Dainik Uttara

  • Home
  • Dainik Uttara

Dainik Uttara 51 years old daily news paper in north bengal at Bangladesh
(1)

28/01/2025
17/12/2024

জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ?
অধ্যাপক মুহম্মদ মহসীন

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতির এক যুগসন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তার ক্ষমতায় আসাটা কোন রাজনৈতিক কিংবা সামরিক প্রক্রিয়ার অংশ ছিল না। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কতৃর্ক সামরিক অভ্যূত্থান ঘটানোর পর দেশ এক ভয়াবহ নৈরাজ্যে নিক্ষিপ্ত হয়। সেই পটভূমিতে ঘটেছে ৭ই নভেম্বর ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব’। সেই ক্রান্তিলগ্নে একজন নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও দক্ষ শাসকের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। ইতিহাস সে দায়িত্ব অর্পণ করে জিয়াউর রহমানের উপর।
জিয়াউর রহমান তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন—বাংলাদেশ, এর মাটি এবং মানুষের সাথে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের এবং ভালবাসা। তার জীবনে এবং মরণে বাংলাদেশ ছাড়া যে আর কিছুই ছিল না, তার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, তার মেধা এবং দক্ষতার বলে তিনি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশসমূহের এবং ইসলামী সম্মেলন সংস্থার অঘোষিত নেতায় পরিণত হন। সকল প্রকার দুনীর্তি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধে থেকে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টান্ত হয়েছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারে পিছিয়ে নেই। অনেক মিথ্যা অভিযোগ ও অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করা হয়ে থাকে। এসবের সমুচিত জবাব দেবার দায়িত্ব আজ তার অবর্তমানে তার রাজনৈতিক উত্তরসূরীদের উপর।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার বিরুদ্ধে প্রায়ই যে সকল অভিযোগ করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম হল যে, জিয়াউর রহমান একটি সেনা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। অথচ বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত জানেন যে, এই অভিযোগ নিতান্তই অসত্য এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। প্রকৃত সত্য হল, ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর স্বঘোষিত মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোস্তাক আহমদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যূত্থান ঘটান। এই সময় তৎকালীন সেনা উপ—প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা হয়। ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত নানা ঘটনা—দুর্ঘটনার শেষ পর্যায়ে সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থান ব্যর্থ হয়। বিপ্লবী সিপাহীরা জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে এবং জাতির সেই ক্রান্তিলগ্নে অবধারিত রূপেই জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রের হাল ধরতে হয়। সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে চক্রান্ত করে তিনি ক্ষমতা দখল করেননি।
তেমনি জিয়াউর রহমান দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি হত্যা করে দেশে সামরিক শাসন জারী করেছিলেন, এই অভিযোগেরও কোন প্রকার সত্যতা নেই। ১৯৭৫ সালের ৫ই আগস্ট শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যূত্থান ঘটিয়ে তারই মন্ত্রীসভার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য খোন্দকার মোস্তাক আহমদ ক্ষমতা দখল করনে এবং দেশে সামরিক শাসন জারী করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সমর্থন ও সহায়তা নিয়েই তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। আর বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। ১৯৭৫ সালের ২৪শে এপ্রিল তারিখে তিনি দেশের সংবিধানের হঠাৎ ও ব্যাপক পরিবর্তন করে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন।
জিয়াউর রহমান খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেছিলেন বা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এই অভিযোগও শোনা যায়। আমরা সবাই জানি, ৩রা নভেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে খালেদ মোশাররফ এক সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করে নিজে সেনা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন। আর বিপ্লবী সিপাহীরা খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থানকে প্রতিহত করে রাষ্ট্রক্ষমতার কতৃর্ত্ব গ্রহণ করে জিয়াকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেন। তার আগেই খালেদ মোশাররফ নিহত হন। সুতরাং খালেদ মোশাররফের হত্যা বা হত্যার ষড়যন্ত্র করার কোন অবকাশই জিয়াউর রহমানের ছিল না।
সব চাইতে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, আওয়ামী লীগ রাজনীতির অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে শেখ মুজিবের হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালান। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিব হত্যা মামলায় তারা শহীদ জিয়াউর রহমানকে ‘আসামী’ পর্যন্ত করেছিলেন। অথচ এদেশের মানুষ জানে, যে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে তারই দলের চক্রান্তে। শেখ মুজিব হত্যাকে যদি একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলা হয় তাহলেও সেই চক্রান্তের সাথে সম্পৃক্ত থাকার যাদের সামান্যতম অবকাশ ছিল সেই তালিকায় জিয়াউর রহমানের নাম থাকতে পারে না। মুজিব হত্যার সময় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ, রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। জিয়া ছিলেন একজন বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জিয়াউর রহমান যে অবদান রেখেছেন তাঁকে খাটো করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। তারা হয়তো মনে করেন, জিয়াউর রহমানের অবদান স্বীকার করলে, (তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে) মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের অবদান ম্লান হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের নেতা—কমীর্ এবং সমর্থকরা দাবী করেন যে, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়াদ্দীর্ উদ্যান) শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যদি তা—ই হবে, তবে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টো ও পাকিস্তানের সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে একের পর এক রুদদ্বার বৈঠক করেছিলেন কেন?
কেন প্রতিটি বৈঠকের শেষে সাংবাদিকদের জানাচ্ছিলেন যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এবং ভুট্টোর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তাদের আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে? অথচ সেই সময় সমগ্র জাতি এই আলোচনা বিপক্ষে ছিল। ৭ই মার্চের অনেক আগেই ১৯৭০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর পল্টনের জাতীয় লীগ ও ন্যাপ (ভাসানী)র যৌথ জনসভা থেকে মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। প্রকৃত সত্য হল যে, শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন। আর এজন্য অতীতে অসংখ্যবার তিনি যেমন রাজনৈতিক কারণে বন্দী হয়েছেন ২৫শে মার্চ রাতে সে রকমেরই একটি বন্দিত্ব মেনে নিয়ে তিনি জেলে আশ্রয় নেন। তিনি সেদিন জানতেও পারেননি যে, একটি নিরস্ত্র জাতিকে তিনি শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন।
