি নারীমুক্তির এক ঐতিহাসিক সমাধান । কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে গেলেও পুরুষতন্ত্রের মুখোশটিকে মোকাবেলা করেই আমাদের এগুতে হবে ।
পুরুষতন্ত্র স্বীকার করেনি নারী যে মানুষ । কারণ নাকি নারীরা পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট । ধর্মের নামে দর্শন - সাহিত্যের নামে উৎকল্পিত মিথ্যা বানোয়াট ইতিহাসের দোহাই পেড়ে এই অদ্ভূত - উদ্ভট সিদ্ধান্তও টেনে ছিলো পুরুষতন্ত্রই । এইতো সদ্যগত বিংশ শতকের কথা , তখনও নাগরিক জীবনে নারীকে শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বলা হয়েছে নারী অশিক্ষিত , তাকে বিজ্ঞান থেকে বাইরে রেখে বলা হয়েছে নারী বিজ্ঞানের অনুপযুক্ত , তাকে শাসনকার্য থেকে নির্বাসিত করে রেখে বলা হয়েছে নারী শাসনের যোগ্যতাহীন ! আমাদের গ্রাম - বাংলায় এ চিত্র আজও বর্তমান । কিন্তু নারীর কি কোন সহজাত অযোগ্যতা আছে ? বিজ্ঞান বলে না । পুরুষের মতো নারীও প্রকৃতির অংশ , প্রকৃতিই । প্রকৃতির অংশ হিসাবে পুরুষেরও যেমন সীমাবদ্ধতা আছে এবং আছে সীমা অতিক্রমের চেষ্টা ; নারীর বেলাতেও সেই একই কথা । মানুষের সমস্ত অযোগ্যতাই পরিবেশ ও পরিস্থিতিগত । কিন্তু নারীর বেলায় মানুষভিন্ন অতিরিক্ত যা অযোগ্যতা - সীমাবদ্ধতা , বস্তুতঃ তা পুরুষতন্ত্রের সৃষ্ট সুপরিকল্পিত এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ।
একথা কি আমরা জানি নারী ও পুরুষ , নারী বা পুরুষ হয়ে জন্ম নেয়না ? সামাজিকরণ প্রক্রিয়া তাদেরকে নারী ও পুরুষ করে তোলে ? সুপরিকল্পিত নানান সামাজিক আয়োজনের মধ্যে দিয়ে জন্মানোর মূহুর্ত থেকে নারী ও পুরুষকে করে তোলা হয় দুই মেরু ও সংস্কৃতির অধিবাসী । পুরুষতন্ত্রের জৈবিক ভিত্তি দুর্বল , তাই নারীকে নারী ও পুরুষকে পুরুষ করে তোলার জন্য চলে ধারাবাহিকভাবে ঐতিহ্য ও প্রথার আবডালে সামাজিকরণ প্রক্রিয়া । পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয় , অন্তর্মুখী বা আত্মসমর্পণাত্মক । বলা হয় পুরুষতন্ত্র সৃষ্টি করেছে নানা রকম সংস্থা তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে পরিবার । পরিবার কাজ করে বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধি রূপে । পরিবার তার সদস্যদের খাপ খাওয়ায় পিতৃতন্ত্রের আদর্শের সাথে । পরিবার অনেকটা পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র । আর পরিবার - রাষ্ট্রের পতি হচ্ছে পরিবারের প্রধান পুরুষটি । যাকে ব্যাকরণের ভাষায় ' কর্তা ' বলে সম্মোধন করা হয় , এর অর্থ পুরুষতন্ত্র ব্যাকরণেও । অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ব্যাপকতা এতো বিস্তৃত ও গভীর যে বিদ্যমান রাষ্ট্র সামাজিক জীবনের পদে পদে তার দাম্ভিক উপস্থিতি । তাই পরিবার নামক রাষ্ট্র , পরিবারের কর্তা - পুরুষটির মাধ্যমে শাসন করে নাগরিকদের তথা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের । তবে এর মধ্যেও পার্থক্য আছে । পরিবারের স্ত্রী বা মাতা বা কন্যা নামক নারীরা হচ্ছে এখানে দাসী । বস্তুত যাদের কোন অধিকারই স্বীকৃত নয় । আর ছেলে সন্তানরা হচ্ছে জনগণের সেই অংশ যারা মালিককে খুশি রাখতে পারলে কখনও সখনও পুরস্কৃত হন , না পারলে তিরস্কৃত , আর বিরাগভাজন হলে বহিঃস্কৃত । এই প্রাত্যহিক বাস্তব অভিজ্ঞতাতেও প্রমাণিত যে , এ শাসনের প্রধান শিকার নারী ।
