26/04/2022
১) ASM Fakhrul Islam নামের একজন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশী গতকাল তার ফেসবুকে একটা বিতর্কিত পোস্ট দিয়েছেন যেটা বাংলাদেশী ফেসবুক ব্যাবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃস্টি করেছে। ভদ্রলোকটি তার পোস্টে লিখেছেন যে, তার স্ত্রী "মেয়েদের মেন্টাল সাপোর্ট" নামের একটা প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপের মেম্বার এটা জানতে পেরে তিনি তার স্ত্রীর মোবাইল থেকে গোপনে সেই গ্রুপে ঢুকেছিলেন সেখানে কিধরনের জিনিস নিয়ে মেয়েরা আলোচনা করে তা দেখার জন্য। কিন্তু গ্রুপে প্রবেশ করে তিনি নাকি দেখতে পেয়েছেন যে, সেখানে কোনো মেয়ে যদি তার দাম্পত্য সমস্যা বা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ( Domestic Violence) বা পার্টনার এবিউজ (Partner's Abuse) সংক্রান্ত কোনো সমস্যার কথা শেয়ার করেন তখন অন্যান্য নারী গ্রুপ মেম্বাররা প্রায় ব্যাতিক্রমহীনভাবে সেই পোস্টদাতা নারীটিকে ডিভোর্স করে ফেলার পরামর্শ দিয়ে থাকে। এরকম বেশকিছু মন্তব্য দেখার পর ASM Fakhrul Islam নামের প্রবাসী ভদ্রলোকটি এই সিদ্ধ্বান্তে পৌছেছেন যে-
"ফেসবুক এসে পৃথিবীতে যত সমস্যা তৈরী হয়েছে তার একটি হচ্ছে মেয়েদের নিজেদের মধ্যে ইন্টারএক্ট করার এনহ্যান্সড ক্যাপাসিটি। অথচ একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে মেয়েরা মেয়েরা কথাবার্তা মিনিমাম রাখার কোনো বিকল্প নাই"!
এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী আরেকটি পোস্টেই তিনি নিশ্চিত করেছেন যে ইতিমধ্যেই তিনি তার স্ত্রী'কে এই ধরণের গ্রুপে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন।
(আলোচ্য পোস্টটির লিংক এবং স্ক্রিনশট প্রথম কমেন্টে)
ফেসবুকে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক এই ধরণের পোস্ট নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই পোস্টটি বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পোস্টদাতা ভদ্রলোকটির প্রোফাইল ইনফোতে লেখা আছে তিনি আমেরিকান একটি ইউনিভার্সিটির এডজাংট প্রফেসর ( Adjunct Professor), আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এবং বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলিনাতে পিএইচডি করছেন।
এই গবেষক ভদ্রলোকটি, কয়েকজন নারীর কিছু মন্তব্য পাঠ করেই এরকম চুড়ান্ত সিদ্ধ্বান্তে পৌছেছেন যে, নারীরা মানুষ হিসেবে এতোটাই বাজে যে, কাওকে ( যথা নিজের স্ত্রী বা কন্যা) ভালো রাখতে হলে, সুপথে রাখতে হলে, তাকে অন্য নারীদের সাথে কম মিশতে দিতে হবে। ফেসবুক আবিস্কার হওয়ায় নারীরা এখন অন্য নারীদের সাথে বিস্তৃত মাত্রায় যোগাযোগ করার এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ পেয়েছেন - এই ব্যাপারটি পৃথিবীর শান্তি-শৃংখলা পরিস্থিতির জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে মর্মে তিনি মনে করেন।
এতোদিন আমাদেরকে বলা হয়েছিলো নারীরা বেগানা পুরুষদের সাথে অতিমাত্রায় কথাবার্তা বললে পৃথিবীতে গোলযোগ সৃস্টি হতে পারে। কিন্তু, এই বিশিষ্ট 'এডজাংট'টি এখন আমাদেরকে এক নতুন উদ্বেগের দুঃসংবাদ দিচ্ছেন! এই চাঞ্চল্যকর প্রস্তাবনা সম্বলিত পোস্টটি যেরকম উদ্যম আর উল্লাস নিয়ে সমমনা/সহমত পুরুষ ভাইয়েরা শেয়ার দিয়ে যাচ্ছেন (ইতিমধ্যে পোস্টটি কয়েক হাজারবার শেয়ার হয়েছে) তাতে করে বুঝা যাচ্ছে যে এটি শুধু এই বিশিষ্ট এডজাংক্ট প্রফেসরেরই মনের কথা নয় বরং বাংলাদেশের লাখোলাখো পুরুষেরও মনের কথা!