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তিনি কর্ণেল তাহেরকে ‘হত্যা’ করেছেন। তাহের কি কারণে গ্রেফতার হন এবং কিভাবে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন, সে বিষয়টি সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে এটাকে ‘হত্যাকান্ড’ বলে চালানো হয়। কর্ণেল একটি ব্যথ সামরিক অভ্যূত্থান পরিচালনা করেন সাধারণ সিপাহীদেরকে শ্রেণী সংগ্রামের নামে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিয়ে। বহু অফিসারকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যদি এই অভ্যূত্থানটি সফল হত, তাহলে হয়তো সেই দিন কর্ণেল তাহেরের হাতে জিয়াউর রহমানও নিহত হতেন। কিন্তু কর্ণেল তাহের ব্যর্থ হন। পৃথিবীতে সর্বকালে এবং সর্বস্থানে সামরিক অভ্যূত্থান এবং অভ্যূত্থান ব্যর্থতার যে পরিণতি হয়, তাহেরের ক্ষেত্রেও তা—ই হয়েছে।
জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি ছিল একেবারেই কাকতালীয়। সাড়ে তিন বৎসরের আওয়ামী দুঃশাসন এবং একদলীয় বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেয়ার পর যখন সারাদেশে একটি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করছিল তখনই শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। আশ্চার্যের বিষয়, এই ভয়াবহ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কোন প্রতিবাদ করেনি, কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। রবঞ্চ ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে সেদিন আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয়া হত্যাকারীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্তাতা। দেশের মানুষ জানতে পারে যে, এই জিয়া এই মেজর জিয়া— ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার থেকে যিনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পারে, দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব একজন যোগ্য ব্যক্তির হাতেই ন্যস্ত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসাটা অনেক সামরিক অফিসারের মনে উচ্চাভিলাষের জন্ম দেয়। ফলে এ সময় একের পর এক অনেকগুলো সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক নিয়মে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের দণ্ড হয়। এর জন্য জিয়াউর রহমানকে পৃথকভাবে দায়ী করার কোন অবকাশ নাই। বস্তুতঃ জিয়াউর রহমান সেদিন দক্ষতার সাথে সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে রক্ষা করেছেন।
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছেন। দল ভাঙ্গার রাজনীতি করেছেন, রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করেছেন। মানুষের প্রতি জিয়াউর রহমানের ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। তিনি সমাজের বিভিন্ন পেশার কৃতি ব্যক্তিদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশ সেবায় তাদের আকৃষ্ট করেন। কোন রাজনীতিবিদ সম্পর্কে তিনি কখনো কোন কটুক্তি করেছেন, এমন কোন উদাহরণ নেই। এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাকে সাংবিধানিক প্রয়োজনে জনসমর্থন খুঁজতে হয়। আর এই জনসমর্থন খেঁাজার প্রক্রিয়ায় তিনি একদিকে যেমন নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের অনুসন্ধান করেছেন তেমনি অনুসন্ধান করেছেন বিভিন্ন পেশার কৃতি ব্যক্তিদের। জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক অফিসার। ব্যক্তি নির্বাচনে তিনি তার পেশা প্রশিক্ষণকে ব্যবহার করে দেশের সকল শ্রেণীর এবং সকল অঞ্চলের মানুষের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। জিয়াউর রহমানের সাথে যারা একবার মিলিত হয়েছেন তারা তার সরল ও অকপট আহবান, দেশের মাটি এবং মানুষের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রপরিচালনা তার দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী বেশ কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। এটাকে যদি দল ভাঙ্গার রাজনীতি’ বলা হয়, তাহলে ‘দল গড়ার রাজনীতি’ কোনটাকে বলবো?
জিয়াউর রহমানকে নতুন করে তার রাজনীতি নির্ধারণ করতে হয়েছিল। কর্ণেল তাহেরের ঘটনার প্রেক্ষিতে জাসদ ছিল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অত্যন্ত তৎপর। তৎপর ছিল বহুবিধ আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে তাঁর প্রয়োজন ছিল সুদৃঢ় রাজনৈতিক সমর্থন। আওয়ামী লীগ বিরোধী মহল তাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে এগিয়ে আসবে, এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। এই প্রক্রিয়ায় এককালে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে মতভেদের কারণে দূরে সরে গেছেন এমন অনেকেও এগিয়ে আসেন। তাছাড়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, প্রাক্তণ সামরিক ও পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাও যোগ দেন তাঁর সাথে। জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করেন; শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক বন্ধ করে দেয়া সংবাদপত্র সমূহের প্রকাশনার অনুমিত দেন।
রাজনীতির এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীকে সহায়তা প্রদানকারী বেশকিছু ব্যক্তিও রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসিত হয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাকারী জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন, এমনকি তার মন্ত্রী সভায় এবং নবগঠিত রাজনৈতিক দলে তাদের অন্তর্ভুক্তি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবনকে বিতর্কিত করেছে। এ জন্যে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু এটা সেদিনের বাস্তবতার প্রতিফলন মাত্র। আওয়ামী—বাকশালী দুঃশাসন দেশকে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়, যা অবধারিত রূপে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে পুনর্বাসিত করেছে। জিয়াউর রহমান সেই বাস্তবতা উপেক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু কখনই তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুত হননি। মৃত্যুর পূর্ববতীর্ দিনগুলোতে বিএনপিকে তিনি সেভাবেই পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
জিয়াউর রহমান স্বর্গের দেবদূত ছিলেন, এ দাবী করবো না। তবে, তিনি ছিলেন হাজারো সীমাবদ্ধতার মধ্যে একজন উৎকৃষ্ট মানুষ। এই দেশ, মাটি এবং মানুষের জন্যে তাঁর ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম। আর এজন্যই তার শাহাদাতের সংবাদে শোকাভূত জাতি তাদের শ্রদ্ধা দেখাতে কোন প্রকার কার্পণ্য করেনি। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতে, জিয়াউর রহমানের জানাযায় যত শোকাভূত মানুষের সমাগম হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এত জন সমাগত আর কখনো ঘটেনি, হয়তো ঘটবেও না।
পুনর্মুদ্রিত—
দৈনিক উত্তরার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক
জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশ
সালঃ ১৯৯৮

