28/01/2023
ভর্তিতে আনন্দ আপ্লুত, বিদায়ে চোখ ছিল অশ্রুপূর্ণ
আজহার মাহমুদ: সেদিন আর ফিরে পাব না। ম্লান হয়ে গেছে পৃথিবীর প্রবাহে। যদি ফিরে পাওয়া যেত হারানো দিনগুলোকে; তাহলে কতই না ভাল হতো। সময়ের নদীতে বহমান জীবনের স্মৃতি হয়তো তলিয়ে যায় কিন্তু হারিয়ে যায় না। মনের মনিকোঠায় রক্ষিত থাকে ফেলে আসা সময়ের লীলা পদ্ম; ভাসতে থাকে মন যমুনায়, মন পদ্মায় অমূল্য সম্পদ হয়ে। আর তা রয়ে যায় কল্পনার রাজ্যে।
কালোত্তীর্ণ ও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ঐতিহ্যে লালিত এ অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার প্রাচীন বিদ্যাপিঠ আমাদের স্মৃতি ও গৌরবের ধারক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ রদের পর পূর্ব বঙ্গের মানুষের পরম প্রবোধ ও প্রাপ্তি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মনন-মানসিকতা, শিক্ষা-দিক্ষা, চিন্তা-চেতনায় পূর্ব বাংলার পশ্চাৎপদ মানুষ যে আলোর সন্ধান পেয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সেই আলোর একমাত্র দিশারী এই বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় বলতেই আমরা বুঝি, এ স্থানের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের শিক্ষিত সমাজ ও এর শিক্ষার্থীদের একটা আদর্শিক সম্পর্ক, যা একটা জাতির ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি’র মান ও মর্যাদা তুলে ধরে। সে অর্থে রাষ্ট্র বা সমাজের শিক্ষক এবং সমাজকেও অনেকটাই চেনা যায়।
শিক্ষক শুধু শিক্ষার্থীর শিক্ষক নয়, তিনি সমাজ ও জাতির শিক্ষক। কারণ শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা সমাজ এবং জাতির কান্ডারি হিসেবে তার ঝান্ডা বহন করে। শিক্ষার্থীরাই আগামীকালের দেশ ও সমাজ নির্মাতা। রাষ্ট্রের কর্ণধার ও দেশের পরিচালক। এছাড়া সমাজের অনেক মানুষ অনেক সময় বিভিন্ন বিষয়ে সৎ এবং উপযুক্ত পরামর্শের জন্য শিক্ষকদের শরণাপন্ন হয়। এসব দিক থেকে বিবেচনা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব অপরিসীম।
ঘূর্নায়মান পৃথিবীর সময়কালের গণনায় ইংরেজি ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৮৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয়ে পরিচিতি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করি। সেই থেকে শুরু হলো আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ছয় বছরের ছাত্রজীবন। আমার মেধা ক্রমিক নং ছিল ৫৬২। সেদিন ৪৯২ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কালের গর্ভে ভেসে যাওয়া সময় এখনো আমাকে আপ্লুত করে। ঝলমলে আভা ছড়ায়। মনে দোল খায়। ভাবতে ভালো লাগে সেই সব অতীতের কথা। সময় থেমে নেই। নিজস্ব গতিতে বেগমান জীবনধারা সামনে এগুতে থাকে। তবুও নষ্টালজিক অনুভব আমাকে সুখানুভবে আচ্ছন্ন করে। জীবন ও জীবিকার ফাঁকে ও বাঁকে হারানো দিন চুপিসারে বর্তমানের বাস্তবতায় উঁকি মারে। মাঝখানে মস্ত ফারাক, অনেকগুলো বছর সময়ের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। কিন্তু ভাবনার ডানায় উড়তে থাকা অনুভব ফিরে আসে চেতনার আকাশে। চেতনার আম্রকাননে।
