29/01/2025
এক ধরনের অসহায়ত্ব আছে। তা হলো নিজেকে বোঝাতে না পারার অসহায়ত্ব। কেউ আপনাকে ক্রমাগত ভুল বুঝেই যাচ্ছে, এটা সহ্য করা কী যে কঠিন কী যে কঠিন! হয় না এমন, আপনি কাউকে খুব ভালোবাসেন, কিন্তু সে মানুষটা আপনাকে---ভালোবাসে না, সেটা ব্যাপার না; বোঝে না, সেটাও কিছু নয়; পাত্তা দেয় না, তাও মানা যায়---কিন্তু সে আপনাকে ভুল বোঝে। এটা খুব কষ্ট দেয়। কাউকে ভালোবাসি, সে ভালোবাসে না, এমন তো হতেই পারে। ভালোবাসাকে সব সময়ই যে একটা টু-ওয়ে ট্রাফিক হতে হবে, এমন নয়। আমি যে ভালোবাসি, তা তো আমাকে আনন্দ দেয়, অসীম শান্তি দেয়। প্রেমে পড়ার মতো আশ্চর্য সুন্দর অনুভূতি আর কী আছে! তবে সে আমায় ভুল বোঝে, এটা মেনে নেওয়াটা খুব কষ্টের। কে আমায় ভুল বোঝে কে ঠিক বোঝে, তার পরোয়া আমি করি না, তবে আমি যে তাকে ভালোবাসি, তাই তার বেলায় পরোয়াটা না চাইলেও করতে হয়, আপনা থেকেই চলে আসে। আমি বেঁচে আছি কি নেই, তা সে গ্রাহ্য করে না, এইটুকু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আমার বেঁচে থাকাটা তাকে পীড়া দেয়, এটা মানতে হয় কী উপায়ে? আমার সত্যিই তা জানা নেই।
আর একটা ব্যাপার দেখেছি। আমি কাউকে স্নেহে বাঁধতে চাই, আমি তার প্রতি আন্তরিক, তার সাথে প্রত্যাশাহীন একটা সহজ যোগাযোগ রাখতে চাই, আর সে আমায় ভুল বোঝে আর বুঝেই যাচ্ছে, কখনও কখনও ঘৃণা পর্যন্ত করছে! নিজের ভাবনা ও অবস্থানটা শত চেষ্টায়ও তাকে বোঝাতে পারি না। সে যা বোঝে, সেখান থেকে সরবেই না। এমনকি আমি যদি এ কারণে আফসোসে আত্মহত্যাও করে বসি, তাও সে তার ভাবনাতেই থেকে যাবে। সে যা ভাবে, যা ভাবতে তার ভালো লাগে, তার মন তাকে যা ভাবতে বলছে, সেখান থেকে সে কিছুতেই সরে আসে না। কখনও হয়তো কিছুটা সরে এসে দুইদিন সহজ সম্পর্ক রাখে, আমারও মনে হয় সব ঠিক হয়ে গেছে বোধহয়, আবার হঠাৎ করেই without the least instigation সে ফিরে যায় আগের রুদ্রমূর্তিতে। অন্তর থেকে ঘৃণা ছুড়ে দেয়, ঘৃণা না হলেও এমন কিছু জাজমেন্ট করতে থাকে আর করতেই থাকে, যেগুলি আমি সত্যিই ডিজার্ভ করি না। তার সম্পর্কে আমি যা ভাবি, আমি তাকে যেভাবে দেখি, সে আমাকে যেমন করে গ্রহণ করুক বলে আমি চাই...সেসবের ধারেকাছেও না গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে, আমাকে ও আমাদের এই সম্পর্কটাকে (প্রেমের সম্পর্ক নয়, দুইজন মানুষের মাঝে সম্পর্ক) ব্যাখ্যা করতে থাকে আর নিরলসভাবে করতেই থাকে। হাজারো চেষ্টায়ও কিছু হয় না আর। সে তার ভাবনায় অটল অবিচল হয়েই থাকে। যেহেতু আমি সম্পর্কটা রাখতে চাই, সেহেতু এটা মেনে নিতে আমার খুব যন্ত্রণা হয়।