একাধারে নারীসঙ্গ পাবার জন্য এমন মরিয়া আবার নারীসংঙ্গ না পেয়ে এমন ফ্রাস্টেটেড, নারীর প্রতি এমন গন-বিদ্বেষ ( Mass Histility), এমন গন-কদর্য দৃস্টিভঙ্গী পৃথিবীর আর কোনো দেশের পুরুষদের মধ্যে এতো অধিকমাত্রায় আমি দেখিনা। নারী-পুরুষের সম্পর্কের অসুস্থতায় বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর মধ্যে অদ্বিতীয়।
২) নারীদের কুপরামর্শে অন্য নারীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই নিয়ে পোস্টদাতা ভদ্রলোকটি এতোটাই উদ্বিগ্ন যে তিনি শান্তিপুর্ণ পৃথিবী বিনির্মানে নারীতে নারীতে যেনো বেশী কথা বলার সুযোগ না পায় তার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং এজন্য নারীরা ফেসবুকে কোন গ্রুপের মেম্বার হলো বা কোন পেইজ ফলো করলো সেই বিষয়ে পুরুষদেরকে সদা-সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এটি অবশ্য আমাদের বাংলাদেশী পুরুষদের জন্য নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশের বেশীরভাগ পুরুষই মনে করেন যে 'নারীরা কিরকম পোশাক পরবেন' তা নির্ধারণ করে দেয়ার এখতিয়ার এমনিতেই পুরুষদের আছে, নারীরা কার সাথে মিশবেন, কি ধরনের বই পরবেন, কি ধরনের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত থাকবেন, কি ধরনের মুভি দেখবেন ইত্যাদি সব ব্যাপারেই পুরুষের একটা শাষকসুলভ নিয়ন্ত্রন ও কতৃত্ব থাকা উচিত বলেই মনে করেন বেশিরভাগ পুরুষ! এমনকি নারীরা টেলিভিশনে কি ধরনের চ্যানেল দেখবেন তা নিয়েও বাংলাদেশী পুরুষদের উদ্বেগের শেষ নেই। কিছুদিন পরপরই বাংলাদেশের পুরুষেরা ব্যাপক শোরগোল এবং হইচই করেন এই দাবীতে যে বাংলাদেশে অবিলম্বে স্টার জলসা এবং জি বাংলার সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া উচিত। অতি-উতসাহী একজন এই দাবীতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে একটা রিটও দায়ের করেছেন। যুক্তি হিসেবে তারা দাবী করেন যে, এইসব চ্যানেল দেখে দেখে আমাদের বাংগালী নারীরা নস্ট হয়ে যাচ্ছেন! যদিও পরিসংখ্যান বলছে নস্টের শেষ সীমায় পৌছেছেন বাংলাদেশের পুরুষেরা ( নারীরা নয়)। নারীরা এইসব সিরিয়াল কিভাবে দেখেন (নারীদের পছন্দ/ রুচী এত্তো খারাপ!) এই নিয়ে বাংলাদেশের নারীদেরকে পুরুষের ব্যাপক উপহাস আর তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়! "পাখী ড্রেস না পেয়ে এক কিশোরীর আত্মহত্যা" এরকম বানোয়াট একটা খবরের নীচে পুরুষেরা ঝাক বেধে এই চ্যানেলদুটির মন্ডুপাত করেছেন এবং নারীদের মংগলের জন্য চ্যনেলগুলো অবিলম্বে কেনো বন্ধ করা দরকার সেই সম্পর্কে ধারালো যুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মৌসুমে "ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পুরুষ সমর্থকদের মারামারিতে সারাদেশে ১৩ জন নিহত" এই সংবাদের নীচে স্পোর্টস চ্যানেলগুলো বন্ধ করার দাবী করতে দেখিনা কাওকে, ব্যাটা মানুষের চ্যানেল বলে কথা। আফটার অল, বাংলাদেশের নারীরা নস্ট হয়ে যাচ্ছে!
