09/10/2023
জায়েদ জানো, তুমি কাকে বিয়ে করেছো?...তুমি যাকে বিয়ে করেছো তিনি আমার মা!
এই গল্পটি আমাকে বারবার কাঁদিয়েছে।
নবিজী সা. এর পিতা আব্দুল্লাহ।
একদিন মক্কার বাজারে গেলেন কিছু কেনা-কাটা করার জন্য ।
এক জায়গায় তিনি দেখলেন,
এক লোক নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে
কিছু দাস-দাসী বিক্রি করছে ।
আব্দুল্লাহ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
দাস-দাসীদের কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলেন
নয় বছরের একটি কালো আবিসিনিয়ার মেয়ে ।
তাকে দেখে আব্দুল্লাহর অনেক মায়া হলো
মেয়েতি একটু রুগ্ন, হালকা-পাতলা গড়নের,
কিন্তু কেমন যেন মায়াবী ও অসহায় দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে ।
আব্দুল্লাহ সদ্য বিবাহিত।
ঘরে স্ত্রী আমেন্স একাক্যী থাকেন।
ভাবলেন, স্ত্রীর একজন সঙ্গী দরকার।
এই ভেবে তিনি মেয়েটাকে কিনে নিলেন ।
মেয়েটিকে আব্দুল্লাহ ও আমেনা অনেক ভালোবাসতেন ।
খুব আদর স্নেহ করতেন ।
তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন যে,
তারা তাদের সংসারে
আগের চেয়ে অনেক বেশি বারাকাহ পাচ্ছেন।
তাই তারা আদর করে মেয়েটিকে নাম দিলেন "বারাকাহ"।
এই গল্প, বারাকাহ এর গল্প ।
তারপর একদিন আব্দুল্লাহ,
ব্যবসার কারণে সিরিয়া রওনা দিলেন ।
আমেনার সাথে সেটাই ছিল উনার শেষ বিদায় ।
এর দুই/এক দিন পর আমেনা স্বপ্নে দেখলেন,
আকাশের আলোকোজ্জ্বল একটি তারা
যেন তার কোলে এসে পড়লো ।
তিনি বারাকাকে স্বপ্নের কথা বললেন।
উত্তরে বারাকা মৃদু হেসে বললেন,
"আমার মন বলছে আপনার একটা সুন্দর সন্তান হবে"।
আমেনা তখনও জানতেন না,
তিনি গর্ভধারণ করেছেন।
কিছুদিন পর বুঝতে পারলেন,
বারাকার ধারণাই সত্যি ।
আব্দুল্লাহ আর ফিরে আসেন নি,
সিরিয়ার পথেই মৃত্যুবরণ করেছেন ।
আমেনার সেই বিরহ ও কষ্টের সময়ে,
বারাকাহ ছিলেন তার একমাত্র কাছের সঙ্গী ।
একসময় আমেনার অপেক্ষা শেষ হয়,
এবং তিনি জন্ম দিলেন শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে ।
সর্বপ্রথম প্রিয় নবীকে দেখার ও
স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছিল
সেই আফ্রিকান ক্রিতদাসী ছোট কালো মেয়েটির।
নিজ হাতে তিনি শিশু মুহাম্মাদকে
আমেনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন,
আর আনন্দে ও খুশিতে বলেছিলেন,
‘আমি কল্পনায় ভেবেছিলাম তিনি হবেন চাঁদের মত,
কিন্তু এখন দেখছি, তিনি চাঁদের চেয়েও সুন্দর’।
এই সেই বারাকাহ ।
নবীজির জন্মের সময় উনার বয়স ছিল তের বছর ।
নবীজীর ছোটবেলায় তিনি আমেনার সাথে
তাঁর যত্ন নিয়েছেন,
গোসল দিয়েছেন, খাওয়াতে সাহায্য করেছেন,
আদর করে ঘুম পাড়িয়েছেন।
আমেনার মৃত্যূর সময় তিনি বারাকাহ এর হাত ধরে
অনুরোধ করেছিলেন,
তিনি যেন তাঁর সন্তানকে দেখে শুনে রাখেন ।
বারাকাহ জীবনভর তাই করেছিলেন ।
বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে ইয়াতিম
মুহাম্মাদ (সা.) চলে আসলেন
দাদা আবদুল মোত্তালিবের তত্বাবধানে।
এবার উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি হলেন
বারাকার নতুন মনিব ।
কিন্তু তিনি একদিন বারাকাকে মুক্ত করে দিলেন,
বললেন,
‘আপনি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারেন,
আপনি স্বাধীন ও মুক্ত’।
বারাকাহ শিশু মুহাম্মাদকে (সা.)
ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না।
রয়ে গেলেন, মায়ের ছায়া হয়ে পাশে থেকে গেলেন।
এমনকি নবীজির দাদা উনাকে বিয়ে দেয়ার জন্য
বেশ কয়েকবার চেষ্টাও করেছিলেন,
কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না।
উনার কথা ছিল,
'আমি আমেনাকে কথা দিয়েছি,
আমি কোথাও যাবো না’।
একদিন খাদিজা (রা.) এর সাথে নবীজির বিয়ে হলো।
বিয়ের দিন নবীজি (সা.) খাদিজা (রা.) এর সাথে
বারাকাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন,
বললেন, ‘উনি হলেন আমার মায়ের পর আরেক মা’।
বিয়ের পর রাসূল (সা.) একদিন বারাকাহ-কে ডেকে বললেন,
‘উম্মি ! আমাকে দেখাশুনা করার জন্য এখন খাদিজা আছেন,
আপনাকে এখন বিয়ে করতেই হবে’।
(নবীজি উনাকে উম্মি ডাকতেন, নাম ধরে ডাকতেন না)।
তারপর রাসূল (সা.) ও খাদিজা (রা.) মিলে তাকে
উবাইদ ইবনে জায়েদের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
কিছুদিন পর বারাকাহ এর একজন ছেলে হলো,
নাম রাখলেন আইমান ।
এরপর থেকে বারাকাহ নতুন নামে পরিচিত হলেন,
‘উম্মে আইমান’।
একদিন বারাকাহ স্বামী উবাইদ মৃত্যু বরণ করেন।
নবীজি গিয়ে আইমান ও বারাকাহ-কে সাথে করে
নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন এবং সেখানেই থাকতে দিলেন ।
কিছুদিন পর নবীজি(সা.) বেশ কয়েকজন সাহাবীকে ডেকে বললেন,
‘আমি একজন নারীকে জানি, যার কোন সম্পদ নেই,
তিনি বয়স্ক এবং সাথে একটা ইয়াতিম সন্তান আছে,
কিন্তু তিনি জান্নাতি।
তোমাদের মধ্যে কেউ কি
একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চাও?’
এইকথা শুনে জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)
নবীজির কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন ।
নবীজি (সা.)উম্মে আইমানের সাথে কথা বলে
বিয়ের আয়োজন করলেন ।
বিয়ের দিন রাসূল (সা.) জায়েদকে
বুকে জড়িয়ে আনন্দে ও ভালোবাসায়,
ভেজা চোখে, কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন,
জায়েদ জানো, তুমি কাকে বিয়ে করেছো?
‘হাঁ, উম্মে আইমানকে’, জায়েদ উত্তর করলেন।
নবীজী বললেন, ....
তুমি যাকে বিয়ে করেছো তিনি আমার মা!
সাহাবীরা বলতেন, রাসূল (সা.)-কে
খাওয়া নিয়ে কখনো জোর করা যেত না ।
উনি সেটা পছন্দ করতেন না ।
কিন্তু উম্মে আইমান একমাত্র নারী,
যিনি রাসূল (সা.) কে খাবার দিয়ে
"খাও".." খাও".. বলে তাড়া দিতেন।
আর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন।
নবীজি মৃদু হেসে, চুপ চাপ খেয়ে নিতেন ।
রাসূল (সা.) স্বিয় দুধ মাতা হালিমাকে দেখলে
যেমন করে নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে
তার উপর তাকে বসতে দিতেন,
ঠিক তেমনি মদিনায় হিজরতের পর
দীর্ঘ যাত্রা শেষে উম্মে আইমান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।
নবীজি তাঁর গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে,
উম্মে আইমানের মুখের ঘাম ও ধুলোবালি
নিজ হাতে মুছে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন,
‘উম্মি ! জান্নাতে আপনার এইরকম কোন কষ্ট হবে না’।
নবীজি(সা.) মৃত্যুর আগে সাহাবীদের অনেক কিছুই বলে গিয়েছিলেন।
সেই সব কথার মধ্যে একটা ছিল,
উম্মে আইমানের কথা।
তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা উম্মে আইমানের যত্ন নিবে, তিনি আমার মায়ের মত।
তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমাকে জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছেন,
তিনি আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য,
যিনি সারাজীবন আমার পাশে ছিলেন’।
সাহাবীরা সেই কথা রেখেছিলেন।
গায়ের রং নয়, এক সময়ের কোন ক্রিতদাসী নয়,
তাঁর পরিচয় ছিল, তিনি নবীজীর আরেক মা।
ফলে সাহাবায়ে কিরাম আপন মায়ের মতোই
এই বৃদ্ধা নারীকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন ।
আবু বকর উমার রা. মাঝে মাঝেই তাকে দেখতে যেতেন,
আর তাঁর খোঁজখবর নিতেন।
বিভিন্ন সুত্র