17/12/2024

স্বাধীনতা ঘোষনা বিতর্ক এবং জিয়াউর রহমান
ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের রহস্যও অদ্যাবধি উন্মোচিত হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সহধর্মিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবার পরেও।
অবশ্য জিয়া হত্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্তদের কয়েকজন ঘটনার পরবর্তীকালে ‘বিক্ষুব্ধ সিপাহী জনতার হাতে’ প্রাণ হারান, দু’জন বিদেশে পালিয়ে যান (তাদেরকে ফেরত এনে বিচার সোপর্দ করার কোন চেষ্টা কখনো হয়েছে বলে শোনা যায়নি এবং এদের একজন নাকি ইতিমধ্যে মারাও গেছেন), কয়েকজনকে বিশেষ ট্রাইবুনালে সোপর্দ করে ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেয়া হয়।
সেদিন যে ভাবে তড়িঘড়ি করে এই ফাঁসির দন্ডাদেশ করা হয়েছিল তা নিয়ে আজও জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। জিয়া হত্যার মূল নায়ক হিসেবে কথিত মেজর জেনারেল মঞ্জুর সে^চ্ছায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরও কিভাবে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের হাতে’ প্রাণ হারালেন— সে প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হয়েই বিরাজ করছে।
এতবড় একটি ঘটনা, যার জন্য ডজনাধিক সামরিক অফিসারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, সেই ঘটনাটি কি কেবল ওই কয়েকজন উচ্চাভিলাষী তরুণ অফিসারের হঠকারিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? হত্যার সকল আলামত যেভাবে গোয়েন্দা কাহিনীর মতো একটি একটি করে সরিয়ে ফেলা হলো, মূল হত্যাকারী মতিউর রহমান, হত্যাকান্ডের মূল প্রত্যক্ষদর্শী লেঃ কর্নেল মাহফুজ এবং জেনারেল মঞ্জুরসহ যারা এই ঘটনার প্রেক্ষাপট উন্মোচিত করতে পারতেন, তাদের কাউকেই জীবিত রাখা হয়নি। এটাও কি মূল হত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল? তবে তো মূল পরিকল্পনাকারীর এই বৃত্তের বাইরেই থাকার কথা।
রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হবার পর ১৯৮১ সালের জুন মাসে বিএনপির একটি বিশেষ বর্ধিত সভা ডাকা হয় দলের পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করার জন্য। তখনকার ‘পুরনো গণভবনে’ (আজ যার নাম ‘সুগন্ধা’) বিএনপির কেন্দ্রীয়, জেলা ও থানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দিয়েছিলেন বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে এতে সভাপতিত্ব করেন। সভার শুরুতে অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্যের এক পর্যায়ে আমি যখন নিহত নেতার হত্যাকান্ডের বিচার প্রসঙ্গে মন্তব্য করছিলাম, যখন বলছিলাম— হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে টার্মস অফ রেফারেন্স থেকে এই হত্যার সাথে জড়িত অন্যদের খুঁজে বের করার বিষয়টি শেষ মুহূর্তে কোন অজ্ঞাত কারণে কার নির্দেশে এবং কোন যুক্তিতে বাদ দেয়া হয়েছে দেশবাসীকে তা জানানো দরকার— তখন পার্শ্বে উপবিষ্ট অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার আমাকে ইশারায় থামতে বলেন। আমি বক্তৃতা থামিয়ে তাঁর কথা শোনার জন্য পাশে ঝুঁকলাম। তিনি আমার কানে কানে বললেন, ‘এ নিয়ে আর কিছু বলবেন না।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের বিষয়টা যে চাপা পড়ে গেছে, সেটা মোটেই কাকতালীয় ব্যাপার ছিলনা। সুপরিকল্পিতভাবেই তা চাপা দেয়া হয়েছে।
ট্রাইবুনালের ‘টার্মস অফ রেফারেন্স’ এ এটা অন্তভুর্ক্ত ছিল এবং তা কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু একদিন পরেই তা ছেঁটে ফেলা হয়। তখন যারা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন তাদের একটি অংশ সচেতনভাবেই এই কাজটি করেছেন। তাঁরা সম্ভবতঃ চাননি যে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসুক।
৭৫ সালের ইনডেমনিটি বিল বাতিলের বিরোধিতাকারীরাও সম্ভবতঃ একই কারণে ভীত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তাহলে যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে। কনস্টিটিউশনাল ক্রাইসিস দেখা দেবে। এদের উদ্দেশ্যে একবার লিখেছিলামঃ হোন না ক্রাইসিস, তাতে আপনি অত শঙ্কিত হচ্ছেন কেন? ক্রাইসিস যদি সত্যই দেখা দেয়, তার মোকাবেলার পথ সবাই মিলে বের করবে। আপনি কেন সব দায়—দায়িত্ব নিজের মাথায় নিতে চান?
সাপের ভয়ে কেঁচো খেঁাড়া থেকে বিরত থেকে আমরা আজ গোটা দেশটাকেই বহুবিধ সর্পের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছি।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের বেতার ভাষণের মধ্যদিয়ে।
২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর হামলায় গোটা জাতি যখন দিশেহারা, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যখন তাদের নেতার সুষ্পষ্ট নির্দেশের অভাবে পরবর্তী কর্মপন্থা দিতে পারছে না, সেই সময়টিতে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর মতো আমিও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে, আমরা যারা স্বাধীনতার সপক্ষে প্রকাশ্য তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাম, অথচ আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না, তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুবই বিব্রতকর।
