09/09/2024
রবীন্দ্রনাথের গান কেন পুরনো হয় না
*
আমার মনে হয় এর কারণ সুরের সারল্য এবং কথার রহস্যময়তা। তিনি যখন বলেন 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' তখন আমাদের হৃদয়ে জন্মভূমির প্রতি আশ্চর্য এক অনুভূতি জেগে ওঠে এবং এটা সব ধরণের মানুষের মনে একই রকমভাবে জাগ্রত হয়। এটা সারল্যের অসাধারণ এক উপস্থাপন। আবার তিনি যখন লেখেন 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে' তখন তালা এবং চাবির স্থান বদলে যাওয়ার রহস্যে মন থমকে দাঁড়ায় এবং তার ভাবনার আকাশে একটা ছবি টাঙাতে চেষ্টা করে, ছবিটা মেলে আবার মেলে না, একটা দোদুল্যমানতা খেলা করতে থাকে। এই বোঝা এবং না বোঝার অনুভূতি যখন তার মনকে একটা অধরা স্তরে বেঁধে ফেলছে তখন সুর তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য সহাস্যে এগিয়ে আসছে। কারণ সুরের সারল্য যা খুবই চেনা, আমাদের জীবযাপন থেকে উঠে আসা, তা কথার রহস্যময়তাকে এক ঝটকায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তখন কথা এবং সুর দুই মিলে এক অনির্বচনীয়তা তাকে গ্রাস করে ফেলছে। এবং যতবার সে শুনছে এই গান, ততবার সে এর ঘোর থেকে বের হতে পারছে না, নতুন লাগছে ।
মানুষের একটি সহজ প্রবণতা হচ্ছে সে সুন্দরকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। যে সুন্দরকে গ্রহণ কিংবা উপভোগ করতে খুব বেশি মগজ খাটাতে হয়, তা সব মানুষের না হয়ে কিছু উচ্চতর বোধের মানুষের হয়ে ওঠে। সংগীত নিশ্চয় শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু সুর তাকে অতিক্রম করে সর্বজনীন হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য ধরে। এখন কোন কথা যদি শ্রেণীর উর্ধে উঠতে পারে, তাহলে সুর এবং কথার যৌথ আবেদন সব মানুষকে এক জায়গায় টেনে ধরতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা রবীন্দ্রনাথের গানের কথার এই বৈশিষ্ট্য পাই তার নিজস্ব শ্রেণিকে ধারণ করার ক্ষমতায়। তার গানে শ্রেণি মানে এখানে প্রধানত মধ্যবিত্ত, যদিও তিনি মধ্যবিত্ত ছিলেন না। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সমাজের অন্য শ্রেণীর চেয়ে অধিক শিল্পচর্চা করে। শিল্প যেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চর্চার অন্তর্গত। গণসংগীত কিংবা ফোক- এগুলি একদিকে শোষিত এবং নিম্নবর্গীয় শ্রেণীর গান। নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে বাউল ধারার গান তার দার্শনিক প্রত্যয়ের জন্য সব শ্রেণীর মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা ধরে। আমরা যদি লালনের গান শুনি তাহলে এর সত্যতা পাই বা যে কোন বাউলের গানের মধ্য এই সার্বজনীনতা লক্ষ্য করি। তিনি যখন বলেন 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে' তখন কোন শ্রেণি নয়, সব মানুষ এই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় নিয়ে সংশয়ে পড়ে যায় এবং নিজেকে মানুষ রূপে ভাবতে বাধ্য হয়। রবীন্দ্রনাথ এই বাউল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক গান লিখেছেন। তিনি যখন লেখেন 'আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না' তখন কোন নির্দিষ্ট শ্রেণি নয়, সব মানুষ নিজেকে চেনার সংকটে ভুগতে থাকে এবং যতবার এই গান শুনে, এই ভাবনা থেকে বেরুতে পারে না। আবার জন্মভূমির প্রতি প্রতিটি মানুষের যে সহজাত টান, তা যখন গানে মূর্ত হয়, তখন শ্রেণি উর্ধে উঠে সব মানুষের হৃদয়ে একই বোধ জাগিয়ে তোলে। 