29/03/2024
কারো মা হবার কথাটা শুনেছেন কারো কাছ থেকে? আমাদের দেশে এ কথাটা অনেকটা আমড়া দিয়ে মুরগির ঝোল রান্না করার মতো ব্যাপার।
মা হবার পর নিজের শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, হরমোনাল ইমব্যালান্স, ঘুমের অভাব, স্ট্রেস, বাচ্চার কলিক, ব্রেস্টফীডিং সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটা এমনিতেই সবসময় কিছুটা বিক্ষিপ্ত, কিছুটা নির্লিপ্ত, কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা হতাশ অবস্থায় থাকে। বাচ্চার ঠাণ্ডা লাগছে কিনা, ক্ষিধে পেয়েছে কিনা, স্কিনে র্যাশ বের হলো কিনা, পেটব্যথা করছে কিনা – ইত্যাদি নানান চিন্তায় সে সবসময় আচ্ছন্ন থাকে।
যে মেয়েটা চোখে সবসময় কাজল দিতো, এখন সে দিনের পর দিন আয়নার দিকে তাকানোর ও সময় পায় না, কাজলের জায়গায় তার চোখের কোণায় এখন নির্ঘুম রাতের রাতজাগা পাখি হবার কারণে কালি পড়েছে। সবসময় প্রতিটা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং অথবা পারফেক্ট কনট্রাস্টে কানের দুল আর আংটি-ব্রেসলেট পরা মেয়েটি এখন দিনের পর দিন মলিন ম্যাক্সি, অথবা লুজ টিশার্ট আর পালাজ্জো পরে দিন কাটে।
কখনো স্ট্রেইট আয়রন করা, কখনো বা কার্ল করা, কখনো ব্রেইড করে হেয়ারস্টাইল করা মেয়েটি এখন দিনের পর দিন একই খোঁপায় চুল বেঁধে রাখে, কখনো কখনো দিনশেষে মাথায় চিরুনি বুলানোর ও সময় পায় না।
কিন্তু এমনটা কি হবার কথা ছিল?
সন্তান যখন গর্ভে থাকে, তখন থেকেই আশেপাশের মানুষের(!) পরামর্শ আর শুভাকাংক্ষিতায় মেয়েটি নিজেকে ভুলে যেতে শুরু করে।
বারবারই মনে হয়, আমি মনে হয় আমার ১০০% দিতে পারছি না, আমি মনে হয় ভালো মা হতে পারব না, আমি তো কিছুই জানি না, আমি ছাড়া সবাই বাচ্চার ভালো বোঝে।
হরমোনের পরিবর্তন আর শারীরিক কারণে ধীরে ধীরে এই মন খারাপ ভাবটা ডিপ্রেশনে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। আর সেটা আরও প্রখর হয় সন্তান জন্মদানের পর। এই সময়টাকে বলা হয় পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা বেবি ব্লুজ। এবং নিজের দিকে না তাকানো আর নিজেকে সময় না দেয়ার কারণে ডিপ্রেশনের প্রখরতা আরো বাড়তে থাকে।
এ সময় বাচ্চা কেমন আছে সবাই জিজ্ঞেস করে। মা কেমন আছে খুব সীমিত সংখ্যক মানুষই জানতে চায়।
রাত জাগতে হয়, ব্রেস্টফীডিং এর কারণে শরীরে ক্লান্তি থাকে, অনেকের ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে যায় ঘুমের অভাব আর স্ট্রেস এর কারণে।
তার মধ্যে মাথায় হাত বুলানোর মতো মানুষ খুব কমই থাকে। মিষ্টি করে হেসে কেউ বলে না, “You Are Doing a Great Job Mommy!”
সচরাচর কেউ বলে না, “তুমি একটু ঘুমাও, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসো, আমি ততক্ষণ তোমার বাচ্চাটাকে রাখছি।” এইটুকু সহমর্মিতা আর সহযোগিতা কিন্তু সব নতুন মায়েরই প্রাপ্য।
আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল। ও কথায় কথায় বললো, “দোস্ত মেয়ের গায়ে তেল-লোশন মাখি। নিজের গায়ে মাখার সময় পাই না। আমার অবস্থা পুরা বস্তির মতো, স্কিন বুড়ো মানুষের মতো হয়ে গিয়েছে।”
মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর কথাটা শুনে। আমি সাথে সাথেই ওকে বললাম, “প্লিজ দোস্ত, এমন করিস না। যখন মেয়ের গায়ে মাখবি, নিজেও ইউজ করবি। নিজের যত্ন নিবি, না হলে একসময় কঠিন ডিপ্রেশনে চলে যাবি। নিজের মন ভালো রাখাটা জরুরী। নিজেকে ভালোবাসাটা খুব জরুরী। না হলে একসময় নিজের চারপাশের মানুষদেরও তুই ভালো রাখতে পারবি না।”
সে বলল তার এক আত্মীয় নাকি তাকে লোশন মাখতে দেখে বলেছে শুধু নিজে না মেখে বাচ্চাকেও যেন মাখায়!!!
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কারো কারো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয়। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আশেপাশের মানুষের সহযোগিতা তো অবশ্যই কাম্য।
কিন্তু আপনি নিজে কি নিজেকে সহযোগিতা করছেন? নিজের ভালো থাকাটা যে কতটা ইম্পরট্যান্ট সেইটা কি বুঝতে পারছেন?
সন্তান অবশ্যই আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আপনি নিজেও কিন্তু আপনার প্রায়োরিটি। সন্তানের যত্নের পাশাপাশি নিজের ও যত্ন নিন।
যা করতে ভালো লাগে, তাই করুন। সব ব্যস্ততার মাঝেও নিজেকে আলাদা করে সময় দিন। বই পড়ুন, মুভি দেখুন, সময় করে বেড়িয়ে আসুন, কেনাকাটা করুন, ক্র্যাফটিং বা ছবি আঁকতে ভালোবাসলে সেটাই করুন, লেখালেখির হাত থাকলে লিখুন। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, আড্ডা দিন। নিজের ত্বকের যত্ন নিন, চুলের যত্ন নিন, সাজগোজ করুন।
আপনার মন ভালো থাকবে। এতে আপনার বাচ্চা আর আপনার সংসার টাও ভালো থাকবে 🙂