২৭ মার্চ, ১৯৭১। হাজার হাজার মানুষ, নর—নারী, আবালবৃদ্ধবণিতা কেউ শূন্য হাতে, কেউ সামান্য কিছু সম্বল নিয়ে ঢাকা ছেড়ে বাইরের দিকে ছুটছেন, আর আমি তখন পাকবাহিনীর নৃশংসতায় বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের দিকেই ফিরছি। ২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমি এবং মরহুম আতাউর রহমান খাঁন রওয়ানা হয়েছিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। লালদীঘির মাঠে স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দিতে। কিন্তু সে ট্রেন চট্টগ্রাম অবধি যেতে পারেনি। লাকসাম পর্যন্ত কোনক্রমে পেঁৗছলাম। অতঃপর চাঁদপুর—নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা ফেরা। চাঁদপুর থেকে স্টীমারে চেপে ২৭ তারিখ সকালে আমরা নারায়ণগঞ্জ পেঁৗছাই। তখন পাক বাহিনী ঢাকা—নারায়ণগঞ্জ সড়কে ব্যারিকেড সরিয়ে থেমে থেমে এগুচ্ছে। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে বুড়িগঙ্গার অপর পারে গেলাম। সেখানে একটা বাড়ীতে খান সাহেবকে রেখে আমি পায়ে হেঁটে নদীর তীরে ঘেঁষে জিঞ্জিরার দিকে এগুতে থাকলাম।
পথে অনেক পরিচিত আতংকিত মুখ। জিঞ্জিরায় পেঁৗছাতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আমাকে দেখে পরিচিত ছাত্র—কর্মীরা ঘিরে ধরলো। সবার প্রশ্ন, এখন কি হবে?
কি হবে তা কি আমিও জানি?
আর ঠিক সেই সময় পাশে একটি পান দোকানের সামনে প্রচন্ড শোরগোল। চট্টগ্রাম বেতার থেকে ভেসে আসছে দুর্বল ট্রান্সমিশনে কিছু শব্দতরঙ্গ।
মূহূর্তের মধ্যেই যেন গর্জে উঠলো গোটা জনপদ। অখ্যাত ‘এক মেজর’ জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে একটি ঘোষণায় হতোদ্যয় মুক্তিকামী জনতা যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মত জেগে উঠেছে। রেডিওতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করা হয়েছে ....... বাঙালী সৈনিকরা ব্যারাক ছেড়ে অস্ত্র হাতে সংগ্রামে শরিক হয়েছে। এই সংবাদ সেদিন হত—বিহ্বল মানুষকে নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে কি প্রচন্ড প্রেরণা যুগিয়েছে— আজকের প্রজন্মের পথে তা অনুধাবন করা কঠিন।
আজ কতদিন পরেও কানে বাজে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি ...... বাঙালী সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়েছে ...... স্বাধীন বাংলাদেশের প্রভিশনাল সরকার গঠিত হয়েছে ..... বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানাচ্ছি, ..... ইত্যাদি। কে এই মেজর, সে প্রশ্ন তখন অবান্তর। যে—ই হোক না কেন, এই অখ্যাত মেজর সমগ্র জাতির মনের আকুতিকে ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছে।
শুধুমাত্র একটি বেতার ঘোষণা দিয়েই দেশ স্বাধীন করা যায় না। কিন্তু সঠিক সময়ে একটি সঠিক ও সাহসী পদক্ষেপ যুগান্তকারী ঘটনা প্রবাহের সূচনা ঘটাতে পারে। সেদিন দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরাও সেদিন এই ঘোষণাতেই নতুন করে বুক বেঁধেছে। ‘অখ্যাত’ জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ‘জোয়ান অভ আর্ক’।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই ঘোষণা নিয়ে কোন বির্তক হয়নি। হয়নি শেখ সাহেবের জীবদ্দশাতেও। কিন্তু আজ এ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। স্বাধীনতার প্রথম অনুষ্ঠানটি ঘোষণার কৃতিত্বটুকু জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতায় এসেই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম বলে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ করেছিলেন। সর্ব মহলের প্রতিবাদের মুখে সেই উদ্যোগ আপাততঃ চাপা পড়ে থাকলেও বিষয়টির সম্ভবতঃ এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিত হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন এটা করতে চায়? অন্য সব কিছু বাদ দিলেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডর ছিলেন, তিনি একদা এদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং এত বছর পরেও দেশ জুড়ে একটি বিশাল দল হিসাবে বিরাজ করছে।
এমন একজন রাষ্ট্রনেতার নামে একটি বিমান বন্দরের নামকরণে আওয়ামী লীগের এত আপত্তি; কিন্তু সেই আওয়ামী লীগই চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণ করেছে, ‘এম এ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন এম এ আজিজ এবং জহুর আহমদ চৌধুরী। নেতৃত্বের পরিমাপে, ত্যাগ তিতিক্ষায় তাঁরা দুজনেই ছিলেন অতুলনীয়। তাঁদের কারো নামে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের নামকরণ হলো না; হলো এম এ হান্নানের নামে!
কে এই হান্নান? হঠাৎ করে কেনই বা তাঁকে এভাবে তুলে ধরা?
এম এ হান্নান চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল ফরিদপুর, থাকতেন চট্টগ্রামে। বস্তুতঃপক্ষে তিনি ছিলেন এম এ আজিজ সাহেবের রাজনৈতিক সহকারী এবং সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কাজ—কর্ম করতেন। জননেতা বলতে যা বোঝায় চট্টগ্রামে তাঁর তেমন অবস্থান কখনই ছিল না।
এম এ হান্নান আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে (সম্ভবতঃ ১৯৭৪ সালে) তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর সেদিনের আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর নামে চট্টগ্রামের একটি কানাগলির নামকরণ করেছিল বলেও শুনিনি। আজ এতদনি পর কেন তাঁর নামে চট্টগ্রামের একমাত্র বিমান বন্দরের নামকরণ করার প্রয়োজন দেখা দিল?