'আমার সোনার বাংলা' কিংবা 'যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক' কিংবা 'সার্থক জনম আমার'- এমন বহু গান মানুষকে বোধের একই সূতায় বেঁধে ফেলে। ফলে রবীন্দ্রনাথের গান শুধু তার শ্রেণি নয়, সকল শ্রেণিকে নিজের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়। আবার তিনি যখন প্রেমের গান লেখেন, তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবেগকে এমন সূক্ষ্মতায় বাঁধেন যে এখান থেকে কানকে সরিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে। তিনি যখন সহজ ভঙ্গীতে বলেন 'আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই গো' কিংবা 'তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা' তখন তখন প্রতিটি প্রেমিক হৃদয় এই কথার ভেতর নিজেকে দেখতে পায়। প্রেমের এমন মহত্তম গান অজস্র।
শুধু জন্মভূমির প্রতি আবেগ কিংবা প্রেম কিংবা সার্বজনীন দর্শনের গান নয়, তিনি প্রকৃতি প্রেম নিয়ে যে অজস্র গান রচনা করেছেন তা প্রকৃতির প্রতি মানুষের আবেগকে এমন এক উচ্চতায় স্থাপন করে যা তার মনকে পরিশুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে শিল্পের চোখ দিয়ে দেখার যে আয়না, রবীন্দ্রনাথের গান তাকে প্রতিবিম্বিত করে। প্রকৃতির প্রতি এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতে বাধ্য করে।
এটা তো গেল গানের কথার দর্শন বা বোধ নিয়ে। সুর নিয়ে যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখবো তার গানে প্রযুক্ত সুর সবচেয়ে সারল্যের চাদরে মোড়ানো। শিল্পের সারল্য এক বিশাল শক্তি ধরে। এই সারল্য মানে সরলতা বা সহজতা নয়, এর মানে হচ্ছে রাগসঙ্গীতের যে জটিল বিন্যাস এবং গায়কী তা থেকে মুক্ত এবং সুরের যে লৌকিক প্যাটার্ন তার সুচারু প্রয়োগের ফলে সব ধরণের শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়কে আকৃষ্ট করা। তার সুরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধুনিক নয় আবার লোক নয়, এ'দুটির এক আশ্চর্য মিশেল। ভাটিয়ালির মত টানা নয় আবার শহুরে গতিশীল রক নয়, আবার রাগের জটিলতা নয়- অথচ তার সুর সব ধরণের শ্রোতার রুচিকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখে। এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা।
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান ঈশ্বর বন্দনা। কিন্তু সেই বন্দনা কোন প্রথাগত ধার্মিক মানুষের নয়। এই মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তাকে তিনি অনুভব করেন এবং তার প্রতি তিনি এক ধরণের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে'- এটা সৃষ্টিকর্তার প্রতি এক অনন্য নিবেদন। কোন ধর্মীয় আচার নয়, প্রথা নয়, একজন বিশ্বাসী মানুষ যদি তার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাহলে পৃথিবীতে যত ধর্মীয় হানাহানি, তা থাকতো না। তিনি এখানেও এমন এক ধর্মবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন যে তা সব প্রথাসিদ্ধ ধর্মের বাইরে। ফলে এই গান জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গ্রহণ করে দ্বিধাহীন চিত্তে। কোন নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, মানবধর্মই মুখ্য হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ তার গানে সুর থেকে সমগ্র জটিলতা পরিহার করেন অথচ তার মর্মে সংগীতের সবকিছুকে ধারণ করেন, সুরে প্রযুক্ত করেন সমস্ত শ্রেণীর জীবনধারা থেকে উঠে আসা স্বতঃস্ফূর্ত বিন্যাস। ফলে তা সকলের হয়ে ওঠার দিকে যাত্রা করে এবং তা কথার সারল্যে ও দার্শনিক সত্তায় অনিঃশেষ হয়ে পড়ে।
#সংগৃহীত