কলা ভবনে ভর্তির জন্যে যাই। আমার মাথার চুল বরাবরই বড় ছিল। বেশ অনেক বড়। ভাইভা রুমে ঢুকে বিভিন্ন প্রশ্নবানে জর্জরিত। কলা অনুষদের তখন ডীন ছিলেন সৈয়দ মকসুদ আলী স্যার। এক পর্যায়ে সৈয়দ মকসুদ আলী স্যার আমার বিষয়ে সরদার ফজলুল করিম স্যার বললেন, মকসুদ আলী এই ছেলেটা রাজনীতি করবে, ওর চুল দেখ কত লম্বা! ওকে মুহসীন হলে দিও না। তার পর সলিমুল্লাহ হলে দেখলেন কোন সিট নেই। পরে আমাকে মুহসীন হলেই দিলেন।
এবার সাবজেক্ট চয়েজের বিষয়। আমাকে তারা জানতে চাইলেন কোন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী? কারণ আমার মেধাক্রম ছিল ৫৬২। আমি অবলীলায় বললাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান। সরদার স্যার ও মকসুদ আলী স্যার আমাকে বললেন তোমার স্কোর তো বেশ ভাল। তুমি চাইলে আইন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, লোক প্রশাসন কিংবা ইংরেজী ও অর্থনীতি নিতে পার। এখান থেকেই চয়েজ কর। আমি আবারো বললাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এবার দু'জনই একটু মৃদু রেগে বললেন তুমি একটু চিন্তা করো। বাইরে যাও। পনের মিনিট পরে এসো। এখন ভাবতেও অবাক লাগে উনারা কত উন্নত মন ও মানসিকতার মানুষ ছিলেন।
পনের মিনিট পরে আবার ভেতরে গেলে তারা জানতে চান আমার সিদ্ধান্ত। এবারও আমি অপকটে বললাম স্যার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানই পড়বো। আবারো সরদার ফজলুল করিম স্যার মকসুদ আলী স্যারকে বললেন, ছেলেটা রাজনীতি করবে......। টিক সালাম দিয়ে বের হবার আগে স্যারেরা বললেন সাবধানে চলবে। পরে জানতে পারলাম ওই শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর। তারা দু'জনই খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম পূরণের সময় আবাসিক ছাত্র হিসাবে আমাকে আরেকটি ফরম পূরণ করতে হয়েছিল। আর সেটা হলো হাজি মুহাম্মদ মুহসিন হলে থাকবার অনুমতি চেয়ে হল প্রভোষ্ট বরাবর আবেদন। যদিও আমি হলে তেমন ছিলাম না। আমার ব্যাংকার বড় ভাই আলী আহসান ভাইয়ের বাসাতেই থাকতাম। সেসময় তখন প্রাধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর আবুল হাসেম স্যার। তিনি কোন ডিপার্টমেন্টের ছিলেন তা ভুলে গেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র -ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত যে কোন একটা হলের অঃঃধপযবফ.... স্টুডেন্ট হিসাবে ভর্তি হতে হয়। যারা অনাবাসিক ছাত্র তারা ও হলের পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে।