বস্তুতঃপক্ষে এম এ হান্নানকে সম্মানিত করার জন্য নয়, একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই বর্তমান আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, জিয়াউর রহমান নয়, হান্নানই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা করেন চট্টগ্রাম বেতার থেকে। স্পষ্টতঃই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক হিসাবে জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার একটি সুচতুর কৌশল হিসাবেই এম এ হান্নানকে সামনে টেনে আনার চেষ্টা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ এবং তার পর কয়েকদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রটি পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ঐ বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেদিনের গণ আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রচারণা চালিয়ে স্মরণীয় হয়েছেন। ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হবার পর কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র থেকে পাঞ্জাবী শাসনের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আহবান জানিয়ে অনেকগুলো কথিকা প্রচার হয়। মরহুম হান্নাও এ সময় ঐ বেতার বক্তব্য রাখেন। সে বক্তব্যে স্বাধীনতার আহবান থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, তখন সারা দেশেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে।
এটাই বা কম কিসে? মরহুম হান্নান অবশ্যই সেই কৃতিত্বের দাবীদার। কিন্তু বেতারে কথিক প্রচার আর স্বাধীনতা ঘোষনা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন এদেশের মানুষের দানা বেঁধেছে একাত্তরের অনেক আগে। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে এদেশের রাজনৈতিক কর্মী ও রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের অনেকেই প্রকাশ্যে—অপ্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থে একটি দেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ তখনই তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে যখন এমন কারো মুখ থেকে কথাটি উচ্চারিত হয়, যিনি ঐ বিশেষ সময়ে ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্র বিন্দুতে স্থাপিত হয়েছেন। তিনি কে, কারা তাঁর পেছনে, এ ঘোষণা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ‘অধিকার’ তিনি অর্জন করেছেন কি—না, সর্বোপরি তাঁর ঘোষণা ঘটনা প্রবাহকে কিভাবে ও কতটা প্রভাবিত করেছে এবং তাঁর ঘোষণার জের ধরেই ‘স্বাধীনতা’ অর্জিত হয়েছে কি—না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় চলে আসে।
মরহুম হান্নান কিংবা সেদিনের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের ঘোষনা যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য যথেষ্ট হতো, তাহলে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের সেদিন জিয়াউর রহমানকে মাথায় তুলে নেবার প্রয়োজন হতো না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় এবং সেভাবে বেশ কিছু দলিল পত্রও দাঁড় করানো হয়েছে যে, শেখ সাহেবে ২৬ মার্চ ভোররাতে গ্রেপ্তার হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে এত কষ্ট করে হান্নান সাহেবকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
শেখ সাহেব ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন, এই কথাটির ভেতর কি কোন বড় রকমের ফাঁক রয়েছে? আর সে ফাঁক পূরণ করা যাচ্ছে না বলেই কি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এমন হন্যে হয়ে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে পাশ কাটাবার পথ খুঁজছেন?
এবার শেখ সাহেবের ২৬ মার্চ তারিখের কথিত ঘোষনাটি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। শেখ সাহেবে কিভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন? এ ব্যাপারে এ যাবৎ যেসব ভাষ্য পাওয়া গেছে তা নিম্নরুপ:
১। শেখ সাহেব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে পিলখানার বিডিআর—এর ওয়ারলেস অপারেটরের মাধ্যমে তাঁর স্বাধীনতার আহবান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচার করেন।
২। শেখ সাহেব চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীকে টেলিফোনে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বলেন।
৩। শেখ সাহেব চট্টগ্রামের হান্নান সাহেবকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বলেন। (জহুর আহমদ চৌধুরী এবং হান্নান সাহেবদের সম্পর্কে তখন এমনই ছিল যে, একজনের কাছে সংবাদ পাঠালে অন্য জনের তা জানার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।)
৪। শেখ সাহেব ঢাকার টেলিফোন ভবনের অপারেটরের মাধ্যমে স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেন।
৫। শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি বহিঃসমুদ্রে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। চট্টগ্রামে রেলওয়ে বিল্ডিং এর ওয়ারলেস অপারেটর তাঁর যন্ত্রে এই ঘেষণা ধরতে পারেন এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের পেঁৗছে দেন।
৬। সিলেটের মরহুম কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এই লেখককে ১৯৭৩ সালে একটি টেলিগ্রামের কপি দেখিয়ে বলেছিলেন, শেখ সাহেব ২৫ তারিখে তাকে টেলিগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন।
এই ছয়টি বক্তব্যের মধ্যে কোনটিকে আমরা সঠিক মনে করবো?
