08/09/2024
# # # **গল্প: আয়নার পেছনের পৃথিবী**
নিশাত সবেমাত্র নিজের নতুন ঘরে উঠেছে। ঢাকার এই পুরনো বাড়িটা তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছ থেকে পাওয়া। পুরোনো ঘর, লালচে ইটের গাঁথুনি আর কাঠের বড় বড় জানালা—সব কিছুতেই এক ধরনের রহস্যময়তা রয়েছে। প্রথম দিন থেকেই নিশাতের কিছু অদ্ভুত লাগছিল। ঘরটায় ঢুকলেই কেমন যেন একটা ভারী অনুভূতি হয়, যেনো ঘরটা নিজেই একটা জীবন্ত সত্তা।
ঘরের এক কোণে একটা বিশাল আয়না ছিল, যা বেশ পুরনো। আয়নার চারপাশে কাঠের খোদাই করা কাজ, দেখতে যেন অনেক বছর আগের রাজকীয় কোনো কিছুর অংশ। নিশাত প্রথমেই আয়নাটা দেখে অবাক হয়েছিল। এত বড় আয়না সে আগে কখনো দেখেনি।
প্রথম ক'টা দিন সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু তৃতীয় রাতেই নিশাত কিছু অদ্ভুত অনুভব করলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখার সময় মনে হলো, প্রতিচ্ছবিটা যেন একটু অন্যরকম। প্রথমে সে ভেবেছিল, হয়তো আলোর কারণে এমন দেখাচ্ছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর সে দেখতে পেল, তার প্রতিচ্ছবি হালকা হাসি দিল। নিশাত চমকে উঠলো। ও তো হাসেনি! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিচ্ছবিটা আলাদা!
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিশাত পিছিয়ে গেল। কিন্তু প্রতিচ্ছবিটা ঠিকই ওর মতো করে দাঁড়িয়ে রইলো, শুধুমাত্র সেই বিকৃত হাসিটাই তার মুখে লেগে রইলো। নিশাত লাইট বন্ধ করে পালিয়ে বিছানার নিচে ঢুকে পড়ল। কাঁপা কাঁপা হাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে খেয়াল করলো, আয়নার সামনের জায়গাটা আরও অন্ধকার হয়ে গেছে। আয়নার পেছন থেকে যেনো কোনো অদৃশ্য শক্তি ওকে টানতে চাচ্ছে।
পরের দিন নিশাত সব কিছু ভুলে থাকতে চাইল। হয়তো ক্লান্তির জন্য এমনটা দেখেছে—এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। কিন্তু সেদিন বিকেলে আবার কিছু অদ্ভুত ঘটতে শুরু করলো। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে হচ্ছিল, ওর প্রতিচ্ছবি খুব ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সেই প্রতিচ্ছবির চোখদুটো যেনো আরও গাঢ়, আরও গভীর—একটি অজানা, ভয়ঙ্কর সত্যির দিকে ইঙ্গিত করছে।
রাতে যখন পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, নিশাত তখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কৌতূহল আর ভয়ের মিশেলে ও ঠিক করে, আজ রাতে সমস্ত রহস্যের সমাধান করবে। সে মনে মনে শক্ত হলো। আয়নাটার সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ড পর আয়নার মধ্যে তার প্রতিচ্ছবি হালকা হয়ে যেতে থাকে, আর আয়নার পেছন থেকে কুয়াশার মতো কিছু একটার উপস্থিতি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়।
কুয়াশার ভিতর থেকে তার বিকৃত প্রতিচ্ছবি বেরিয়ে আসে। চেহারাটা তার মতোই, কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর, বিকৃত। সে নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি কি জানতে আয়নার পেছনের এই পৃথিবী তোমার অপেক্ষায় ছিল?"
