17/03/2024
#জলপাহাড়ির_গুপ্তধন_রহস্য
ট্রেনে আমাদের উল্টোদিকের সিটের ভদ্রলোককে দেখে শুরু থেকেই বেশ ইম্প্রেসড শ্রীপতিবাবু। ভদেলোকের চেহারা নায়কোচিত আর তার পোশাকে সাহেবিয়ানার ছাপ। ভদ্রলোকের শার্প চেহারা। লম্বা, ফর্সা ক্লিন শেভ করা মুখ, গায়ে ওভারকোট আর মাথায় আবার মানানসই একটা হ্যাট টুপি। যদিও সিটে বসার পর টুপিটা খুলে রাখলেন, তাতে তার ঢেউ খেলানো বেশ কিছুটা কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা কেশরাজিও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। শ্রীপতিবাবু বেশ গদগদ হয়েই আমাকে বললেন, ‘একেবারে বিলিতি গল্পের গোয়েন্দাদের মত চেহারা ভায়া। এমন লোক গোয়েন্দাগিরিতে এলে পসার এমনিতেই হত, শুধুমাত্র চেহারার জোরে’। তবে পুরো ট্রেন সফরে ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে কথা বলা বা পরিচয়ের আগ্রহ দেখাননি, আর আমরাও ওনার সঙ্গে আলাপ করার কোনও সুযোগ পাইনি। কখনও দামী মোবাইলে কিছু পড়ছিলেন, কখনো সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে ছিলেন আবার কয়েকবার মোবাইলে কল করে কথাও বললেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, তাই তিনি বাঙালি কি না বুঝতে পারলাম না, বার কয়েক হিন্দিতে কিছু কথা বললেন। আমাদের দুজনেরই ইংরেজিটা আবার ঠিক অতটা পোক্ত নয় তাই নিজেদের সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টাও করিনি, তবে শ্রীপতিবাবু মাঝে মধ্যেই সপ্রশংস দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আমাকে বারকয়েক বললেন, ‘ইনি সিনেমাতে গোয়েন্দার ভূমিকায় অভিনয় করলেও কিন্তু বেশ জব্বর মানাবে।’
আমরা চলেছি জলপাহাড়ি। উত্তরবঙ্গে এক অরণ্য পরিবেষ্টিত সুন্দর ছিমছাম এলাকা বলেই শুনেছি। আমরা সেখানে যাচ্ছি কারণ আমাদের এই তিনজনের দলের পালের গোদা গোয়েন্দা পারিজাত বসু আমাদের সেখানে দ্রুত ডেকে পাঠিয়েছেন। জলপাহাড়ি সম্বন্ধে যা শুনেছি সবই ফোনে পারিজাতবাবুর মুখে। উনি দিনদুয়েক আগেই সেখানে পৌছেছেন কোনও একটা কাজে। হঠাতই শ্রীপতিবাবুকে কল করে জানিয়েছেন আমাকে সাথে নিয়ে ওখানে পৌছে যেতে। তৎকালেও টিকিট পেতেও হিমশিম খেতে হল। নেহাত শ্রীপতিবাবুর ট্যাঁকের জোর আছে আর রেলের এক বড় অফিসার সম্প্রতি আমার ইনসিওরেন্সের ক্লায়েন্ট হয়েছেন তাই দুইয়ে মিলে একেবারে ফার্স্ট ক্লাস এসি বগির একটা কুপে আমরা একেবারে আমার করে যাচ্ছি। আমাদের উল্টোদিকের দুই সিটে দুইজন পুরুষমানুষ রয়েছেন। একজনের কথা আগেই বলেছি, অন্য ভদ্রলোক নেপালি, থাকেন দার্জিলিং-এ, কলকাতায় ব্যবসার কাজে নাকি মাঝেমধ্যেই আসতে হয় তাকে, চমৎকার বাংলা বলেন, এই ট্রেন সফরে যেটুকু যা কথাবার্তা হল তা ওই জগতলাল তামাং নামের ভদ্রলোকের সাথেই হল।
আমি ওপরের বাঙ্কে একেবারেই শুতে পারি না, ট্রেনের দুলুনিতে মনে হয় খালি পড়ে যাব, তাই শ্রীপতিবাবুকেও বাধ্য হয়েই ওপরের বাঙ্কে শুতে হল। তবে ভদ্রলোকের প্রথম পছন্দ লোয়ার বার্থ হলেও আপারেও দেখলাম দিব্যি ঘুমিয়ে নাক ডাকলেন, বরং আমারই বরাবরের মত ট্রেনে ঘুম এল না। বেশ ভোর ভোরই ট্রেন পৌছে গেল নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে। চারজনেই নামলাম এই স্টেশনে। তামাং ভদ্রলোক আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। সাহেবি কায়দার ভদ্রলোকও দেখলাম স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা কালো স্করপিও গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। আগে থেকেই তার জন্য একটা গাড়ি সেখানে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আমাদের ত পারিজাতবাবুর নিতে আসার কথা। তার কোনও পাত্তা নেই কেন? মোবাইলে তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। মোবাইল সুইচড অফ বলছে। বেশ একটু চিন্তা হতে লাগল। এমনিতেও কুয়াশার জন্য খুব একটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না বেশীদূর পর্যন্ত। সময় সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাও হাল্কা হয়ে আসছিল। তবে চিন্তাটা দুশ্চিন্তায় পরিণত হওয়ার আগে স্বয়ং মূর্তিমান গোয়েন্দা আবির্ভূত হলেন একটি বিক্রম নিয়ে। আমাদের দেখে হাত নেড়ে হেসে এগিয়ে এসে বললেন, ‘যাক মোটামুটি সময় মতই এসে গিয়েছি। আসলে মোবাইলটা যে কখন চার্জ হারিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি, রাস্তায় জিপটা বিগড়োতে আপনাদেরকে কল করতে গিয়ে দেখলাম মোবাইল আর খুলছে না। যাই হোক জিপের ড্রাইভার কোনোমতে একটা গ্যারেজে গাড়ি ঢুকিয়ে সেখান থেকেই এই বিক্রমের ব্যবস্থা করে দিল, এতে করেই ওই গ্যারেজ পর্যন্ত যেতে হবে, ততক্ষণে গাড়ি সারানো হয়ে যাবে আশা করি, তারপর ওই জিপে করেই আমরা চলে যাবো জলপাহাড়ির রাজবাড়িতে’।
