07/04/2024
এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও একটি চমৎকার শখ। আপনিও পেতে পারেন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এ লাইসেন্স। আসুন সংক্ষেপে এ সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
**এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও কি?**
এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও স্টেশন পরিচালনা হলো বিজ্ঞানমনস্ক একটি শখ। একটি বেতারযন্ত্র দিয়ে অন্য একটি বেতারযন্ত্রে নির্দিষ্ট বেতার তরঙ্গে অবাণিজ্যিকভাবে তথ্য আদান প্রদান, গবেষণা, ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং জরুরি অবস্থায় সাহায্য করাই এ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের কাজ। এ্যামেচার রেডিও সাধারণত ব্যবহৃত একটি টেলিযোগাযোগ সার্ভিস। ‘এ্যামেচার’ শব্দটি সাধারণত আর্থিক সংশ্লিষ্টতাবিহীন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহী ব্যবহারকারীকে বাণিজ্যিক ব্রডকাস্টিং, জননিরাপত্তা প্রদানকারী সংস্থা অথবা পেশাদার টু-ওয়ে সার্ভিস হতে পৃথক করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের হ্যামও বলা হয়। মূলত বেতারযন্ত্রের সাহায্যে এ্যামেচার রেডিও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুত্বের হাতছানি। শখের এই রেডিও দিয়ে আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩০ লাখেরও বেশি এ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে বিনা খরচে যোগাযোগ করতে পারবেন। ২০০৪ সালের জরিপ অনুযায়ী আমেরিকায় ৭ লক্ষ, জাপানে ৬ লক্ষ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার, থাইল্যান্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার, কানাডায় ৫৭ হাজার, জার্মানীতে ৭০ হাজার, ইংল্যান্ডে ৬০ হাজার, সুইডেনে ১১ হাজার, নরওয়েতে ৫ হাজার এবং আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ১৬ হাজারেরও বেশি হ্যাম আছে। আমাদের দেশে এ সংখ্যা প্রায় সাত শতাধিক। পাশাপাশি অপারেটররা পাহাড়ের চূড়া, নিজের বাসা অথবা গাড়িতে বসে চাইলে মহাকাশযানের নভোচারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। নভোচারীদের সবাই এ্যামেচার রেডিও অপারেটর। মহাকাশে যাওয়ার সময় তারা সবাই কল-সাইন ব্যবহার করে অন্য এ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিদেশি স্কুবা ডাইভার, নাবিক, প্লেনের পাইলট ও এ্যামেচার রেডিও অপারেটর হয়ে থাকেন।
এ্যামেচার রেডিও কিন্তু শুধু কথা বলার জন্য নয়, এই রেডিও ব্যবহার করে আপনি এ্যামেচার স্যাটেলাইট, এ্যামেচার টেলিভিশন স্লো-স্ক্যান টিভি, ফাস্ট-স্ক্যান টিভি, ডাটা ট্রান্সমিশনের বিভিন্ন মোডের ব্যবহার, মোর্স কোড ও রেডিওকে মডেম হিসেবে ব্যবহার করার মতো আরো অনেক মজার মজার কাজ করতে পারবেন। শখের বিষয় হলেও এখানে জ্ঞানার্জনের সুযোগও আছে। এটি একটি বিজ্ঞানমনস্ক শখ বিধায় ইলেকট্রোনিক্সসহ বেতার তরঙ্গ নিয়ে প্রচুর অধ্যায়নের সুযোগ মেলে।
বিদেশে হ্যামগণ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সাহায্য করে থাকেন। কেউ কেউ এ্যামেচার ফ্রিকোয়েন্সি মনিটর করে সরকারকে সহায়তা করেন। তারা সরকারি বিভিন্ন বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর সাথেও বিভিন্ন কাজ করেন। তারা নোয়া ওয়েদার স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদী দেশব্যাপী প্রচার করেন। এছাড়াও যেকোনো দুর্যোগে কুইক রেসপন্স টিমের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন। নিয়মিত তারা ডিএক্সিং, হ্যামফেস্ট ও হ্যামভেনশন, ফিল্ড ডে ও ফক্স হান্টিং করেন। এদেশেও এই চর্চাগুলো শুরু হয়েছে। দেশের হ্যামরা দুর্যোগের সময় নিজেদের প্রস্তুত রাখতে নিয়মিত মহড়া দেন। স্কাউটদের জোটাতে সহযোগিতা করেন।
হ্যামরা চাঁদের পিঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা রেডিও ওয়েভ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। অভিজ্ঞ হ্যামগণ নিজ হাতে হোমব্রিউ শক্তিশালী অ্যান্টেনা, ট্রান্সমিটার ও রিসিভার বানান। হ্যামদের জন্যই কেবল আলাদা স্যাটেলাইট (অস্কার, অ্যামস্যাট) ও বিদেশে টেলিভিশন (স্লো/ফাস্ট স্ক্যান টিভি) স্টেশন আছে। যা হ্যাম চর্চায় সহায়ক। হ্যামগণ শুধু তাদের গবেষণার জন্যই কিউবস্যাটের মতো ছোট ছোট মাইক্রো স্যাটেলাইট মহাশূন্যে ভাসিয়ে থাকেন। আমাদের দেশে কিছুদিন আগে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাও এমন একটি কিউবস্যাট জাপানের সহযোগিতায় মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছেন।