স্বাধীনতা ঘোষণা বলতেই বা আমরা কি বুঝবো? একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করতে হলে সেই ঘোষণার আইনগত ও বাস্তবসম্মত ভিত্তি থাকা অত্যাবশ্যক। তাছাড়া স্বাধীনতা ঘোষণার একটি বিশ্বজনীন ফরম্যাট আছে। শেখ মুজিব তাঁর সেইদিনের অবস্থানে থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেভাবেই করতেন।
উপরের ছয়টি বিভিন্নমূখী দাবীর কোনটাই তা পূরণ করে না। স্পষ্টতঃ এর সবই ২৫ শে মার্চের কালরাত্রির পর যে লক্ষ্যহীনতা ও দিশাহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করে কিছু একটা করে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভিন্ন অংশের প্রাণবন্ত প্রয়াসের বহিঃপ্রকাশ।
এখন দেখা যাক, ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে ২৬ মার্চ রাত ১.৩০ মিনিটে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শেখ সাহেব কি করেছেন এবং ঐ সময়ে তাঁর তরফ থেকে কোথায়ও কোন বাণী আদৌ প্রচার করা হয়েছিল কি না।
২৫ শে মার্চ সন্ধ্যার পূর্বেই ঢাকা শহরের সর্বত্র রটে যায়, আজ রাতে ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। সন্ধ্যার পর থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছাত্ররা ব্যারিকেড তৈরী করতে থাকে। সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতারা বারংবার ধর্ণা দিয়েছেন শেখ সাহেবের ধানমন্ডির বাসভবনে। তাজউদ্দিন, জেনারেল ওসমানী সবাই তাঁকে অনুরোধ করেছেন ঢাকার বাইরে চলে যেতে। কিন্তু তিনি তাতে রাজী হননি। তিনি পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়ে কারাবরণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাতে দশটা পর্যন্ত শীর্ষ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার তাঁর সাথে কথা বলেছেন। তার প্রশান রয়েছে শেখ মুজিবের নিজের ভাষায়—‘আমি বাড়িতেই ছিলাম। আমার সন্দেহ ছিল না যে, ইয়াহিয়া আমাকে গ্রেপ্তার করতে চাইছেন ..... আমার গ্রেপ্তারের পূর্বে সকল রাজনৈতিক নেতাদের আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি।’— (ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকার।)
শেখ মুজিব রাত ১০টা পর্যন্ত দলীয় শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। তাদের কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা করতে বলেন নি। স্বাধীনতার কোন ঘোষণাপত্রের মুসাবিদাও তৈরী করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় ২৬ শে মার্চ। বলা হয়, ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টায় গ্রেপ্তার হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। অর্থাৎ ২৫ শে মার্চ রাত বারোটার পর এবং ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টার পূর্বে এই দেড়ঘন্টা সময়ের কোন এক সময় শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করতে মনস্থির করলেন এবং হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে ইপিআর—এর ওয়ারলেস অপারেটরকে টেলিফোনে তাঁর ইচ্ছাটা জানালেন এবং তা দেশবাসীকে জানাতে বললেন।
এখানেও একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, ঐ সময় কি ঢাকার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু ছিল?
এই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারতেন শেখ সাহেব নিজেই। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কখনও তিনি কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি। এমনকি রবার্ট ফ্রাষ্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি তাঁর গ্রেপ্তারের পূর্ব পর্যন্ত সব কিছু খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছেন, তার কোথাও তিনি এ ব্যাপারে একটি কথাও বলেন নি। তিনি যদি এ সময় ‘স্বাধীনতা ঘোষনা’ করার মত কোন পদক্ষেপ নিয়ে থাকতেন, তাহলে ১৯৭২ সালে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বসে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের জন্য ঐ কথাটাই তিনি সব চাইতে বেশী শুরুত্বের সাথে তুলে ধরতেন।
উপরের বর্ণনা থেকে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটার পূর্ব পর্যন্ত শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাউকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার কোন নির্দেশ বলেননি এবং ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টায় গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বেও তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা করার কোন নির্দেশ কাউকে দেননি বা দিয়ে যেতে পারেননি।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, মুজিব নগরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৬ শে মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন, এই মর্মে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তার উৎস কি?
এই বিষয়টি নিয়ে মাসুদুল হক তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙন’—এ তথ্য প্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পাকিস্তানী সামরিক অফিসার সিদ্দিক সালিক তাঁর গ্রন্থে ডেইলী টেলিগ্রাফের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ডেভিড লোসাকের ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ পুস্তকের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি বেতার শেখ মুজিবের ক্ষীণ কন্ঠ ভেসে আসছে এবং সে কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
ডেভিড লোসাক ঘোষণাটি স্বকর্ণে শোনেননি। পাকিস্তানের জাঁদরেল গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকও স্বকর্ণে শোনেন নি। কে শুনেছে?