পারিজাতবাবুর পরিকল্পনা অনুযায়ীই সফর এগিয়ে চলল, গ্যারেজে পৌছে দেখি জিপ রেডি, তাই আর সময় নষ্ট না করে আমরাও উঠে পড়লাম জিপে। ড্রাইভারের নাম মোহনলাল, বেশ দারুণ গাড়ি চালানোর হাত। রাস্তা যে খুব ভালো তা নয়, কিন্তু জিপের পেছনে বসেও ড্রাইভারের গাড়ি চালানোর হাতের গুণে আমাদের বিশেষ ঝাঁকিনি পোহাতে হল না।
বিক্রমে একটা কথাও বলেননি শ্রীপতিবাবু, জিপে উঠে ভদ্রলোক প্রথম মুখ খুললেন। আমি তখন প্রাণভরে উত্তরবঙ্গের শীতকালীন অপরূপ প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখছি। শ্রীপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন পারিজাতবাবুকে উদ্দেশ্য করে, ‘এইবেলা কেসটা কি বলে রাখুন মশাই, তাহলে আমরাও চেষ্টা করব আপনাকে যথাযথ সাহায্য করতে’।
পারিজাতবাবু হেসে বললন, ‘কেসের ফিফটি পার্সেন্ট সমাধান হয়েই গেছে, বাকি পঞ্চাশ শতাংশ সমাধান করতে হবে’।
‘সে কি মশাই আমাদের আসার আগে একাই ফিফটি পার্সেন্ট সাবড়ে দিলেন?’ গলায় ক্ষোভ নিয়ে জানতে চাইলেন শ্রীপতিবাবু।
পারিজাতিবাবু তার গালের বসন্তের দাগগুলোর ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আসলে ওই ফিফটি পার্সেন্টের জন্যই আমাকে এখানে ডাকা হয়েছিল, সেটা যে এত সহজ হবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি, বাকি ফিফটি পার্সেন্টের ব্যাপারটা এখানে এসে জানতে পেরেছি। অবশ্য সেটার জন্য দিনদুয়েকের বেশি সময় পাবো না। আমার পুরো কাজের সমাধানের দায়িত্ব রয়েছে পাঁচদিনের ভেতর। আসলে এখানে এসে এই জলপাহাড়ির প্রকৃতি দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছি যে ভাবলাম আপনাদেরও এই অছিলায় এখানে ডেকে এনে একটু আউটিং করিয়ে দিই’।
ধোঁয়াশাটা কাটল না, আমি জিজ্ঞেস না করে আর পারলাম না, ‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন ত, নিরেট মগজে এসব প্রবেশ করতে একটু সময় লাগে’।
পারিজাতবাবু হেসে বললেন, ‘আপনি মোটেই নিরেট মগজ নন বাদলবাবু, আপনার খুলির ভেতর থাকা ঘিলু আমার অনেক কেসেই কাজে এসেছে, তবে ব্যাপারটা একটু খুলে বলা অবশ্যই দরকার’, নিজের প্রশংসা শুনে বেশ ভালোই লাগল, পারিজাতবাবু বলতে শুরু করলেন, ‘জলপাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা এক পুরনো এস্টেট। নবাবী আমল থেকেই এই জমিদারির মালিক এখানকার তরফদার বংশ। সেই বংশেরই বর্তমান পুরুষ প্রতাপনারায়ণ তরফদার আমাকে এখানে আসতে বলেন। উনি এবং ওনার পরিবার অবশ্য এখন শিলিগুড়িতে থাকেন কিন্তু ওনার পৈতৃক এই সম্পত্তির এস্টেট এখনও এই জলপাহাড়িতে আছে, উনি আসেনও মাঝেমাঝেই। এখানে ওনার একজন ম্যানেজার এবং কয়েকজন কাজের লোক আছে। হঠাতই পুরনো আমলের কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করে দেবার পরিকল্পনা করেন প্রতাপনারায়ণ। সেইসব করতে গিয়ে ওনার প্রপিতামহের একটা দিনলিপি মানে ডায়রি তিনি পান, সেখানেই একটা গুপ্তধনের কথা যা ওনার পূর্বপুরুষ বাংলার তৎকালীন নবাবের হস্তগত হওয়া থেকে বাঁচাতে লুকিয়ে রেখেছিলেন তাদের ওপর ক্রুদ্ধ নবাবের আক্রমণের ভয়ে। নবাবের সঙ্গে ঝামেলা অবশ্য বিনাযুদ্ধেই মিটে যায় কিন্তু ওই গুপ্তধন লুকানো জায়গা থেকে আর বের করা হয়নি, কারণ এই বংশের সেসময়ের জমিদারের তখন মনে হয়েছিল ওই সম্পদ সামনে আসলে আবারও নবাবী হামলা ঘটতে পারে। তাই সেই সম্পদ আগের জায়গাতেই লুকায়িত রেখে তার একটা নক্সা তৈরি করে রাখা হয় এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সেই নক্সা হস্তান্তর করার কথা বলা হয়। কিন্তু প্রতাপনারায়ণবাবুর প্রপিতামহের পর সেই নক্সা আর হস্তান্তর হয়ত হয়নি, কারণ তার বাপ-ঠাকুর্দা এবিষয়ে তাকে কোনও কথাই জানাননি। যাইহোক সেই নক্সা আর তার সাথে কিন্তু সাঙ্কেতিক সূত্র পেয়ে কিছুটা আনন্দে এবং কিছুটা সংকেতের সমাধান না করতে পেরে দিশেহারা হয়ে প্রতাপনারায়ণবাবু আমাকে ডেকে পাঠান। আমি এখানে এসে অতি সহজেই সেই সংকেতের সমাধান করে ফেলেছি, বাড়ির কাছেই এক পুরনো পরিত্যক্ত ভৈরবী মন্দিরের নীচে লুকানো এক ঘর থেকে সেই গুপ্তধন গতকাল দিনের আলোতেই তুলে আনা হয়েছে’।
শ্রীপতিবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘গুপ্তধন তুলে আনা হয়ে গেছে?’