এছাড়াও এই রেডিওর একটি বড় ব্যবহার আপদকালীন সময়ে। সেসময় একজন হ্যাম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে উদ্ধারকাজেও অংশ নিতে পারবেন। দুর্যোগে প্রচলিত সব যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন-টেলিফোন, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকে। সাধারণত মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক টাওয়ারকেন্দ্রীক। দুর্যোগের সময় এসব টাওয়ার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে মোবাইল ফোনে সিগন্যাল মেলে না। তখন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন একজন এ্যামেচার রেডিও অপারেটর। এ্যামেচার রেডিও বা শৌখিন বেতার যোগাযোগব্যবস্থায় একজন ব্যবহারকারী নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার গ্রাহক ও প্রেরকযন্ত্রের অধিকারী। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বেতারতরঙ্গ ব্যবহার করে নিজের শহর, দেশ, এমনকি পৃথিবীর যেকোনো দেশের ওই ধরনের বেতারযন্ত্র ব্যবহারকারীর সঙ্গে তথ্য বিনিময় করা যায়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিপর্যয় মোকাবিলায় উদ্ধারকাজে সঠিকভাবে বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও। তাই দুর্যোগের সময় রাষ্ট্রের অঘোষিত দূতের ভূমিকা পালন করেন একজন এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও অপারেটর।
বিশ্বের প্রথম এ্যামেচার রেডিও ষ্টেশন পরিচালনা করেছিলেন যে তিনজন তারা ছিলেন Albert S Hyman, Bob Almy এবং Poogie Murray। তারা তাদের ষ্টেশন এর নামকরন করেছিলেন “Hyman-Almy-Murray” বা Hyalmu । কিন্তু ১৯০১ সালে Hyalmo রেডিও ষ্টেশন এবং মেক্সিকান জাহাজ Hyalmo এর প্রেরিত বেতার সংকেত সনাক্তকরনে গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ায় তারা তাদের তিন জনের নামের প্রথম অক্ষরগুলো ব্যবহার করে তাদের ষ্টেশনের নামকরন করনে “HAM”। তাদের সেদিনের উদ্যোগের ফলে বিশ্বব্যাপী এই সার্ভিসটির নামকরন করা হয় “HAM”।
তবে এই রেডিও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না। মূলত শখ মেটাতেই এই রেডিও ব্যবহারের লাইসেন্স পেতে পারেন।
**কিভাবে আপনি একজন লাইসেন্সধারী এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও অপারেটর হবেন?**
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও এ্যামেচার রেডিও বা হ্যাম রেডিও অপারেটর হতে চাইলে আপনাকে ‘অপেশাদার লাইসেন্স’ নিতে হবে একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বাংলাদেশে পরীক্ষা গ্রহণ ও লাইসেন্স দিয়ে থাকে।
বিটিআরসি তার সুবিধামত পরীক্ষার আয়োজন করে। পরীক্ষার সার্কুলার বিটিআরসির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট (http://www.btrc.gov.bd/), বিভিন্ন পত্রিকা এবং সিনিয়র হ্যাম বা বিভিন্ন হ্যাম গ্রুপ থেকে পেয়ে যাবেন। পরীক্ষায় আবেদন ফি ১,৫০০/- টাকা। বিটিআরসি আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই শেষে পরীক্ষার জন্য প্রবেশপত্র ইস্যু করবে। পরীক্ষা হবে ১০০ নম্বরের। পরীক্ষায় নৈর্ব্যক্তিক এবং সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন থাকে। বেসিক ইলেকট্রোনিক্স, ফান্ডামেন্টাল রেডিও ইঞ্জিনিয়ারিং, রেডিও রেগুলেশন, এ্যামেচার রুলস, কোডস ও ব্যবহারিক জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন থাকবে। পরীক্ষা গ্রহণের নির্ধারিত তারিখের প্রায় দুই সপ্তাহ পূর্বে পরীক্ষার প্রশ্নব্যাংক বিটিআরসি’র অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। আগ্রহী পরীক্ষার্থীকে কমপক্ষে ১৮ বছর বয়সী হতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে হবে SSC পাশ। এছাড়াও তাকে এ্যামেচার বেতারযন্ত্র সম্পর্কে কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে।
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একটি সনদ দেবে বিটিআরসি। এরপর কলসাইন চেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বিটিআরসি একটি ডিমান্ড নোট জারি করবে। (পাসপোর্ট থাকলে অনেক সময় ক্লিয়ারেন্সে সুবিধা হয়) যার বিপরীতে ৬,৩২৫/- টাকা (এককালীন কলসাইন চার্জ ও ৩ বছরের লাইসেন্স ফি) জমা দিয়ে কলসাইনের জন্য পুণরায় আবেদন করতে হবে। তখন বিটিআরসি কলসাইন সহ একটি প্রভিশনাল লাইসেন্স ইস্যু করবে। কলসাইন হল একজন অপারেটরের রেডিও নাম/আইডেন্টিটি যা স্বতন্ত্র। যেটি ব্যতিত কোনভাবেই রেডিওতে কমিউনিকেশন করা যায় না।
এ বিষয়ক বিটিআরসির জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত-২০১০) এর ধারা ৫৫ (১) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া বাংলাদেশ ভূখণ্ড বা আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা বা আকাশসীমায় বেতার যোগাযোগের উদ্দেশ্যে কোনো বেতার যন্ত্রপাতি স্থাপন, পরিচালনা বা ব্যবহার করবেন না বা কোনো বেতার যন্ত্রপাতিতে কমিশন বরাদ্দ করা ফ্রিকোয়েন্সি ছাড়া অন্য কোনো ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করবেন না। এ ধরনের কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা যাচ্ছে। অন্যথায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত-২০১০) অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