প্রথমদিন মুহসিন হলের ভিতরে প্রবেশ করে তখনকার লিফট এর সৌন্দর্য আমাকে অভিভূত করেছিল। সময়টা ছিলো জানুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহ। হলে আশে পাশে ও ক্যাম্পাসে অজ¯্র রকমারি ফুলের সমাহার দেখে মুগ্ধতায় আপ্লুত মন ভালো লাগায় টইটুম্বুর হলো।
সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে হাঁটতে শুরু করা সেই নরম মনের ছেলেটি যখন ক্যাম্পাসের চারপাশে ফুটে থাকা বাগানের মধ্যখানে পায়ে চলার পথ ধরে এগোতে থাকলো তখনকার আবেগকে ভাষায় প্রকাশ আজ আর সম্ভব হবেনা।
চারিদিকের বড়বড় গাছগাছালির ছায়াঘন পরিবেশ, ফুলে ছেয়ে থাকা বাগান, সবুজ ঘাসের গালিচা-পাতা মসৃন আর বিশাল মাঠ পেরিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে একসময় হলের অফিস ঘরে পৌঁছে গেলাম। একজন হাউজ টিউটর স্যার আমাকে প্রভোষ্ট স্যারের রুমে নিয়ে এলেন; খুব সহজেই একজন বড় ভাইয়ের বদৌলতে অন্যজনের সাথে থাকবার অনুমতি পেয়ে গেলাম।
হলের নিয়ম-নীতির ব্যাপারে যেমন কঠিন তেমনি কড়া মেজাজে ছাত্রদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখতেন প্রভোষ্ট স্যার। হলে লিফট দেখে আরো একদফা মনটা ভরে উঠলো। তখন ঢাকার হাতে গোনা কয়টা বিল্ডিং এ ছিলো লিফট। ছয়তলা ভবনটি খোলামেলা ও আলো বাতাসে ও ব্যবহারে সকল সুযোগ- সুবিধায় আরামদায়ক। লিফট, সিঁড়ি ও নীচ তালার এককোনায় একটি কেন্টিন বাকি পুরো অংশের অফিস ও অডিটোরিয়াম।
আমাদের সময় মুহসীন হল ও সূর্যসেন হলে ছিল দু'টি লিফট। ছেলেদের এই দুটি হল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন সব সময় আলাদা টেনশনে থাকতেন। কারণ এই দুই হলে রাজনৈতিক কর্মকাÐ বেশী চলতো। আমার খুব কাছের মানুষ ও বন্ধু ক'জন থাকতো মুজিব হলে। একারণে মাঝে মধ্যেই আমি রাতে সেই হলে থাকতাম। অনেক দিন হলের ছাদে গল্প আর আড্ডায় কখন যে রাত পোহাত তা টেরই পেতাম না। ওই হলে সেই আড্ডার সাথীরা এখন পুলিশ ও সরকারের বড় মাপের আমলা। স্ব স্ব মহিমায় তারা উৎসারিত।
পাশেই নির্মাণাধীন স্যার এফ রহমান হল ছিল টিনসেট। সেখানেও আমার অনেক রাত কেটেছে। কখনও পড়া আবার কখনও কখনও আড্ডার ছলে সেই হলেই রাত্রী যাপন হতো। তখনও নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়নি। সিটের স্বল্পতার কারণে এক-ই সিটে দুজন করে থাকার ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য ছিলেন মুহসিন হল প্রশাসন। একই রুমে দুই জনের সিটে হয়ত ৪ কিংবা ৫ জনকে একসাথে থাকতে হতো। সিঙ্গেল রুমে দুইজন। তবে রাজনৈতিক ক্যাডারদের সুযোগ সুবিধা তখনও ছিল এখনও তেমনই আছে।
তৃতীয় বর্ষের এক বড় ভাইয়ের বদৌলতে আমি বেশ ক'বার বিভিন্ন কক্ষে থাকবার অনুমতি পেয়ে যেতাম খুব সহজে। ডাবলিং থাকার ব্যাপারটা ছিলো ভীষণ ভাবে পরাধীন একটা ব্যাপার। নিজস্ব একটা টেবিল নেই, লকারে জামাকাপড় রাখার উপায় কিংবা অনুমতি নেই; এতছোট খাটে অন্যের সাথে শেয়ার করা সত্যি অসহনীয় ছিলো।