নারীর পছন্দকে তাচ্ছিল্য করা, নারীর রুচীকে বিদ্রুপ করা, নারীর তৈরী মুল্যবোধকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেটা নিয়ে উপহাস করা যে কতোবড় আগ্রাসন তা বুঝার জন্য যেই ম্যাচ্যুরিটি এবং সংবেদনশীলতা দরকার তা আমাদের পুরুষদের নেই। অনেক আগে ( সেই ১৯২৯ সালে) ভার্জিনিয়া ওল্ফ এই বিষয়ে একটা চিত্তাকর্ষক প্রশ্ন তুলেছিলেন "কে ঠিক করে দিলো গুরত্ব আর অগুরত্বের এই মাপকাঠি যে, এটি একটি গুরত্বপূর্ণ বই কারণ এটি রচিত হয়েছে যুদ্ধ্ব আর ইতিহাস নিয়ে কিন্তু ওইটি একটি ফালতু বই কারণ সেটি রচিত হয়েছে অন্দরমহলের নারীদের আবেগ অনুভুতি নিয়ে? কিংবা ফুটবল খেলা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ফ্যাশনপ্রিয়তা ফালতু ( যদিও দুটোই অনুতপাদনশীল)? কে ঠিক করেছে এই মানদন্ড যে পুরুষ যা করে আর ভাবে তা গুরুত্বপূর্ণ আর নারী যা করে এবং ভাবে তা অগুরত্বপুর্ন আর ফালতু?" ( Virginia Woolf ; A room of one's own, 1929, Hogarth Press, England). পুরুষ তার নিজের উত্তমর্নতা ( Superiority) আর নারীর অধঃমর্নতা ( Inferiority) নিয়ে এতোটাই নিশ্চিত যে তার এই বিশ্বাস এবং এরুপ বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত আচরণসমুহু যে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীর জন্য অবজ্ঞাকর এবং যন্ত্রনায়ক আগ্রাসন তা তার মনে ঘুনাক্ষরেও উঁকি দেয়না। ম্যান্সপ্লেইনিংকেও পুরুষ তার নিত্যদিনের স্বাভাবিক আচড়ণের অংশ বলেই মনে করে। (Mansplaining defined as the practice of a man explaining something to a woman in a way that shows he thinks he knows and understands more than she does).
৩) "নারী নস্ট হয়ে গেলোরে, তাকে পাহাড়া দিয়ে রাখোরে"- নারীর ব্যাপারে পুরুষের এই উদ্বেগের উৎস কোথায়? কেনো পুরুষ মনে করে যে নারীর উপর পুরুষের নীতি-পুলিশিং ( Moral policing) চালানো উচিত?
এরুপ কদর্য দৃস্টিভঙ্গীর কারণ সম্ভবত এই যে, "পুরুষের কল্পনায় নারী হচ্ছে চুড়ান্ত বিকৃত"!
সনাতন, গ্রীক এবং সেমেটিক কিংবদন্তীগুলো (Semetic Myths) ভর্তি নারীর প্রতি অবমাননাকর গালগল্পে। পুরুষেরা দারুন দারুন গল্প বানিয়েছে এসব নিয়ে। Adam ( আদি পুরুষ) তো স্বর্গউদ্যানে আরাম আয়েশে ছিলেন, Eve (আদি নারী) তাকে ফুসলিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল (গন্ধম) খাইয়েছিলেন বলেইনা স্বর্গীয় প্রানী পুরুষের স্বর্গচ্যুতি ঘটলো! নারী মুলত স্বর্গবাসের অযোগ্য!
গ্রিক মিথলোজির আদি নারী প্যান্ডোরা (Pandora)। দেবতা জিউস একটা বক্সে ( Jar/ Box) মহাবিশ্বের সমস্ত জড়া,ব্যাধি, দুর্দশা আর দুঃখ-কস্ট কে আটকে রেখেছিলেন। সেই বাকসোটা তিনি দিয়েছিলেন প্যান্ডোরাকে এবং বলে দিয়েছিলেন "খবরদার এই বাকসো কখোনোই খুলবেনা "। দুর্বল চরিত্রের, চটুল নারী 'প্যান্ডোরা' কৌতুহলবশত সেই নির্দেশ অমান্য করে সেই বাকশো খুলেছিলেন - সেই থেকে এই পৃথিবী ভরে আছে জড়া, ব্যাধি, নিরাশা আর যন্ত্রনায়! সব অনিস্টের মুলে হলো নারী!