শুনেছেন ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ইউএনআই ও পিটিআই।
এই দুই সংবাদ সংস্থার বরাত দিয়ে ভারতের ইংরেজী দৈনিক দি ষ্ট্যাটসমস্যান পত্রিকা ২৭ শে মার্চ তারিখে শেখ মুজিবের কথিত স্বাধীনতা ঘোষনার বিশদ ‘বিবরণ’ ছাপে। এতে বলা হয়:
‘একটি গোপন রেডিও থেকে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশ নামে পুনঃনামকরণ করেছেন। ............’
মিঃ রহমান এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপন করেছেন।
পরে স্বাধীন বাঙলা (ফ্রী বেঙ্গল) বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ দান কালে মিঃ রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ঘোষনা দেন।
মুজিবুর রহমান তার প্রদত্ত বেতার ঘোষণায় সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, আমরা কুকুর বেড়ালের মত মরবো না, বাংলা মায়ের (মাদার বেঙ্গল) সুযোগ্য সন্তানের মত মরবো।’
রিপোর্টে আরো যোগ করা হয়, ‘স্পষ্টতঃই পূর্ব বাংলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গোপন বেতার কেন্দ্রের এক ঘোষক বলেন, শেখ ঘোষণা করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি জনগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। ..............
মাসুদুল হকের ‘বাঙালী হত্যা ও পাকিস্তানের ভাঙন’ পুস্তকের ১৭৪ পৃষ্টায় এই রিপোর্টটি বিস্তারিত উদ্বৃত হয়েছে। রিপোর্টটি ছাপা হয়েছে ভারত সরকারের তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয় প্রকাশি ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে।
আমরা এখন ১৯৭১ এর ২৫ শে ও ২৬ শে মার্চ শেখ সাহেবের অবস্থান সম্পর্কে যা জানি তার আলোকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারতীয় সংবাদ সংস্থার রিপোর্টার সম্পূর্ণরুপে গুজবের উপর নির্ভর করে এই কাহিনী খাড়া করেছেন। ২৫ শে মার্চের পর বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত লোকমুখে এটাই প্রচারিত ছিল যে, শেখ মুজিব আত্মগোপন করেছেন। অতএব, সেই অবস্থায় তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণাই ছিল স্বাভাবিক। সেজন্যে একটি গোপন বেতার কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল, ভারতীয় সংবাদ সংস্থা তার ব্যবস্থা করেছে ‘উত্তরবঙ্গের কোন এক স্থানে’।
আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল ‘মুজিবনগর’ স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনকালে প্রকাশিত ‘ঘোষণাপত্রে’ স্বাধীনতার এই বানোয়াট বেতার ঘাষণার উল্লেখ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাপত্রে এমন একটি কল্প—কাহিনী সংযোজন না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
এটা যে কল্পকাহিনী, ইতিহাসের অংশ নয়, সে ব্যাপারে তৎকালীন লীগ নেতারা অন্যদের চাইতে বেশী ওয়াকেবহাল ছিলেন। কারণ তারা শেখ সাহেবের অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
মাসুদুল হক এ ব্যাপারে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর দুটো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, জনাব আহমদ ও মিসেস গান্ধী নিশ্চিত ছিলেন যে, শেখ সাহেব ঐ ধরনের কোন বেতার ঘোষনা দেননি।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে মিসেস গান্ধী যুক্তরাষ্টের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভাষণে স্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় বলেন, ‘............ (বাংলাদেশের) স্বাধীনতার ডাক উচ্চারিত হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের পরই, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, এমন কি এখন পর্যন্ত তিনি (শেখ মুজিব) স্বাধীনতার কথা বলেন নি।’ (সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, তথ্য ও প্রচার দফতর, ভারত সরকার)।
১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে জাতির এবং বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন: The brilliant success of our fighting forces and the daily additions to their strength in manpower and captured weapons has enabled the Government of the People’s Republic of Bangladesh, first announced through Major Ziaur Rahman, to set up full fledged operational base from which it is administrating the liberated areas. (Source: Bangladesh Documents Govt. of India)
‘লড়াইরত আমাদের বাহিনীর চমৎকার সাফল্য এবং প্রতিদিন তাদের শক্তির সঙ্গে জনবলের বৃদ্ধি এবং দখলকৃত অস্ত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে যা মেজার জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে প্রথম ঘোষিত হয়, সক্ষম করেছে পূর্ণাঙ্গ অপরেশনাল বেস প্রতিষ্ঠান করতে, যেখান থেকে মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। (অনুবাদ: মাসুদুল হক)।
দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনে তাজউদ্দিন আহমদ স্বয়ং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে জিয়াউর রহমানকেই আমাদের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষক হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
জিয়াউর রহমানের সেই ঘোষনা কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলার ভিত্তি নির্মাণ করেছে তাজউদ্দিন আহমদের এই বক্তব্যের এটাও স্পষ্ট হয়েছে। সংকলন— প্রথম বাংলাদেশ