নিশাত চমকে উঠলো। "কে তুমি?" সে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো। প্রতিচ্ছবিটা হেসে বললো, "আমি তুমি। এই আয়না শুধু প্রতিচ্ছবি নয়, এটি অন্য এক পৃথিবীর দরজা, যেখানে আমরা বাস করি। আমাদের পৃথিবী তোমাদের পৃথিবীর উল্টো—অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা। আর আমি এসেছি তোমার জায়গা নিতে।"
নিশাত আতঙ্কিত হয়ে পেছনে সরে যেতে চাইল, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। আয়নার বিকৃত প্রতিচ্ছবিটা সামনে এগিয়ে আসতে থাকে, তার হাত আয়নার কাচ ভেদ করে বেরিয়ে আসে। নিশাত কিছুতেই নিজের শরীর নড়াতে পারছিল না। প্রতিচ্ছবিটা একসময় পুরোপুরি আয়নার বাইরে এসে দাঁড়ায়। আয়নার বাইরে এসেও সে ছিল একই রকম—ভয়ঙ্কর, বিকৃত।
নিশাতের সামনে এসে প্রতিচ্ছবিটা ফিসফিস করে বলল, "তোমার পৃথিবীতে আমার জায়গা হবে। আর তুমি থাকবে এখানে—আয়নার পেছনে, আমাদের মাঝে।"
নিশাত চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। হঠাৎ করেই সে অনুভব করলো, তার শরীরটা হালকা হয়ে যাচ্ছে, যেনো সে ধীরে ধীরে আয়নার ভেতরে টেনে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিচ্ছবিটা তার হাত বাড়িয়ে নিশাতকে স্পর্শ করলো, আর সাথে সাথেই চারপাশের ঘরটা মিলিয়ে যেতে থাকলো।
নিশাত এক ঝলক দেখলো, তার নিজের শরীরটা আয়নার পেছনে আটকে আছে, আর বিকৃত প্রতিচ্ছবিটা হাসতে হাসতে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।
আয়নার পেছনে নিশাতের চারপাশ অন্ধকার, কুয়াশায় মোড়া। সে চিৎকার করছিল, কিন্তু কোনো আওয়াজ হচ্ছিল না। দূরে কোথাও একটা খিলখিল করে হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, যেনো পুরো আয়নার জগৎটা ওর প্রতি বিদ্রুপ করছে।
এরপর থেকে প্রতিদিন নিশাত চেষ্টা করছিল আয়নার বাইরে আসার। কিন্তু আয়নার ভিতরে ওদের নিয়ম আলাদা। যতবারই সে পালানোর চেষ্টা করতো, ততবারই সেই বিকৃত প্রতিচ্ছবিরা ওকে থামিয়ে দিত। ওখানে সময় যেন থেমে ছিল। নিশাত জানত না, বাইরে কতদিন পেরিয়ে গেছে, কিংবা সে আর কখনো মুক্তি পাবে কিনা।
আর এদিকে, আয়নার বাইরে থাকা সেই বিকৃত প্রতিচ্ছবি নিশাতের জীবনে আস্তে আস্তে নিজেকে মিশিয়ে নিতে শুরু করলো। মানুষজন কোনো অস্বাভাবিকতা টের পাচ্ছিল না, কিন্তু নিশাতের ভেতরে এক ধরনের শীতলতা চলে এসেছিল। সে হাসতো, কথা বলতো, কিন্তু তার হাসি আর কথাগুলো সবই ছিল শূন্য, নিস্তেজ।
একদিন রাতে, নিশাতের এক বন্ধু তার বাড়িতে এলো। বন্ধুটি লক্ষ করল, নিশাতের মধ্যে কিছু যেন বদলে গেছে। তার হাসি আর আগের মতো প্রাণবন্ত নয়। সে জিজ্ঞেস করল, "তুই ঠিক আছিস তো?"
নিশাত একটু হাসল। "আমি ঠিক আছি," সে বলল। কিন্তু বন্ধুটির মনে সন্দেহ জন্মাল। আয়নার দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল, নিশাতের প্রতিচ্ছবিটা আবার সেই বিকৃত হাসি দিচ্ছে।
বন্ধুটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নিশাতের ঠোঁটে সেই একই বিকৃত হাসি ফুটে উঠলো।
# # # # **শেষ।**