মেসোপটেমিয়ান/ জুডাইক মিথোলজির আদি নারী লিলিথ ( Lilith) নিজের কামুক স্বভাবের কারনে এডামের অবাধ্য হয়ে অভিশপ্ত হয়েছিলেন এবং পৃথিবীর জন্য বয়ে এনেছিলেন গোলযোগ আর বিশৃংখলা! গ্রিক পুরাণের মেডুসা (Medusa) থেকে শুরু করে হিন্দু পুরাণের মনসা দেবী আর সুপর্নখা ইত্যাদি নারী চরিত্রগুলো এতোটাই ভয়ানক, কামুক, করাপ্টেড যে, পড়তে গেলেই মনে হবে পুরুষের অবচেতনের ভীতিই তৈরী করেছে এসব নারী চরিত্র। বিশ্বজুড়ে পুরুষদের একটা জনপ্রিয় বিশ্বাস হচ্ছে " ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিলো হেলেন ( নারীর) এর কারনে "!
কিন্তু, ভ্রাতাগন, আসুন আমরা এসব গালগল্প বাদ দিয়ে পরিসংখ্যানের দিকে চোখ ফিরাই। নাকের ডগার লিঙ্গরঞ্জিত গোলাপী চশমাটা খুলে একটু নৈর্ব্যক্তিক ও নিড়পেক্ষভাবে ফ্যাক্টস (Facts) দেখি। বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহে যতোগুলো খুন হয়েছে, যত হত্যা, যত ধর্ষণ, যত ছিনতাই, যতো চাদাবাজি, রাহাজানি, ডাকাতি যত অপরাধ ঘটেছে তার সম্ভবত ৯০% ই করেছে পুরুষেরা। গত এক বছরের বা ১০/২০/৩০ বছরের পরিসংখ্যানও এরকম। বিচারক হিসেবে যতো যতো জঘন্য আর নৃসংস অপরাধের বিচার আমি করেছি আমার জীবনে, তার প্রায় ৯৫% ই করতে দেখেছি পুরুষদের।
পৃথিবীর দিকে তাকান! সারা পৃথিবীর সকল দেশেই জেলখানায় দন্ডিত কারাবন্দিদের ৯০% এর মতো হচ্ছে মহান পুরুষেরা। ইউক্রেনে কে বোমা ফেলে? কারা করেছে প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ? লক্ষ কোটি মানুষ কারা খুন করেছে? কারা ফেলেছে এটম আর নাপাম বোমা? একাত্তর সালে কারা মেরেছে এতো মানুষ? পুরুষেরা! ক্রিস্টেন গিলবার্ট ( Christen Gilbert) আর মায়রা হিন্ডলে ( Myra Hindley) ছাড়া কয়জন নারী সিরিয়াল কিলারের নাম আপনি জানেন? প্রায় ব্যাতিক্রমহীনভাবে সিরিয়াল কিলারেরা সব পুরুষ প্রজাতির। ব্যাটা মানুষ হওয়ার কারনে যেইভাবে আপনারা নিজেদেরকে নৈতিকভাবে উত্তমর্ন (Morally Superior) এবং নারীদেরকে 'সুপথে রাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত' বলে মনে করেন তার কিন্তু কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। যেই Y ক্রোমোজমের বদৌলতে আপনি পুরুষ হয়েছেন এবং নিজেকে খুব উত্তমর্ণ ভাবছেন সেই Y ক্রোমোজম কিন্তু বেশ দুস্ট প্রকৃতির ক্রোমোজম। সাধারণত পুরুষদের ক্রোমোজমের বিন্যাস হলো XY আর নারীদের ক্রোমোজমের বিন্যাস হলো XX. কিন্তু চিকিতসাবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিজ্ঞানীরা গবেষনা করে দেখেছেন যে ভয়ংকর অপরাধী বা স্বভাবগতভাবে আগ্রাসী ও অপরাধপ্রবন মানুষদের ক্রোমোজমের বিন্যাস হলো XYY. অর্থাৎ কোনো কোনো পুরুষের শরীরে একটা বাড়তি Y ক্রোমোজম ( ব্যাটাগিরির ক্রোমোজম) বেশী থাকে এবং তারা প্রায় ব্যাতিক্রমহীনভাবে (Invariably) অভ্যাসগত অপরাধী (Habitual Offender) হয়। আমেরিকার ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি (SuperMax) জেলখানাগুলোতে আটক সবচেয়ে ভয়ানক অপরাধীদের উপর চালানো গবেষনায় এরকমটিই দেখা গেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটা XYY syndrome বা Super Male Syndrome নামে পরিচিত। এমনকি পুরুষের প্রমিন্যান্ট হরমোন যেটা, অর্থাৎ টেস্টোটেরণ হরমোনের (Testestorone Hormone) আচড়নও কিন্তু তেমন একটা সুবিধার না। High Testestorone এর সিম্পটমগুলো কি কি এইটা লিখে গুগলে একটু সার্চ দিলেই জানতে পারবেন যে আগ্রাসী আচরণ বা এন্টি সোশ্যাল বিহেভিয়ার ( Anti Social Behaviour) হচ্ছে উচ্চ মাত্রার টেস্টোটেরণ হরমোনের একটা উপসর্গ। ক্রমিক এবং সহিংস অপরাধীদের বেশিরভাগের শরীরেই উচ্চ মাত্রার টেস্টোটেরণ হরমোনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
তবুও পুরুষেরা ভাবতে পছন্দ করে নারীরা নস্ট হয়ে যাচ্ছে, নারীদেরকে দেখে শুনে রাখতে হবে, মোরাল পুলিশিং করতে হবে, এবং অবশ্যই জনাব ASM Fakhrul Islam এর মতে পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাখার স্বার্থে নারীতে নারীতে কথাবার্তা যেনো নাহয় সেইটাও খেয়াল রাখতে হবে। "অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ"- এই পুর্বানুমান থেকে আমরা সাধারণত কাওকে কাওকে অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করার নির্দেশনা দেই। জনাব ASM Fakhrul Islam এবং তার সহমত পুরুষ ভাইয়েরা, আপনারা কি নারীতে নারীতে মিলে গ্যাং ( Gang) তৈরী করতে দেখেছেন কখনো? সম্ভবত না। কিন্তু কয়েকজন পুরুষকে একত্র হয়ে গ্যাং ক্রাইমে অংশ নিতে নিশ্চই হরহামেশাই দেখে থাকেন! তখন কি আপনাদের এরকম মনে হয় যে পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে পুরুষে পুরুষে কথাবার্তা মিনিমাম রাখা উচিত?
আপনি ( জনাব এস এম ফখরুল ইসলাম) এবং আপনারা (তার লক্ষ লক্ষ সহমত পুরুষ ভাইয়েরা) কি পুরুষদের ফেসবুক গ্রুপে কি ধরণের আলোচনা হয় তা খেয়াল করেননি? পুরুষদেরকে তাদের বন্ধুদেরকে এরকম উতসাহ দিতে দেখেননি "খেয়ে ছেড়ে দাও মামা", দেখেননি কিভাবে পুরুষেরা প্রায়শঃই একে অপরের অপরাধ কাজে রিএশিওর ( Reassure) করে, অথবা 'Man will be Man' বলে পুরুষের আগ্রাসী আচড়নকে নরমালাইজ করে, অথবা ভিক্টিম ব্লেইমিং (Victim Blaming) করে পরস্পরের কাজকে যাস্টিফাই করে। পুরুষের " লকার রুম টক ", "মেন্স টক " নিশ্চই শুনেছেন, পুরুষের "গ্যাং কালচার" বা "মব কালচার" নিশ্চই দেখেছেন। কিন্তু তবুও এরকম কিন্তু আপনাদের কখনো মনে হয়নি যে পুরুষেরা পুরুষদেরকে কুমন্ত্রনা দেয়, সুতরাং পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে পুরুষে পুরুষে কমিউনিকেশান কমিয়ে দেয়া উচিত!