পারিজাতবাবু আবারও হাল্কা হেসে বললেন, ‘তা হয়েছে, মুঘল যুগের বেশ কিছু রৌপ্য তঙ্কা মুদ্রা পাওয়া গেছে। একটা পুরনো ধাতব বাক্সের মধ্যে সেগুলো রাখা ছিল। কিন্তু ওই সূত্রে যে পরিমাণ গুপ্তধন থাকার ঈঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যা পাওয়া গেছে তার সিকিভাগও নয়। কিন্তু তাতে প্রতাপনারায়ণবাবুর কোনও আপত্তি নেই, যা পাওয়া গেছে তিনি তাতেই খুশি। কিন্তু গণ্ডগোল অন্য জায়গায়। ওই দিনলিপি আর নক্সা পাওয়ার পর থেকেই কেউ তাকে বারবার হুমকি দিয়ে চলেছে, শুধু তাই নয় আমাকে ডাকার আগেই রাজবাড়ির পেছনের জঙ্গলে ওয়ার ম্যানেজার গৌরহরি দাসের ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেছে। তাকে কি কেউ খুন করেছে নাকি কোনও বন্যজন্তুর আক্রমণের তিনি শিকার হয়েছেন তা বলা মুশকিল। বনদপ্তর অবশ্য বলছে এই জঙ্গলে কোনও বাঘের থাকার খবর নেই, তবে জঙ্গলি কুকুর কিছু রয়েছে, তারা দল বেঁধে আক্রমণ করে, আর রয়েছে কিছু শেয়াল। তাদের অতর্কিত আক্রমণের শিকার তিনি হতে পারেন। কিন্তু জঙ্গলি কুকুররাই বা তাকে আক্রমণ করবে কেন? আর তিনিই বা ওই জঙ্গলে কি করছিলেন তারও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এর উত্তর না জেনে এখান থেকে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। প্রতাপনারায়ণবাবুর অবশ্য সন্দেহ তার এক ভাইপোর ওপর। তার নাম জয়নারায়ণ। থাকে দিল্লীতে। কিছুসময় আগেও নাকি সে এই জলপাহাড়িতে এসেছিল। প্রতাপনারায়ণবাবুর বাবা কন্দর্পনারায়ণ কোনও কারণে রাগবশত জয়নারায়ণের বাবা প্রবুদ্ধনারায়ণকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন বংশ থেকে, তাই সম্পত্তির ওপর জয়নারায়ণের কোনও লিগ্যাল রাইট নেই বলেই প্রতাপনারায়ণবাবু মনে করেন। কিন্তু জয়নারায়ণ নাকি এখানে এসে বা কল করে বারেবারে সম্পত্তির অধিকার তার ভাগ চাইছে। আইন-আদালতেও নাকি ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কিন্তু জয়নারায়ণ সেখানেও সুবিধে করতে পারছেন না, তবে কেস এখনও চলছে। কিন্তু তিনি নাকি গোপনে লোক লাগিয়ে এই সম্পত্তি থেকে কিছু জিনিস হাতিয়ে নেওয়ার তালে আছেন। তাই তাকেই প্রধানত সন্দেহ করছেন প্রতাপনারায়ণ, এখানে তার লোক যদি কেউ থাকে এবং সে যদি প্রতাপনারায়ণবাবুর ক্ষতি করার মতলবে থাকে তবে তার পরিচয় প্রতাপনারায়ণবাবুর কাছে ফাঁস করে দেওয়াই আমার কাজ আর সেই কাজটাই বাকি রয়েছে। তবে তার জন্য আর দুইদিনের বেশি সময় আমি পাবো না, আমাকে গুপ্তধন উদ্ধারের পারিশ্রমিক নিয়েই এখান থেকে বিদায় হতে হবে। প্রতাপনারায়ণবাবুর শর্ত সেইরকমই। কোনও কেস অসমাপ্ত ছেড়ে যাওয়া আমার খুবই না-পসন্দ, তাই আপনাদের উপস্থিতিতে এবং সাহায্যে পুরো কেসটাই সমাধান করতে পারি কি না সেই চেষ্টাই করব, আর সেইসঙ্গে অবশ্যই জানার চেষ্টাও করব যে গুপ্তধন কি ওইটুকুই ছিল, নাকি আরও ছিল যেমন সূত্রে বলা ছিল, থাকলে কোথায় গেল সেসব?’