পিতৃতন্ত্রের তিনটি সংস্থা পরিবার , সমাজ ও রাষ্ট্র একে অন্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত ও পরস্পর নির্ভরশীল । যে সমাজে মানুষের অবস্থান বা মর্যাদা নির্ভর করে রাষ্ট্রিক ( রাজনৈতিক ) , সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি তথা পরিস্থিতির উপর সেখানে কিছু নারী কিছু পুরুষের ওপর মর্যাদা পায় , আর এ কারনেই ঘোলাটে হয়ে ওঠে সমগ্র ব্যাপারটি । যে অঞ্চলে পিতৃতন্ত্র যত উগ্র সেখানে নারীদের অবস্থান ততো নীচে ও ততো স্পষ্ট , মূক পশুর মতো । বস্তুতঃ এই স্পষ্টতা হল সমাজের শ্রেণী বিভক্তির ও শ্রেণী দ্বন্দ্বের স্পষ্টতা , অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র নামে যাকে আমরা জানছি প্রকৃতার্থে তা হল শ্রেণীসমাজের এক জ্বলন্ত বৈশিষ্ট্য । শ্রেণী সমাজের কাছে নারীজাতির পবিত্রতা রক্ষার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর । কারণ শ্রেণীসমাজের ভিত্তিই হলো সমাজিক সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা , অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি । আর তাই এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা তথা সুরক্ষার্থে নির্ভূল উত্তরাধিকারী নির্ণয় করা শ্রেণীসমাজের একটি বড় মাথাব্যাথা । পূর্বেই উল্লেখ করেছি ‘ পুরুষতন্ত্রের জৈবিক ভিত্তি দুর্বল ' , অর্থাৎ তার উত্তরাধিকার নিশ্চিত করণের ব্যাপারটি মূলত নারীর ওপরই নির্ভরশীল , এখানে পুরুষতন্ত্র যথেষ্ট অসহায় । এই কারণে শ্রেণীসমাজে নারীর জীবনের উপর অতি সতর্ক নিষেধাজ্ঞা এবং স্বাভাবিক সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা থেকে নারী জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার এতো আয়োজন । জঘণ্য ধরনের সব অবরোধ | প্রথা নারীজাতির ওপর চাপিয়ে রাখা হয়েছে যুগ যুগ ধরে , আর এই চক্রান্তমূলক ঘটনাগুলোই নারীদের উন্নতির অন্তরায় । নারীকে পুরুষের বাধ্যতামূলক ক্রীতদাসী করার একটি কৌশলের নাম হচ্ছে প্রচলিত বিবাহ । যার কবলে পড়ে নারী হারায় তার অস্তিত্ব ও অধিকার । পিতৃতান্ত্রিক আইনে বিয়ে হচ্ছে নারীবলি , শরিয়তেও তাই । সব ধর্মে নারী অশুভ্র , দূষিত , কামদানবী । নারীর কাজ নিষ্পাপ স্বর্গীয় পুরুষদের পাপবিদ্ধ করা এবং সব | ধর্মে নারী অসম্পূর্ণ মানুষ । গাজ্জালি বলেছেন - " হাওয়া নিষিদ্ধ ফল খেয়েছে বলে আল্লা তাকে ১৮ রকমের শাস্তি দিয়েছে । ঋতুস্রাব , গর্ভধারণ , নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন , অচেনা পুরুষের সাথে বিয়ে , বাড়িতে বন্দীজীবন কাটানো ..... " প্রভৃতি ।
অর্থনৈতিকভাবে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুরুষতন্ত্র তথা শ্রেণীসমাজ সমস্ত অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব রেখেছে নিজেদের হাতে । অর্থ - সম্পদের ওপরই যেখানে নির্ভর করে সম্মান ও স্বাধীনতা মূলত সেখানে এর অভাবের পরিণতি মারাত্মক । তারও শিকার নারী । নারীদের অধীনতার অনেকগুলো শর্তের একটি শর্ত আর্থিক পরনির্ভরতা । শ্রেণীসমাজে অর্থ - সম্পদের অভাবে তারা পরাশ্রিত । আর যেখানে নারীর হাতে আর্থিক কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব এসে পড়ে সেখানে নারীর কাজ হয়ে দাঁড়ায় পুরুষের অবর্তমানে পুরুষতন্ত্রের দায়িত্বপালন । অর্থাৎ এখানে তার ভূমিকা লিঙ্গগতভাবে নারী হলেও পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে পুরুষেরই । নারীরা যদি কোন পেশায় নিযুক্ত হয় তবে বেতন পায় পুরুষের থেকে কম । উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন নারীরাও কম যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষদের থেকে কম বেতন পায় । নারীরা যেমন বিনা বেতনে পরিবারের সেবা করে , তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজও মনে করে । যে নারীর চাকুরি হচ্ছে সেবা ; যেন টাকার কোন দরকার নেই তাদের । নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে দেখা হয় কুটিল সন্দেহের চোখে । তাই কোথাওবা নারী দৃশ্যত হলেও দেখা যায় শেষ পর্যন্ত নারীর অর্জিত সেই অর্থটিও পরিবারের পুরুষটির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত এবং পুরুষতন্ত্রের সেবায় নিয়োজিত । বাংলার প্রথম উচ্চ শিক্ষিত নারীরা পিতা বা স্বামীর পরিবারের বাঁধায় বা সামাজিক নিন্দায় পেশা গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন বা পেশা গ্রহণে বিলম্ব করেছেন । অনেকে বিয়ের পর বিয়েকেই পেশারূপে গণ্য করে আর্থিক চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন । পেশাজীবী নারীরা আসলে দুটি পেশায় নিযুক্ত থাকেন ; তাদের ঘরসংসার দেখতে ও সন্তান পালন করতে হয় , আর পালন করতে হয় পেশার দায়িত্ব । পেশাকে তারা পুরোপুরি পেশা হিসাবে নিতে পারেন না , পরিবারই তাদের মূল পেশা । পৃথিবী জুড়ে নারীরা যে সব পেশায় এখন নিযুক্ত তা প্রধানতঃ শ্রমিকের পেশা , তাই তাদের নির্দেশ করা হয় সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রধান সর্বহারা শ্রেণীরূপে ।
পিতৃতন্ত্র শুধু নারীর বাইরের জগতটিকে নিয়ন্ত্রণ করেনি , নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মনোজগতও । সমাজনীতি , বিবাহরীতি এবং পুরুষের আর্থিক প্রভুত্ব নারীর মনকে মারাত্মকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে । এই প্রক্রিয়ায় নারীরা বিকাশমান মানবিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হয়ে , হয়ে ওঠে ভাগ্যবাদী জীব বিশেষ , যা মূলত তাকে কৃতদাসী , যৌনসামগ্রী ও অস্থাবর সম্পত্তিতে পর্যবসিত করে । ফলে তার থাকে না কোন অর্থনৈতিক , মানবিক ও যৌন স্বাধীনতা । পুরুষতান্ত্রিসমাজ তাকে চির শিশু করে রাখে এবং নির্ভর করতে বাধ্য করে পুরুষের ওপর । এতো পীড়নের ফলে নারীর স্বভাবে এমন লক্ষণ দেখা দেয় যা বস্তুত সংখ্যালঘুদের বৈশিষ্ট্য । পিতৃতন্ত্রে নারীরা নাগরিক অধিকার পায়না , যেখানে পায় সেখানে থাকে প্রান্তিক নাগরিক হিসাবে । তাদের মানসিকতা হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানসিকতা । তারা নিজেদের নারী প্রকৃতিকে অস্বীকার ও নিজেদের শ্রেণী অবস্থানকে অবজ্ঞা করে । নারীদের অনেকেই পুরুষ হতে চায় , কেননা নারী হিসাবে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই অনিশ্চয়তায় ভোগে । তারা লুকিয়ে রাখে নিজেদের অনুভূতি যা পছন্দ করে পুরুষেরা , তাই তারা শাণিত নারীর থেকে নির্বোধ নারীকে বেশী পছন্দ করে - ' রমণীয় ' বলে প্রশংসা করে । অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতো নারীদের এক - আধজনকে অন্যদের থেকে উচ্চ পদমর্যাদা দেয়া হয় ; যারা কাজ করে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে , আর বিরাজ করে বস্তুতঃ পুরুষের যৌন সামগ্রীরূপে এবং প্রভৃদের চিত্তবিনোদনের উপকরণ হিসাবে , আর একেই তারা মনে করে গৌরবের কাজ । অথচ শ্রেণীসমাজের সমগ্র কালজুড়ে যে নির্মম সত্যটি ইতিহাসের পাতায় পাতায় বিবৃত হয়েছে তাহলো- পুরুষতন্ত্রের প্রিয় নারী মাত্রই পুরুষতন্ত্রের রক্ষিতা । তারা পুরুষতন্ত্রকে গ্রহণযোগ্য করার সাধনা করে তাদের সমস্ত সাধনায় ।
সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা ও নারীর অধীনতার ভিত্তির উপরই স্থাপিত আজকের এই শ্রেণীবিভক্ত সমাজ তথা পুরুষ বা পিতৃতন্ত্র । এই পিতৃতন্ত্র ও পরিবার দাঁড়িয়ে আছে শোষণের ওপর । পিতৃতন্ত্রের আবডালে নারী শোষণের মহত্তম যন্ত্রটির আধুনিক নাম রাষ্ট্র । সামাজিক সম্পদের ব্যক্তিগত অধিকার , নারী অধীনতা ও দাস - মালিক প্রথার পত্তনের মাধ্যমে সমাজ ভাগ হয়ে যায় নানা শ্রেণী ও বর্ণে , দেখা দেয় সামাজিক সম্পদের একচেটিয়া মালিকানার ভিত্তিতে একচেটিয়া শাসকরূপী একটা বিশেষ শ্রেণীর এবং তার বিপরীত । শুরু হয় সম্পদের অসম বণ্টন এবং শেষে শোষণের নির্মম বিকট যন্ত্ররূপে দেখা দেয় রাষ্ট্র ।
আদিম সাম্যের অবস্থা ভেঙ্গে গিয়ে দেখা দেয় শ্রেণীসমাজের । বর্বর অবস্থার শেষাশেষিই মানব সমাজের উপর ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রভাবটা প্রকট হয়ে পড়ে । ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলেছেন- " ইতিহাসে যখন প্রথম শ্রেণী সংঘাত দেখা দিল তখন তার পাশাপাশি দেখা দিল একবিবাহের মাধ্যমে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সংঘাত , প্রথম শ্রেণীশোষণের পাশাপাশি দেখা দিল নারীর ওপর পুরুষের দাপট । ঐতিহাসিক ভাবে একবিবাহ এক বিরাট অগ্রগতি , সন্দেহ নাই , কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে , এই একবিবাহই দাসপ্রথা ও ব্যক্তিগত ঐশ্বর্যের পাশাপাশি এক নতুন যুগ এনেছে , আজ পর্যন্ত চলছে সেই যুগের জের " ।
শ্রেণীসমাজ দেখা দেবার পর থেকে সামাজিক মেহনতে- ' নারী - পুরুষ সমানে সমান'- এই সহজ সাম্য ভেঙে গেল , আর দিনের পর দিন নারীরা বঞ্চিত হতে থাকল সামাজিকভাবে মেহনতের মর্যাদা থেকে । উৎপাদন বা আর্থ - সামাজিক কর্মকাণ্ডে যার অংশ নেই , দূরাবস্থা তার কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না কার্ল মার্কস বলেছেন “ পরিবারের মধ্যে স্বামী হচ্ছে বুর্জোয়া , স্ত্রী প্রলেতারিয়েত ” । কারণ বিত্তবান শ্রেণীগুলোতে পুরুষ উপার্জন করে , নারী কোন কিছু উপার্জন করেনা , তাকে এমনভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয়েছে যাতে সে হয়ে উঠেছে আপাদমস্তক অপদার্থ । মানুষের হাতে পায়ে শিকল পরানো সহজ , কঠিন হচ্ছে শেকল মুক্ত করা । বুর্জোয়া নারীরা কারুকার্য খচিত শেকলকেই বরণ করে নিয়েছে , কারণ মুক্তির চেয়ে শেকলই সুবিধাজনক মনে হয়েছে তাদের । কিন্তু বাস্তবে তারা স্বাধীনতা হারিয়ে উপভোগ্য দাসী হয়ে উঠেছে । এঙ্গেলস বলেছেন- “ দাসপ্রথা ও ব্যক্তিগত সম্পদসহ তা এমন এক যুগের পত্তন করে যা আজও পর্যন্ত চলছে এবং যাতে প্রত্যেকটি অগ্রগতিই হচ্ছে সেই সঙ্গে একটা আপেক্ষিক পশ্চাদগতি , যেখানে জনসমষ্টির একাংশের সচ্ছলতা ও উন্নতি হয় অপর এক অংশের দুঃখ ও পীড়নের মধ্যে দিয়ে । একপতিপত্নী বিবাহ হচ্ছে সভ্য সমাজের কোষ , এখানে আমরা সেই সব বৈরিতা ও বিরোধের প্রকৃতি লক্ষ্য করতে পারি যেগুলি শেষোক্তের মধ্যে পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে । অর্থনৈতিক শোষণের ওপর দাঁড়ানো একপতিপত্নী বিয়ে ও পরিবার । ... এই প্রথা লোপ না পেয়ে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেই । সমাজে সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে নারী- এটাই তাদের মুক্তির প্রথম