৪) দৃশ্যমান পরিসংখ্যান এবং নারীর কম অপরাধপ্রবণতা সত্বেও পুরুষের কেনো মনে হয় যে নারীরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কেনো মনে হয় নারীরা অন্য নারীদের পরামর্শে উচ্ছন্নে যাচ্ছে' - এটা আসলেই একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার। বৃটিশ আইনজিবী হেলেনা কেনেডি (Helena Kennedy) যেমনটি দাবী করেন যে " A man who kills is a murderer, but a woman guilty of a violent crime becomes a proxy for all that is evil " - পুরুষ অপরাধ করলে সেটা সেই ব্যাক্তির অপরাধ কিন্তু কোনো নারী অপরাধ করলে সেটা সমগ্র নারীজাতের অপরাধ। এই কারনেই সম্ভবত বরগুনার রিফাত হত্যা মামলায় মিন্নি ছাড়াও আরো ৫ জন পুরুষ অপরাধীর মৃত্যুদন্ডের রায় হলেও সমস্ত আলোচনা হয় কেবল মিন্নি কে নিয়ে। সেই ৫ জন পুরুষ খুনীর খবরে কেও মন্তব্য করেনা "পুরুষ জাতটাই খারাপ "। কিন্তু মিন্নির দন্ডাদেশের খবরের নীচে পুরুষদের ঝাকে ঝাকে মন্তব্য পাওয়া যায় " নারী জাতটাই খারাপ "। অন্য ৫ জন খুনীর অপরাধ তাদের ব্যাক্তিগত অপরাধ কিন্তু মিন্নির অপরাধ হয়ে যায় সমস্ত নারী জাতের অপরাধ। রহিম চুরি করলে সেটা হয় "রহিম চোর", কিন্তু রহীমা চুরি করলে সেটা হয় " ইয়াক, নারী জাতটাই চোট্টা"! আমাদের আলোচ্য এডজাংক্ট প্রফেসরটিকে দেখুন না, কি অনায়াসে তিনি একটা গার্লস গ্রুপের কয়েকজন নারীর মন্তব্য পাঠ করে রায় দিয়ে দিয়েছেন মেয়ে জাতটা এতো খারাপ যে, "একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে হলে মেয়েতে মেয়েতে কথাবার্তা সিমীত রাখার কোনো বিকল্প নাই "!
৫) পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নারী - এই সত্যকে কিভাবে উপেক্ষা করবেন? পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্যের, কতৃত্বের বা বিদ্বেষের অনুভুতি লালন করে কেমন আছেন বাংলাদেশের পুরুষেরা? আমার বরাবরই মনে হয় বাংলাদেশের বেশীরভাগ পুরুষই ভীষন অসুখী। এদের বেশীরভাগেরই জীবন কাটে নারীকে শাষন করা গেলো কিনা /হেয় করা গেলো কিনা/ দমন করা গেলো কিনা বা নিয়ন্ত্রন করা গেলো কিনা এই হিশাব নিকাশের জটিল উত্তেজনায়। নারী-পুরুষের প্রকৃত ঐকতানের আনন্দ উপভোগ করার মতো সংবেদনশীল পুরুষ আমাদের এই অঞ্চলে খুব বিরল। বাংলাদেশের পুরুষদের কাছে নারী একাধারে প্রিয়া কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী - কাংখিত এবং ঘৃনীত। এই কারনেই বিদ্বেষ ও হস্টিলিটিমুক্ত হৃদয় নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্য উপভোগ করার যে "নিরুদ্বেগ আরাম" তার সন্ধান আমাদের পুরুষেরা পায়না। কিন্তু নারীদের মধ্যে আমি এরকম প্রচুর দেখেছি যারা উজ্জ্বল ও অবিভক্ত হৃদয়ের অধিকারী এবং প্রকৃতপক্ষেই মননশীল। অবস্থাদৃস্টে মনে হচ্ছে যেনো বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নারীরা চিন্তায় এবং মননে অগ্রসরমান এবং আধুনিক ও উজ্জ্বল হতে পেরেছেন; কিন্তু, তাদেরকে ধারণ করার মতো এবং তাদের যোগ্য সঙ্গী হওয়ার মতো চিন্তায় ও মননে পুরুষেরা আগাতে পারেনি। অন্তত সমসংখ্যায় তো পারেইনি। মনে হচ্ছে যেনো এই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক নারীরা একুশ শতকে প্রবেশ করলেও পুরুষেরা বিশ শতকেই পরে আছে। কেও কেও আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় পৌছে গেছে কিন্তু ফিরে গেছে ১৬শ শতকে এবং বিশ্বাস করছে যে " সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে হলে মেয়েতে মেয়েতে কথাবার্তা মিনিমাম করার ব্যাবস্থা করতে হবে"
এইখানে একটা বিশাল গ্যাপ তৈরী হয়েছে এবং গ্যাপটা দিনদিন বড় হচ্ছে।