পারিজাতবাবু থামলেন, এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা কিছুটা হলেও পরিষ্কার হল আমার কাছে, শ্রীপতিবাবু দেখলাম ‘হুম’ শব্দ করে কপাল কুঁচকিয়ে বাকিটা পথ গুম হয়ে বসে রইলেন।
জলপাহাড়ি জায়গাটা এককথায় অপূর্ব। যাকে বলে ছবির মতন দৃশ্যপট। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ি জঙ্গল আর তার মধ্যে কিছুটা করে খালি জায়গায় জনবসতি। রাজবাড়িটা ত আরও সুন্দর। হাল্কা জঙ্গল ছড়িয়ে রয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলার রাস্তা, সেটা দিয়ে বেশ ভালোভাবেই লরির মত বড় গাড়িও যেতে পারে, তবে ট্রাফিক এদিকটায় খুব কম। পাশপাশি অবশ্য দুটি জিপের বেশি গাড়ি চালানো যাবে না। তবে যতই জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়ির দিকে গাড়ি এগোলো রাস্তা ততই সরু হয়ে এল, রাজবাড়ির একেবারে সামনে পর্যন্ত পিচের রাস্তা তারপর গেটের ভেতরে কিছুটা মাটির রাস্তা, দুদিকে বাগান। দারোয়ান দরজা খুলে দিল আমাদের গাড়ি দেখে। গাড়ি ভেতরে ঢুকে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত এল। পারিজাতবাবু জিপের সামনের সিট থেকে নামতেই একজন কাজের লোক এগিয়ে এসে আমাদের মালপত্র সহ আমাদেরকেও তাকে অনুসরণ করিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। বাড়ির দোতলার একটা দিক সম্পূর্ণভাবে ব্যবস্থা করা রয়েছে অতিথিদের জন্য। সেদিকের একটা ঘরেই পারিজাতবাবু রয়েছেন, তার পাশের একটা ঘরে আমার আর শ্রীপতিবাবুর থাকার ব্যবস্থা। ঘরে দুটো জানালা, একটা দরজা আর ঘরের দুদিকের দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো দুটো ছোট ছোট কাঠের খাট যার একটা আমি দখল করলাম আর অন্যটা শ্রীপতিবাবু।
বাড়ির কর্তা প্রতাপনারায়ণবাবুর সঙ্গে আলাপ হল দুপুরের দিকে। ভদ্রলোক বোধহয় আশেপাশের গ্রামের দিকে কোথাও গিয়েছিলেন। এমনিতে মার্জিত ব্যবহার কিন্তু ওনার সঙ্গে কথা বলে মনে হল কোথাও যেন একটা চাপা দম্ভ আছে। এমনিতে ষাটোর্ধ চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ যেমন আছে তেমনি শরীরও যথেষ্ঠ সুঠাম। শুধু আমাদের গর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পারিজাতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে গেলেন, ‘আর কোনও নতুন হুমকি আর আসেনি, স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জও জানিয়ে দিয়েছেন যে বনদপ্তরের কথাই ঠিক, গৌরহরি জঙ্গলি কুকুরদের দলের আক্রমণের শিকার, আমার মনে হয় আর কোনও সমস্যা হবে না’। বলেই ভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। পারিজাতবাবু চোয়াল শক্ত করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু প্রতাপনারায়ণ তরফদারের কথার ধরণ দেখে মনে হল উনি আমাদের এখানে আসা আর পারিজাতবাবুর আর থাকাটা ঠিক পছন্দ করছেন না, খুব ভদ্র আর পরিশীলিত ভাবে উনি আমাদেরকে সদলবলে বিদায় নিতেই বললেন। কিছুসময় চুপ করে থেকে পারিজাতবাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘দুপুরের খাওয়ার খেয়ে নিতে হবে, তারপরেই বেরোব, হাতে আর বেশি সময় নেই’।
দুপুরের খাওয়ার পরই আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম জঙ্গলের দিকে। যে জায়গাটায় ম্যানেজার গৌরহরি দাসের বডি পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাটা আমাদের দেখালেন পারিজাতবাবু। তারপর বললেন, ‘বনদপ্তরের একজন লোকই আমাকে এই জায়গাটা দেখিয়েছিল। আমার আসার আগেই গৌরহরিবাবু মারা গিয়েছিলেন, থানায় গিয়ে অফিসার-ইন-চার্জের সঙ্গে দেখা করে আমার পরিচয় দিয়ে আমি ডেডবডির কয়েকটা ছবি দেখেছি তাতে একটা সন্দেহ আমার হয়েছে, গৌরহরিবাবুর গায়ে আঁচড়ের দাগ ছিল অসংখ্য কিন্তু কামড়ের কোনও দাগ ছিল না, জঙ্গলি কুকুরের দল আক্রমণ করলে তারা কি শুধু আঁচড়েই শিকারকে মারবে নাকি ভিকটিমকে কামড়াবেও? বনদপ্তরের অফিসার কিন্তু আমাকে বলেছিলেন কামড়ের ঘাও থাকা উচিৎ, কারণ কুকুরের একটা প্রবণতাই থাকে লাফিয়ে পড়ে শিকারের গলার দিকে কামড়ানোর, কিন্তু গৌরহরিবাবুর বডির ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, তাসত্ত্বেও বনদপ্তর আর পুলিশ কেস ফাইল বন্ধ করার জন্য কুকুরের আক্রমণের তত্ত্বটাকেই মেনে নিচ্ছে’।
শ্রীপতিবাবু কথার মাঝেই এদিক ওদিক ঘুরছিলেন, একটু তফাতে চলে গিয়েছিলেন তিনি, হঠাত একটু দূরের একটা ঝোঁপের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তারপর ওখান থেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখুন ত এটা কি?’ আমি আর পারিজাতবাবু দ্রুত সেখানে পৌছে গেলাম। শ্রীপতিবাবু যে ঝোঁপটার দিকে নির্দেশ করছেন সেইদিকে তাকাতেই দেখা গেল সূর্যের আলো পড়ে কিছু একটা ঝোঁপের তলার দিকে চকচক করছে। পারিজাতবাবু এগিয়ে গেলেন, ঝোঁপের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে ঝুঁকে পড়লেন তিনি, গাছের গোড়ার দিকে মাটির থেকে কিছুটা উঠে থাকা জিনিসটা তুলে আনলেন তিনি। জিনিসটা চকচক করছে, একটা গোল চাকতি, সোনার রঙের, আমি না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, ‘এটা কি সোনার নাকি?’
