17/12/2024
রাইহাতের স্বপ্নপূরণের গল্প #স্বপ্নশীলন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়েছেন রাইহাত জামান নিলয়। শৈশবের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন এই তরুণ—তিনি এখন গুগলের লেভেল ফোর সাইট রিলেবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার। তার পথচলার গল্প শুনেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম
রাইহাতের স্বপ্নপূরণের গল্প
‘অফার লেটার হাতে পেয়ে মনে হয়েছিল, সারা জীবনের কষ্টের ফল পেয়েছি’, বলেন রাইহাত। এটা পাঁচ বছর আগে কথা। তখন ছিলেন লেভেল থ্রিতে। এখন রাইহাত আছেন সাইট রিলেবিলিটি লেভেল ফোরে।
দুরন্ত শৈশব কেটেছে যশোরে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান রাইহাত। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের সবার আদর ও ভালোবাসায় বড় হয়েছেন। খেলাধুলার প্রতি তার অসম্ভব টান।
মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলতে চলে যেতেন। ১৯৯৯ সালে তার বয়স তখন সবে ছয়ের ঘরে, রাইহাতের ফুফা তখন ছিলেন নকিয়া কম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সে সময়ই ছোট্ট রাইহাত বাবাকে বলেছিল, ‘ফুফার মতো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে চাকরি করতে চাই।’ সেই থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নের শুরু।
প্রাইমারির পাঠ শুরু হয় যশোর সেক্রেড হার্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ভর্তি হন যশোর জিলা স্কুলে, ক্লাস সিক্সে। রাইহাতের বাবা যশোর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সেখানে গানও শিখেছেন রাইহাত। সারা দেশের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে প্রথম, শাস্ত্রীয় (ক্লাসিক্যাল) সংগীতে দ্বিতীয় এবং নজরুলসংগীতে তৃতীয় হয়েছিলেন। সংগীতবিষয়ক পড়াশোনার জন্য ঢাকার ছায়ানটে যোগদানের ইচ্ছাও তার ছিল।
কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেটা হয়ে ওঠেনি।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাশ করেন। ইচ্ছা ছিল বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসই) পড়বেন। কিন্তু সুযোগ পেলেন আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিংয়ে পড়ার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসইতে পড়ার সুযোগ পেয়ে বুয়েট ছেড়ে ভর্তি হন জাবিতে। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ভালো প্রগ্রামার হলে গুগল-ফেসবুকে চাকরি মেলে, এটা জানার পর তার আগ্রহ যায় বেড়ে। সেই থেকে প্রগ্রামিংয়ের পেছনে লেগে থাকা। বহু ব্যর্থতা ও হতাশার মাঝেও হাল ছাড়েননি। এর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রগ্রামিং কনটেস্টে (আইসিপিসি) ঢাকা রিজিওনালের চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের বছর অংশ নিয়েছেন থাইল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ফাইনালে। প্রতিযোগিতায় তাদের দল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়। এ ছাড়াও ২০১৬ সালে ভারতে অমৃতাপুরি রিজিওনাল থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ নিতে আমেরিকায় পাড়ি জমান।
গুগলে চাকরির স্বপ্ন
ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি তার তুমুল আগ্রহ। বিভিন্ন পত্রিকার কম্পিউটার বিষয়ক লেখা পড়তেন। ক্লাস এইটে জানতে পারেন, বুয়েটের কয়েকজন গুগল ও মাইক্রোসফটে চাকরি পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকেও গুগলে চাকরি করা সম্ভব, তখনই প্রথম জানতে পারেন তিনি। জাবিতে এসে শুনলেন, ভার্সিটির মাত্র একজন গুগলে চাকরি করেন। তখনই প্রতিজ্ঞা করেন, দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে গুগলে নিজের নাম লেখাবেন। সেই থেকে গুগলে চাকরির স্বপ্ন বুননের শুরু।
যেভাবে গুগলে
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটি কম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। এর মধ্যেই গুগলে আবেদন করেন, কথা হয় রিক্রুটারের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নেন, মাসখানেক পর ইন্টারভিউয়ে বসবেন। তবে পরের মেইলে রিক্রুটার জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে বসতে হবে ইন্টারভিউয়ে। তাও আবার ভারতে গিয়ে। তখন ভিসা নিয়ে দৌড়ঝাঁপের চাপে প্রস্তুতির সুযোগ মেলেনি। প্রগ্রামিং সলভিং নিয়ে মোট পাঁচটি ইন্টারভিউ হয়েছিল তার। একটি ইন্টারভিউ অনলাইনে হলেও বাকি চারটি দিতে হয়েছিল ভারতের হায়দরাবাদ অফিসে গিয়ে। প্রস্তুতি না থাকলেও বিভিন্ন প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা বেশ কাজে দিয়েছে ইন্টারভিউয়ে। এক দিন পরই রিক্রুটার ফিডব্যাক পজিটিভ বলে জানান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে বলেন। তিন সপ্তাহে ইন্টারভিউ প্রসেস শেষ হয়। কিছুদিন বাদেই ঘটল অপেক্ষার অবসান। সেই অনুভূতিটা অন্য রকম! ‘অফার লেটার হাতে পেয়ে মনে হয়েছিল, সারা জীবনের কষ্টের ফল পেয়েছি’, বলেন রাইহাত। এটা পাঁচ বছর আগে কথা। তখন লেভেল থ্রিতে। এখন রাইহাত আছেন সাইট রিলেবিলিটি লেভেল ফোরে।
গুগলে কাজের অভিজ্ঞতা
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শাখায় শুরু হয় গুগলের সঙ্গে রাইহাতের পথ চলা। গুগল সার্চ অ্যাডস টিমের সদস্য তিনি। কাজ করেন সার্চ রেজাল্টের সঙ্গে সঠিক ও নিখুঁত অ্যাড দেখানোর বিষয়ে। ইউজার এক্সপেরিয়েন্সে যাতে কোনোভাবেই বিঘ্ন না ঘটে, সেদিকে নজর রাখেন। মেশিন লার্নিং আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) কাজে লাগিয়ে রেলিভেন্ট বিজ্ঞাপন দেখানোর বিষয় কাজ তার। প্রগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রে অনেক কিছু নিয়েই তাদের কাজ করতে হয়। যেমন—সি++, পাইথন, এমনকি গুগলের নিজস্ব গো ল্যাঙ্গুয়েজও ব্যবহার করতে হয়। অনেক ট্যালেন্টেড গুগলারদের মাঝে আছেন বাংলাদেশের রাইহাতও। প্রত্যেকেই বেশ সাহায্যপ্রবণ। কেউ কোথাও আটকে গেলে সমাধানের পথ বাতলে দেন। সবার মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব রয়েছে।
নেই ধরাবাঁধা নিয়ম
গুগলে কাজের বড় সুবিধা হলো সেখানে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম বা রুটিন নেই। অফিসের ভেতরেই রয়েছে জিম, সুইমিংপুল। এ ছাড়া গেমরুম, মিউজিক রুম, বিশ্রামের জন্য ন্যাপরুমসহ আছে খাবারের ব্যবস্থাও। ভবিষ্যতে একজন ভালো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজেকে আরো উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান রাইহাত। তার স্বপ্ন, বিশ্বদরবারে সম্মানের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলে ধরা।
সোর্স কালেরকন্ঠ