অন্যদিকে সিনিয়র জুনিয়ররা মিলে রাত ১০টা পর্যন্ত টিভি রুমে সময় কাটাতাম। সেই একত্রিত হয়ে টিভি দেখার উল্লাস। মাঝে মধ্যে সিনিয়র ভাইয়েরা এসে খবরদারী করতেন। প্রতিবাদ করার উপায় ছিলো না। তখন একমাত্র টিভি চ্যানেলের নাম ছিলো 'বাংলাদেশ টেলিভিশন'। তবে যেদিন ক্যাডাররা টিভি দেখতে আসতো সেদিন অনেক নিরিহ শিক্ষার্থী আর টিভি দেখতো না। বিভিন্ন ছুতাধরে চলে যেতো। প্রথম বর্ষের ছেলেরা আবার কারো কাছে এটা শেয়ার করতে ভয় পেত। সিরিয়াল খুব জনপ্রিয় ছিলো দর্শকদের কাছে। সিরিয়ালের মধ্যে একটির নায়ক শক্তিশালী অতি মানব। সবকিছুতে বিজয়ী হবার প্রবণতা দেখিয়ে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে রাখতো তরুণ প্রজন্মকে। আরেকটি সিরিয়ালের এক তরুণীর অসাধারণ কর্মকান্ড ছিলো উপভোগ্য।
খুব সিরিয়াস কোন মূহুর্তে উপরের ক্লাসের কোন এক ভাই এসে হঠাৎ সুইচ অফ করে আমাদের বিরক্ত করতেন কখনো কখনো। জানতে চাইলে বলতেন আগামীকাল ওনার টিউটরিয়াল ক্লাসে পরীক্ষায় বসতে হবে। টিভি থেকে জোড়ালো শব্দের আওয়াজ মনোযোগে বাঁধা দিচ্ছে। প্রথম বর্ষের ছাত্র তারউপর ডাব্লিং করছি, চুপচাপ হজম করা ছাড়া উপায় ছিলো না।
আমি সিনিয়র রুমমেটদের অনেক আদর পেয়েছি বটে কিন্তু ফরমাশ খাটা থেকে রেহাই পাইনি। এখনও মনে আছে একজন ক্যাডার যিনি বিশেষ একটি জিনিষ কেরী করতেন সব সময়। তিনি বরিশাল অঞ্চলের। তিনি আমাকে ভীষণ আদর করতেন। বলতেন তুই করে। উনার ভাষা মাঝে মধ্যে বুঝতাম না। কারণ বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন। আমাকে মনু বলতেন। আমি ভাবতাম মনে হয় আমাকে আদর করে মনু নাম দিয়েছে। বলতাম ভাই আমি তো মনু নই। উনি বলতেন ''এইয়া তুই বুঝবি না''। আরো অনেক........কিছু।
তিনি কিন্তু মুহসিন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন না। তিনি তার বিশেষ জিনিষটা আমাকে বিশ্বাস করে রুমে রেখে যেতেন। বর্তমানে তিনি একটি মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী। এখনও দেখলে মজা করে বলেন ''মনু, কিরে মনু এইয়া বুঝ''। মাত্র ক'দিনেই অপরিচিত হল ও ক্যাম্পাসের পরিবেশে খাপখাইয়ে নিয়ে একমাস পর সহজ মনে হলো জীবনধারার গতিপ্রকৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রবেশ করার পর স্বাধীন ভাবে চলাফেরার সুযোগটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। ইচ্ছে হলে ক্লাস করবো ইচ্ছে না হলো লাইব্রেরীতে বসে বই পড়বো অথবা লাইব্রেরীর বারান্দায় বসে গল্পে মসগুল হবো, তা নাহলে টিএসির সবুজ মাঠের আকর্ষণে দলবেঁধে কত কথার ফুলঝুরিতে মেতে উঠবো। ঘরে ফেরার বাধ্য বাধকতা অনেকটাই ছিল শিথিল।
আমি বিশ্ববিদ্যালয় ও মুহসিন হলের কথা ভুলতে পারি না। আমার স্মৃতিতে অ¤øান হয়ে আছে। যেদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সেদিন ছিলাম আনন্দ আপ্লুত, গৌরবে মন ও বুক ভরে গিয়েছিল। আর যেদিন স্মৃতিময় বিশ্ববিদ্যালয় ও হল ত্যাগ করি সেদিন আমি ছিলাম বেদনা বিধূর। চোখ ছিল অশ্রুপূর্ণ।
লেখক: আজহার মাহমুদ, সাংবাদিক ও সংগঠক
প্রধান সম্পাদক, ক্যাম্পাসলাইভ২৪ডটকম।