পারিজাতবাবু উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘নিখাদ সোনা, মুঘল আমলের স্বর্ণমুদ্রা দাম যাকে বাংলায় মোহর বলা হয়, এটা সেই জিনিস। বডি পাওয়ার পর এইদিকে কেউ খুব একটা আসেনি, আগেরদিন এসেও আমার চোখে পড়েনি, শ্রীপতিবাবুর চোখে পড়ল ভাগ্যিস, গুপ্তধনের নক্সায় কিন্তু মোহরের কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু ওই ভৈরবী মন্দিরে আমরা মোহর পাইনি, কিন্তু এই জিনিস এখানে এল কোথা থেকে? দেখতে হবে, চলুন তো ঝোঁপের ওপাশের জমিটা দেখে আসি’। আমরা এগোলাম সেইদিকে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আরেকটা পোড়ো পরিত্যক্ত জায়গা চোখে পড়ল। একটু ফাঁকা জায়গা, তার মাঝে একটা ভাঙা মন্দিরের মত, একপাশে একটা হাঁড়িকাঠ, সেটা এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ধাতব হওয়ায়, কিন্তু মন্দিরের মত জায়গাটা শ্যাওলা ধরে ভেঙে পড়েছে প্রায়। হাঁড়িকাঠের কাছকাছি আসতেই তার গায়ে কিছু লাল ছোপ আমরা দেখতে পেলাম। শ্রীপতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওটা কি মশাই?’
পারিজাতবাবু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রক্ত’।
আমার রীতিমতো গা ছমছম করে উঠল। শ্রীপতিবাবু বললেন, ‘নির্ঘাত এই মন্দিরে নরবলি হত মশাই, তাই এখনও হাঁড়িকাঠের গায়ে রক্তের ছোপ লেগে রয়েছে’।
পারিজাতবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হত নয় শ্রীপতিবাবু, নরবলি এখনও হয়, রক্তের দাগটা খুব বেশিদিনের পুরনো নয়, আর দেখুন আশেপাশের গাছের পাতাতেও কালচে ছোপ রয়েছে, ওগুলোও শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, এখানে কাউকে সম্প্রতি মারা হয়েছে’।
‘কাকে?’ জানতে চাইলাম আমি। পারিজাতবাবু আমার দিকে তাকিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে বললেন, ‘এখানে কোনও কথা নয়, চলুন সামনের দিকে এগিয়ে যাই, ভাঙা মন্দিরের ওপাশে কি আছে দেখি’। আমরা মুখবন্ধ করে সেইদিকে এগিয়ে গেলাম। মন্দিরের ওপাশে গিয়ে দেখলাম জমি ঢালু হয়ে নীচের দিকে কিছুটা নেমে গেছে, যেখানে জমিটা নীচে শেষ হয়েছে সেখানে একদম মাঝখানে কিছুটা জায়গা মাটিচাপা দেওয়া রয়েছে মনে হচ্ছে। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তখনই পেছনে কিছু একটা শব্দ হল, আমরা দ্রুত পিছনে ফিরে দেখলাম, ভাঙা মন্দিরের ওপাশ থেকে শব্দটা এসেছে, আমরা দ্রুত সেদিকে ছুটে গেলাম। সেখানে কেউ নেই, একটু দূরে শুধু জঙ্গলের দিকে কয়েকটা ঝোঁপ নড়ে উঠল মাত্র, কেউ যেন ছুটে গেল ওদিক দিয়ে।
শ্রীপতিবাবু বললেন, ‘জঙ্গলি কুকুরদের কোনওটা এদিকে চলে এসেছিল মনে হচ্ছে, আমাদের দেখে পালিয়ে গেল’।
পারিজাতবাবু এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন, নীচের দিকে, হঠাত তার নজরে একতা জিনিস পড়ল, একটা কিছু পড়ে রয়েছে মাটিতে, তিনি সেটা তুলে নিলেন। আমরা তিনজনেই দেখলাম সেটা একটা হাড় জাতীয় জিনিস, কোনও বন্যপ্রাণীর হাড় দিয়ে তৈরি, অনেকটা ছোরার মত দেখতে, খুব বেশি বড় নয় কিন্তু বেশ ধারালো। পারিজাতবাবু সেটা নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বললেন, ‘হাড়ের তৈরি নখর, এটা দিয়ে কাউকে অনায়াসে আঁচড়ে মারা যায় যা ধার রয়েছে, এরকম বেশ কয়েকটা দিয়ে একসাথে আক্রমণ করলে কিন্তু মনে হবে যে কুকুরের দলই আঁচড় দিয়েছে, নখরের সাইজটাও সেইমত’।
আমি বললাম, ‘তার মানে এটা দিয়েই কি.........’
পারিজাতবাবু বললেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে, তবে একটা নয় অনেক কটা এই জিনিস একসাথে ব্যবহার করা হয়েছে’।
শ্রীপতিবাবু কপালে ভাঁজ তুলে বললেন, ‘তার মানে ওই ঝোঁপের দিকে গেল সে.........’