17/12/2024

বিদেশিদের বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ছে —নৌপরিবহন উপদেষ্টা
নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দেশের বন্দর অবকাঠামোর উন্নয়ন ও জাহাজ শিল্পসহ মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশিদের বিনিয়োগের আগ্রহ বাড়ছে। রোববার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শিপিং রিপোর্টার্স ফোরাম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন। উপদেষ্টা আরও বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন দপ্তর/সংস্থা’র বাস্তবায়িত প্রকল্পসমূহের কার্যক্রম জনগণের জন্য উন্মুক্ত আছে। বর্তমান সরকার জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করছে, তাই জনগণের জানার অধিকার আছে সরকার তাদের জন্য কী উন্নয়ন করছে। সকল কার্যক্রম ও এ সংক্রান্ত তথ্য জনগণের জন্য অবারিত ও উন্মুক্ত থাকবে। ড. সাখাওয়াত বলেন, মোংলা বন্দরের একটি প্রকল্পে নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে ২৭১ কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় কমানো সম্ভব হয়েছে যা নতুন এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। বিগত সময়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন থেকে জনগণের জন্য কল্যাণকর ও দেশের আমদানি—রপ্তানির সুবিধার জন্য যা করা প্রয়োজন সেটাই বাস্তবায়ন করা হবে।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেইনার জট কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ডকইয়ার্ড নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নৌপথে যাত্রী ও মালামাল বহণের সুযোগ—সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বিগত ৫৩ বছরে দেশের বন্দরগুলো পরিচালনায় জাতীয় কোনো কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্দরগুলোর কার্যক্রম সমন্বিতভাবে গতিশীল করার লক্ষ্যে ন্যাশনাল পোর্টস স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এ কার্যক্রমে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের পাশাপাশি মোংলা সমুদ্রবন্দরকে গ্রীন পোর্টে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার সকল প্রকল্পের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন কমিটি গঠনপূর্বক নিয়মিত প্রকল্প পরিদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন সরকার থেকে ঋণ গ্রহণ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ সরকারকে পরিশোধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলেও জানান তিনি। সুত্র—ইন্টারনেট

Address


Telephone

+8801708577492

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Dainik Uttara posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Dainik Uttara:

Videos

Shortcuts

  • Address
  • Telephone
  • Alerts
  • Contact The Business
  • Videos
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share