**কি কি বিষয় জানতে হবে?**
1. Regulatory Matters.
2. Frequencies.
3. Electronics Fundamentals.
4. Measurement Units.
5. Ohm's Law.
6. Resistance.
7. Capacitors, Inductors, Resonance.
8. Safety.
9. Semiconductors.
10. Meters & Measuring.
11. Decibels, Amplification & Attenuation.
12. An Amateur Radio Station.
13. Power Supplies.
14. General Operating Procedures.
15. Q Signals.
16. Antennas.
17. Propagation.
18. Interference & Filtering.
**কিভাবে ও কয়টি লিগ্যাল ডিভাইস নেয়া যাবে?**
কলসাইন পাওয়ার পর বেতার যন্ত্র বা রেডিও সেট আমদানির জন্য এনওসি (ছাড়পত্র) দেয় বিটিআরসি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স নিয়েই বিটিআরসি এই এনওসি (ছাড়পত্র) প্রদান করে। ওই এনওসি (ছাড়পত্র) দিয়ে বিটিআরসি অনুমোদিত ভেন্ডরের মাধ্যমে বা নিজে নিজেই রেডিও সেট আমদানি করা যাবে। এছাড়াও বিটিআরসির অনুমতি নিয়ে রেডিও সেট নিজেই তৈরি করেও ব্যবহার করা যায়। তবে সর্বক্ষেত্রেই আপনাকে মাথায় রাখতে হবে রেডিও সেটটি যেনো হ্যাম ব্যান্ডের বা বাংলাদেশের ন্যাশনাল ফ্রিকোয়েন্সি অ্যালোকেশন প্লান(এনএফএপি) অনুযায়ী হয়।
একজন এ্যামেচার রেডিও অপারেটরকে বিটিআরসি তিন ধরনের রেডিও সেট ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এগুলো হলো-
১) ১টি ৫ ওয়াটের ভিএইচএফ, ইউএইচএফ রেডিও। যেটাকে অন্যরা বলেন ওয়াকিটকি, হ্যামরা বলেন হ্যান্ডি।
২) ১টি ২৫ ওয়াটের ভিএইচএফ, ইউএইচএফ রেডিও। যেটাকে হ্যামরা বলেন বেজ রেডিও।
৩) ১টি ১০০ ওয়াটের এইচএফ রেডিও।
রেডিও সেট হাতে পাওয়ার পর ডিভাইসের ছবি এবং ব্যাক প্লেটের সিরিয়াল নম্বরের ছবি তুলে বিটিআরসিতে আরেকটি আবেদন করতে হবে। এই আবেদনটি হবে আপনার লাইসেন্সে রেডিও সেটের তথ্য লিখে দেবার জন্য। পরিশেষে বিটিআরসি আপনার এ্যামেচার রেডিও অপারেটরের প্রভিশনাল লাইসেন্সটি ফেরত নিয়ে আপনাকে ‘এ্যামেচার রেডিও অপারেটর লাইসেন্স’ দেবে। যেটাতে আপনার রেডিও সেটের তথ্য উল্লেখ থাকবে।
এরপর এ্যামেচার রেডিওর নিয়ম-নীতি মেনে এ্যামেচার রেডিও চর্চা করতে হবে।
[দ্র: নিজের চিন্তার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকা থেকেও অনেক তথ্য সংগ্রহ করা।
Photo courtesy: Internet]
কিছু প্রয়োজনীয় স্টাডি ম্যাটেরিয়াল- https://drive.google.com/drive/folders/1odXiaTcqqgMN4T0IF1mZUDZYh2_emzk5?usp=sharing