তাকে থামিয়ে দিয়ে একরকম মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পারিজাতবাবু বললেন, ‘মানুষ, আমাদের ওপর নজর রাখছিল, কোনও কারণে অসাবধানতা বশত ভাঙা মন্দিরের থামে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওই দেখুন থাম থেকে ইঁট খসে পড়েছে। ইঁট পড়ার শব্দ হওয়াতেই পালিয়েছে আর তাড়াহুড়োতে এটা ফেলে গেছে। আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমাদের অনুসরণ করছে, তাই বাদলবাবুকে ঈশারায় চুপ করতে বলেছিলাম। পরিস্থিতি ভালো নয়, আমাদের এইদিকে আর না থাকাই ভালো। শুনুন ভালো করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আমরা দুইদিকে যাবো। এখানে একটা বাজার রয়েছে, আপনারা দুইজনে যাবেন সেইদিকে, কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে বাজার কোনদিকে, এখানকার আদিবাসীদের হাতের তৈরি কিছু জিনিস সেখানে পাওয়া যায়, দেখাবেন এমন যেন কেনাকাটা করছেন, হাড়ের তৈরি কোনও জিনিস দেখলে জানতে চাইবেন কোন গ্রামে কারা এসব তৈরি করে, আমার মোবাইলে চার্জ দিয়ে নিয়েছি ভালো করে, জায়গার নাম জানতে পারলেই আমাকে কল করে জানাবেন। একেবারে সাথে সাথে, একদম দেরি না করে’।
আমি বললাম, ‘আর আপনি কোনদিকে যাবেন?’
পারিজাতবাবু গলা নামিয়ে সতর্কভাবে বললেন, ‘একবার গৌরহরিবাবুর বাড়ির দিকে যাবো, কাছেই কাজীগ্রামে তার বাড়ি। তার ভাই আছে, দেখি উনি কিছু বলতে পারেন কি না, একটু কথা বলা দরকার, আমি এ বাড়ির দারোয়ানের কাছ থেকে ওনার পরিবারের খবর নিয়েছি, এই লোকটার সঙ্গে গৌরহরিবাবুর খুব খাতির ছিল। তাই ওনার ভাইয়ের সাথে একটু কথা বলা দরকার। আপনাদের বাজারের কাজ হয়ে গেলে আশপাশটা ঘুরে দেখতে পারেন, তবে চেষ্টা করবেন লোকালয়ে থাকতে, ফাঁকা জায়গার দিকে যাবেন না, আমার কাজ হয়ে গেলে বাদলবাবুর মোবাইলে কল করে নেব, জলপাহাড়ির রাজবাড়িতে ফিরব আমরা একসঙ্গেই’। এই বলে পারিজাতবাবু হাঁটতে শুরু করলেন, আমরাও তার পিছু নিলাম। জঙ্গলের বাইরে বড় রাস্তায় এসে পারিজাতবাবু আমাদের বাজারের দিকটা দেখিয়ে নিজে একটা অন্যরাস্তায় দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটা ফেললেন, আমরা বাজারের রাস্তার দিকে কিছুটা এগোতেই একটা সাইকেল ভ্যানরিক্সার স্ট্যান্ড দেখলাম। এই অঞ্চলে যাতায়াতের এই একটাই মাধ্যম। একটা সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে দুজনের বাজারের মুখে চলে আসতে খুন একটা বেশি সময় লাগল না’।
বাজার বলতে শহুরে বাজারের মত নয়, একটা এলাকা জুড়ে আশেপাশের গ্রামের লোকেরা নানারকম জিনিসের পসার সাজিয়ে বসেন সকাল-সন্ধ্যে উভয় সময়েই। কেউ আলাদাভাবে ছাউনি বা ত্রিপল নিয়ে আসেন আবার কেউ কেউ এমনই জিনিসপত্র সাজিয়ে মাটিতেই চাটাই বিছিয়ে বসে যান। সন্ধ্যে বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বাজার চলে, তারপর উঠে যায়। সবজিপাতি, ডিম-মাছ-মাংসের দোকান রয়েছে। আর একদিকে রয়েছে কিছু হাতের কাজের জিনিসের পসরা সাজানো দোকান। আমরা সেইদিকেই গেলাম। বেশিরভাগই কাঠ আর বেতের জিনিস। স্থানীয় লোকেরা সব সবজি আনাজের বাজারের দিকেই, এইদিকটা বেশ ফাঁকা। পর্যটক খুব বেশী নেই। কাছাকাছির মধ্যে দোলপাহাড়ি বলে একটা টিলার মত জায়গা রয়েছে, সেখানে নাকি একটা সার্কিট হাউস বাংলো রয়েছে, সেখানে কিছু পর্যটক এসে থাকেন। তাদের কেউ কেউ এখন বাজারে এসেছেন। হঠাতই একটা পসরার সামনে এসে আমি থমকে গেলাম। কারণ সেখানে কিছু হাড়ের তৈরি জিনিস বিক্রি হচ্ছে, আমি আর শ্রীপতিবাবু এটা সেটা দেখার ছুতোয় জানতে চাইলাম এগুলো কোথায় তৈরি হয়, অল্পবয়সী আদিবাসী দোকানি ছেলেটা জানালো, এসব তৈরি হয় তাদের গ্রামে, জঙ্গলের মাঝে ঝউহাতি বলে একটা গ্রামে এসব তৈরি হয়। ছেলেটি অবশ্য থাকে এই জলপাহাড়িতেই, প্রতি সপ্তাহে একবার নিজের গ্রামে গিয়ে এইসব জিনিস সে নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। ছেলেটির