শর্ত এবং সমাজে উৎপাদনের উপায়গুলো হবে সমাজের সম্পত্তি , সেখানে কেউ সুবিধাভোগী কেউ সর্বহারা হবে না । তাই নারী হবে স্বাধীন , সেখানে পতিতা থাকবেনা কেউ এবং একপতিপত্নী প্রথা সত্য হয়ে উঠবে পুরুষ - নারী উভয়ের জন্য " । বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীর উপর পুরুষের শোষণ এবং সার্বিক শোষণ তথা শ্রেণীশোষণ দূর করা সম্ভব নয় । কারণ যতদিন না- এঙ্গেলসের ভাষায়- “ ব্যক্তিগত গৃহস্থালি পরিণত হবে । সামাজিক শিল্পে । শিশুপালন ও শিক্ষা হবে সামাজিক ব্যাপার , বিয়ে বা বিয়ের বাইরে যেভাবেই জন্ম হোক শিশুর পুরো সমাজ নেবে তার দায়িত্ব , সে হবে সমাজের সন্তান " - ততোদিন পর্যন্ত এটা থাকবে আকাঙ্খা , পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা রূপে । নারীর মুক্তির জন্য দরকার বড়ো ধরনের সামাজিক বিপ্লব , যতদিন সেই বিপ্লব না ঘটে ততোদিন নারী থাকবে পুরুষের অধীন , থাকবে দাসী ও যৌনসামগ্রী হিসাবে ।
পুরুষতন্ত্রের মুখোশধারী বা খোলসযুক্ত সামাজিক বিধি - ব্যবস্থাকে ব্যবচ্ছেদ করলে যে নিঠুর শ্রেণীসমাজের স্বরূপ আমরা দেখতে পাই ; আজকের নারীমুক্তির সংগ্রামকে সত্যিকার অর্থে তাঁর কাঙ্খিত আত্মমুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে তাকে তাঁর প্রধান লড়াইটি চালাতে হবে এই শ্রেণীসমাজের বিরুদ্ধে । কারণ ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পেয়েছি এই শ্রেণী সমাজই তার শ্রেণী স্বার্থে পুরুষতন্ত্রের মুখোশের আবডালে লুকাতে চেয়েছে সেই সত্য যা নারীসহ অন্যান্য সকল সমস্যার সমাধানের প্রধান অন্তরায় অর্থাৎ সামাজিক সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাকে । শুরুতে যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলাম সেটা বস্তুত এই ব্যক্তিগত মালিকানাবাদী ব্যবস্থা রক্ষার্থে উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ সামাজিক সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার দাবীদার সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র , যা আজও বিদ্যমান । তাই আজকের নারীমুক্তি আন্দোলন তা যে নামে বা রূপে কার্যকর থাকুক না কেন , আজ তা যদি সমাজ বিপ্লবের স্তরের সীমাবদ্ধতানুসারে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণীসংগ্রামকে শ্রেণীযুদ্ধে উত্তরণ ঘটিয়ে শোষিতের শ্রেণীরাজ কায়েমের শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী রাজনীতির সাথে অঙ্গিভূত না হয় , শুধুমাত্র দাবী - দাওয়ার আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখে , তাহলে তা যে অনিবার্যভাবে পুরুষতন্ত্ররূপী এই শ্রেণীসমাজের স্বার্থকেই রক্ষা করবে এটা সহজে অনুমেয় । সুতরাং সত্যিকার অর্থেই যারা নারীমুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ও সংগঠন গড়ে তুলছেন , তাদেরকে অতি অবশ্যই একদিকে শ্রমিকশ্রেণীর বৈজ্ঞানিক মতাদর্শের সাথে তথা মার্কসবাদ - লেনিনবাদ - মাওবাদ'র নিজেদের গভীরভাবে পরিচিত করে তুলতে হবে , তেমনি সমগ্রের অংশ হিসাবে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি পরিচালিত সমাজ বদলের বিপ্লবী যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত হতে হবে । নচেৎ নারীমুক্তির সে আন্দোলন হয়ে উঠবে দ্বিচারিতা মাত্র , যা মূলত হবে ও হচ্ছে নারীমুক্তির নামে পুরুষতন্ত্রেরই আরেক ষড়যন্ত্র - চক্রান্তেরই নামান্তর ।।
____________
ল্যাম্পপোস্ট ৭