মানুষ অনেক কিছুই ভেবে নেয়। ভাবতে ভালো লাগে, ভেবে নেয়। কারও ভাবনার উপর তো আমাদের কোনও হাত নেই, আর আমাদের পক্ষে সম্ভবও নয় জনে জনে ধরে ধরে নিজেকে ব্যাখ্যা করা। আমাদের যে চোখে দেখতে ভালো লাগে, মানুষ আমাদের সে চোখেই দেখে। অগত্যা কী আর করা যাবে? যার যেমন ইচ্ছে ভেবে নিক গিয়ে, আমরা আমাদের কাজটা আন্তরিকভাবে করে যাব। লোকের প্রতিটি কথাকে মাথায় রেখে চলা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে থেমে যাওয়াই একমাত্র পথ। আর থেমে যাওয়ার মানেই তো মৃত্যু! যে আমায় চেনে না, জানে না, বোঝে না, সেও আমায় জাজ করে, আমার সম্পর্কে নানান ভাবনা জানাতে থাকে---যে ভাবনাগুলোর কোনও ভিত্তিই নেই! বাঁচতে চাইলে এসবকে পাত্তা দিতে হয় না, এসবকে শুনলেও তা হৃদয়ে রাখতে হয় না।
..তবে যদি সে মানুষটি এমন কেউ হয় যাকে আমি ভালোবাসি বা স্নেহ করি, তখন খুব অসহায় লাগে। কাছের কারও কাছে নিজেকে বোঝাতে না পারার মতো অসহায়ত্ব আর নেই।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিতে ইচ্ছে করছে। একজন আছেন যাঁকে তাঁর কাজের জন্য, ব্যক্তিত্বের কারণে আমি খুব শ্রদ্ধা করি, অনেকেই তাঁকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তিনি শ্রদ্ধারই যোগ্য। তিনি যে আমাকে চেনেন, এটা আমি জানতাম না। জানলাম একদিন। কীভাবে? আমার এক ভয়াবহ বিপদের সময়, যখন আমাকে নিয়ে ফেসবুকে দুইলাইন বাজে কথা লেখাটা রীতিমতো ধর্মাচরণের মতোই কর্তব্য হয়ে পড়েছিল অনেকের কাছে, তখন অন্য অনেকের মতোই তিনিও তাঁর ওয়ালে একটা বড় পোস্ট দিলেন। সে পোস্টে কী কী ছিল, সে আলোচনায় যাচ্ছি না। কয়েকটি লাইন ছিল, যেগুলিকে সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়---আমি পয়সা নিয়ে ক্যারিয়ার আড্ডা করি, আমি বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের এজেন্ট, এবং এসব করে করে আমি অগাধ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছি।...বিশ্বাস করুন, সেদিন ভাইয়ার সে পোস্টটি দেখে আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম। যাঁকে এত পছন্দ করি ও শ্রদ্ধা করি, তাঁর কাছ থেকে এমন অনুমাননির্ভর বক্তব্য হজম করতে অনেক কষ্ট হয়েছিল।...এর পর ভাবলাম, তিনিও তো মানুষ, হয়তো আমি যেমন ভাবতাম, তেমন মানুষ তিনি নন। কী আর করা যাবে মেনে নেওয়া ছাড়া! তবুও তাঁকে ভালোবাসি, তাঁর ভালো হোক, এমন চাই। যাকে ভুল বুঝতে ইচ্ছে করে না, তাঁর কাছে অহেতুক ভুল ব্যাখ্যায় বেঁচে থাকতে খুব কষ্ট হয়।...প্রকৃতি তাঁকে অনেক বড় একটা জবাব দিয়ে দিয়েছে। এ জীবনে আমি কখনও কারও অমঙ্গল চাইনি, তাঁর জন্যও চাইনি, কেউই তা চায়নি, তবু তিনি একটা জবাব পেয়েছেন।..কাউকে কষ্ট দিতে হয় না, প্রকৃতি তা বহুগুণে ফেরত দেয়।
*সংগৃহীত 🪻