সঙ্গে কথা শেষ করেই আমি পারিজাতবাবুকে কল করলাম। দুইবার রিং হতেই ভদ্রলোক কল রিসিভ করলেন, আমি জানালাম আমাদের কথা, হাড়ের জিনিস তৈরির গ্রামের নাম। পারিজাতবাবু সব শুনে কলটা কেটে দিলেন। শ্রীপতিবাবু একটা হাড়ের বাঁশি কিনলেন আর কিছুটা ঘোরাঘুরি করে আমরা বাজার থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরনোর মুখে মনে হল চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন বেরিয়ে গেল। এক ঝলকের জন্য লোকটার মুখ একটু দেখতে পেলাম। কেন জানি না মনে হল দুপুরে এই লোককে রাজবাড়িতে দেখেছি, তাহলে কি আমাদের পেছনে প্রতাপনারায়ণবাবু ফেউ লাগিয়ে রেখেছেন, কিন্তু কেন? কিসের ভয় তার? তিনিই ত পারিজাতবাবুকে ডেকেছিলেন, তাহলে? তখনই পারিজাতবাবুর কল এল আমার মোবাইলে, আমি রিং বাজতেই দ্রুত কল রিসিভ করলাম, পারিজাতবাবু বললেন, ‘বাজারের কাছের ভ্যানরিক্সা স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করুন, আমি দ্রুত চলে আসছি, পুলিশকেও খবর দিয়েছি, তারাও যথাসময়ে রাজবাড়ি পৌছে যাবেন, জয়নারায়ণ তরফদার এখন এই জলপাহাড়িতেই আছেন’। কলটা কেটে দিলেন তিনি।
রাজবাড়িতে পৌছনোর পর অল্পসময়ে যে আমাদের এত চমক একসঙ্গে পেতে হবে তা আমি আর শ্রীপতিবাবু ভাবতেও পারিনি। পারিজাতবাবুর কল আসার প্রায় মিনিট কুড়ি পর একটা সাইকেলে ভ্যানে করে তিনি সশরীরে এসে উপস্থিত হলেন। ওনাকে রাজবাড়ির লোকের এখানে থাকার কথাটা বলাতে শুধু বললেন, ‘সেটাই স্বাভাবিক’। আমরা তিনজন বাকি পথটা হেঁটেই ফিরলাম। তবে পথে আর কোনও কথা হল না পারিজাতবাবু মুখে কুলুপ এঁটে থাকায়। আমর রাজবাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনে দেখলাম একটা কালো স্করপিও দাঁড়িয়ে। যদিও আমি নাম্বার মনে রাখিনি কিন্তু গাড়িটা দেখে আমার মনে হল সকালবেলা কুয়াশার মধ্যে এই গাড়িটাকেই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আমি দেখেছি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যেতেই আরও চমক। আমি আর শ্রীপতিবাবু শুধু হতবাক হয়ে দেখলাম। কারণ প্রতাপনারায়ণবাবু উত্তেজিতভাবে কারও সঙ্গে কথা বলছেন, আর সেই ভদ্রলোক অন্য কেউ নন, কলকাতা থেকে আমাদের সাথে একই কুপে আসা সেই সাহেবি কায়দার সহযাত্রী ভদ্রলোক, ট্রেনে একবারের জন্যও বাংলা কথা না বললেও এখানে কিন্তু গলা চড়িয়ে সম্পূর্ণ বাংলা ভাষাতেই ঝগড়া করছেন। পারিজাতবাবু আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘ইনিই জয়নারায়ণ তরফদার’, আরও একবার চমকে উঠলাম আমি। ট্রেনের কুপে ওঠার সময় বাইরে টাঙানো লিস্টে বগি আর সিট নাম্বার মিলিয়ে শুধু নিজেদের নামটাই দেখেছিলাম, সহযাত্রীদের নাম দেখিনি, খেয়ালও করিনি। নেপালী ভদ্রলোক নিজে থেকে নাম জানিয়েছিলেন বলে জেনেছিলাম কিন্তু এনার সঙ্গে ত কথাই হয়নি।
প্রতাপনারায়ণ গলা সপ্তমে চড়িয়ে বলছেন, ‘ঠিক আছে জয়, তোমার যখন এতই লোভ তখন আমি যা ওই ভৈরবী মন্দির থেকে পেয়েছি তার অর্দ্ধেক আমি তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এরপর তুমি আর এই সম্পত্তি নিয়ে আমাকে বিব্রত করবে না, সেই মর্মে তোমাকে লিখে দিতে হবে স্ট্যাম্প পেপারে, তা না হলে আমি কিছুতেই তোমাকে ওই গুপ্তধনের ভাগ দেব না, ওই রৌপ্য তঙ্কার অর্দ্ধেক তুমি পাবে না’।
জয়নারায়ণ কিছু বলার আগেই টক করে কথার মাঝে ঢুকে গিয়ে পারিজাতবাবু বলে উঠলেন, ‘শুধু তঙ্কা, আর যে মুঘল দাম মোহরগুলো পেয়েছেন, যার কথা নক্সাতেও লেখা আছে সেগুলোর ভাগ কি হবে?’
পারিজাতবাবুর কথায় প্রথমে চমকে উঠলেন প্রতাপনারায়ণ তারপর হিংস্র হায়নার মত দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘কিসব আজেবাজে বলছেন আপনি? আপনাদের এখান থেকে আগেই ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত ছিল’।
জয়নারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, ‘মোহর?’
পারিজাতবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ মোহর, সোনার মোহর। আমাকে এখানে লোক দেখানোর জন্য ডেকেছিলেন প্রতাপবাবু, আসলে ওই ডায়রির নক্সার সংকেতের মর্মোদ্ধার করেছিলেন প্রতাপবাবু আগেই। সেসব আমি সব বলছি কিন্তু জয়নারায়ণবাবু আগে আমাকে একটা কথা বলুন, আপনি গৌরহরিবাবুকে আপনার ফেউ করে এবাড়িতে পাঠিয়েছিলেন, তাই ত? গৌরহরিবাবু নামেই ম্যানেজার ছিলেন এই এস্টেটের আসলে এখানকার সব খবর তিনিই দিল্লীতে আপনাকে জানাতেন, গুপ্তধনের নক্সার খবরও তিনিই আপনাকে জানিয়েছিলেন আর তাকে কাজে লাগিয়েই আপনি প্রতাপনারায়ণবাবুকে হুমকি দেওয়াতেন, আর আজও আপনি গৌরহরিবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন, তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে কিছু টাকা আপনি দিয়ে আসেন, আমি আপনাকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে দেখেছি, তারপর গৌরহরিবাবুর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আমি আপনার পরিচয় জানতে পারি, এও খবর পাই আপনি রয়েছেন টিলার ওপরের সার্কিট হাউসে আর আজ এখানেও আসবেন’।
জয়নারায়ণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, রামহরি ও ভাই আমার বাল্যবন্ধু, খুব ছোটবেলায় দুজনেই এখানকার এক স্থানীয় স্কুলে পড়েছি। পরে আমি কলকাতার বড় স্কুলে চলে যাই। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব আজও অটুট রয়েছে। ওর দাদা হিসাবে গৌরহরিদা আমাকে আমার অধিকার ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করছিল, আজও আমি এসেছি কলকাতা থেকেই, সেখানকার হাইকোর্টের আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে’।
প্রতাপনারায়ণ রাগে ফেটে পড়ে বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বাসঘাতকতা করছিল সে আমার সাথে.........’
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পারিজাতবাবু বললেন, ‘আর সেই কারণেই আপনি তাকে খুন করালেন, আসলে যে রাতে গৌরহরিবাবু খুন হন সেই রাতেই আপনি আর আপনার লোকেরা ওই ভৈরবী মন্দিরের নীচ থেকে আসল গুপ্তধন সরিয়ে শুধু এক বাক্স রুপোর তঙ্কা ফেলে রেখে বাকি সব মোহরের ঘড়া বা বাক্স সরিয়ে নিয়ে পুঁতে রাখছিলেন ওই পুরনো বলির মন্দিরের পেছনের ঢালু নীচের জমিতে, আপনাদেরকে অনুসরণ করে গৌরহরিবাবুও ওখানে পৌছে যান। কিন্তু উনি আপনার লোকেদের হাতে ধরা পড়ে যান, আপনার লোকেরা তাকে খুন করে ওখানেই, তার রক্ত পড়ে ওখানকার পুরনো হাঁড়িকাঠে আর মন্দিরের সামনের জমিতে। আর তাকে খুন করা হয়েছিল হাড়ের নখর দিয়ে, যে নখর তৈরি হয় ঝউহাতি গ্রামে, আপনার বাড়িতে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে অনেকেই আছে ওই গ্রামের, যেমন আপনার পোষা ভৃত্যদের নেতা বগরু ওই গ্রামেরই ছেলে। সে আর অন্যান্যরা ছিল সেইরাতের খুনে। বগরুর খবর আমি পেয়েছি গৌরহরিবাবুর ভাই রামহরির কাছ থেকে। গৌরহরিকে মারার পর তার দেহটা জঙ্গলের এপাশে ঝোঁপের এদিকে নিয়ে আসে আপনার লোকেরা এটা প্রমাণ করার জন্য যে তিনি শিকার হয়েছেন জঙ্গলি কুকুরের আক্রমণে। কারণ আপনি ভালো করেই জানতেন যে আইনি লড়াইয়ে আপনার অবস্থা ভালো নয়, জয়নারায়ণ আজ নয় কাল তার অধিকার প্রমাণ করবেনই, তাই আগেভাগেই আসল গুপ্তধন সরিয়ে সবার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য আমাকে এখানে ডেকেছিলেন আর সেটাই আপনার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল প্রতাপনারায়ণবাবু’।
‘আর সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্তও আমিই করব’, বলেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত পারিজাতবাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন তিনি, কিন্তু তার আগেই জয়নারায়ণ তার রিভলবার বের করে তাগ করলেন প্রতাপনারায়ণের দিকে। ‘আপনারা কি করে ভাবছেন আমার লোকজন থাকতে আপনারা এখান থেকে জ্যান্ত বেরোতে পারবেন?’ প্রতাপনারায়ণের কথা শেষ হতেই বাইরে সাইরেনের শব্দ শোনা গেল, পুলিশের একাধিক গাড়ি ঢুকে এল ভেতরে, শুরু হল ধরপাকড়, একটু পরেই স্থানীয় দারোগা দলবল নিয়ে ঢুকে এলেন ভেতরে। তারা আসতেই পারিজাতবাবু বললেন, ‘আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিই সত্যের উদ্ঘাটনকে। আপনি মানুষ খুন করিয়েছেন প্রতাপবাবু, আপনি আমার মক্কেল হন আর যেই হোন একজন খুনীকে চিহ্নিত করেও তাকে যদি আইনের হাতে তুলে না দিই তাহলে আমি নিজের চোখেই অপরাধী হয়ে যাবো’। এরপর পুলিশের লোকজন তাদের বাকি কর্তব্য বিনাবাধায় পালন করলেন।
প্রতাপনারায়ণের দেওয়া অগ্রিম সহ তার আতিথেয়তার সব খরচের টাকাও ফেরত দিয়ে দিলেন পারিজাতবাবু। অবশ্য জয়নারায়ণ নিজে এগিয়ে এসে একটা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পারিজাতবাবুর হাতে কিছুটা জোর করে ধরিয়ে দিয়ে আমাদের মনটা খুশি করে দিলেন। শুধু তাই নয় পরের একটা দিন ওই সার্কিট হাউস বাংলোতে জয়নারায়ণের আতিথেয়তায় কাটল বেশ ভালোই, তার পরদিন আবারও তৎকাল টিকিটেই এসি ফার্স্ট ক্লাসে আমরা তিনজন কলকাতা ফিরলাম বেশ হইহই করেই।
জলপাহাড়ির গুপ্তধন রহস্য
_______________________
লেখকঃ দেবাশিস মজ