14/09/2023
ধর্ম এসেছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষকে মুক্তি দিতে এবং একইসাথে কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থের প্রাসাদ ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। সেই ধর্মকেই বর্তমানে নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণের অন্যতম হাতিয়ার বানানো হয়েছে। খোদ ধর্মকে ভিত্ত্বি করেই গড়ে উঠেছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থের ইমারত। কথা ছিল ধর্ম মানুষকে শিক্ষা দিবে ন্যায়ের, উদারতার, সাম্যের ও ত্যাগের, কারণ এই গুণগুলো চরিত্রে ধারণ করাই হচ্ছে ধার্মিকতা। অথচ বাস্তবে সেই ধর্মের অপব্যবহার করে মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে অন্যায়, অসহিষ্ণুতা, ভোগ ও স্বার্থপরতা।
রাজনীতি:
রাজনীতি হবে মানবতার কল্যাণে। জনগণের সেবা, জনগণের উপকার সাধনই হবে রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য। যারা রাজনীতি করবেন, জাতিকে নেতৃত্ব দিবেন অর্থাৎ রাজদণ্ড ধারণ করবেন তারা হবেন ব্যক্তিগত লোভ-লালসা, মোহ ও স্বার্থচিন্তার অনেক ঊর্ধ্বে। তারা হবেন ন্যায়ের ধারক। একজন নির্যাতিত, নিপীড়িত বা হীনবল ব্যক্তি দেশের কোথাও ন্যায়বিচার না পেলেও তাদের কাছে পাবে। সেই ন্যায়কে ধারণ করতে গিয়ে যদি আপন সন্তানকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয় তারা তা নির্দ্বিধায় করবেন। এই হচ্ছে প্রকৃত রাজনীতি। অথচ সেই রাজনীতি এখন ক্ষমতালিপ্সু ও অর্থলিপ্সু একদল প্রতারকের শোষণযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যায়কে অন্যায় বলতে যারা ভয় পান, ন্যায়কে ন্যায় বলে ঘোষণা দিতে যাদের হাঁটু কাঁপে, ক্ষমতাকে যারা আমানত নয় বরং ভোগের বিষয় বলে মনে করে, যারা নিজেকে বিচারের ঊর্ধ্বে মনে করে, তারাই আমাদের সমাজের হর্তাকর্তা, নীতিনির্ধারক, সমাজ পরিচালক ও জাতির নেতৃত্বদানকারী সেজে বসেছে।
অর্থনীতি:
রাষ্ট্রের সবচাইতে স্পর্ষকাতর একটি সেক্টর হচ্ছে অর্থবিভাগ। জাতির অর্থনৈতিক সিস্টেম হতে হবে এমন যাতে সকলেই উপকৃত হয়, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত হয়। কয়েকজনের হাতে সম্পদের পাহাড়, আর অধিকাংশ মানুষের মধ্যে দরিদ্রতা সৃষ্টি না হয়। অর্থবিভাগ পরিচালনা করবেন যারা, অর্থনৈতিক লেন-দেনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকবেন যারা, তারা সর্বদা জাতির কাছে নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করবেন। জনগণের সম্পদকে জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবেন। শত প্রলোভন-প্ররোচনার সামনেও নিজেকে ন্যায়ের উপর স্থির রাখবেন। অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রের এক পয়সাও যদি কেউ পকেটস্থ করে তার অধিকার নেই রাষ্ট্রীয় অর্থবিভাগে দায়িত্ব পালন করার। অথচ আমাদের জাতির সম্পদকে মুড়ি-মুড়কির মত গলধঃকরণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা চুরি হয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে। কি রাজনীতিবিদ, কি আমলা, কি ঠিকাদার, জনগণের অর্থ তসরূপ করার অভিযোগ নাই কার বিরুদ্ধে?
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী:
সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত রাখা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য জনগণের ট্যাক্স থেকে তাদেরকে বেতন দেওয়া হয়। সমাজে নির্যাতিত নিপীড়িত ও শোষিত মানুষ বিপদে-আপদে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পাশে পাবে এটাই স্বাভাবিক। তারা হবে গণমানুষের বন্ধু। তারা অন্যায়ের ভুক্তভোগীকে নিরাপত্ত্বা দিবে এবং অন্যায়কারীকে বিচারের মুখোমুখী করবে। অন্যায়কারী কে, সমাজে তার প্রভাব কেমন, প্রতিপত্ত্বি কেমন এটা তারা দেখবে না। কিন্তু আজ আমরা কী দেখছি? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মানুষ ভয় পায়। মানুষের জান-মালের হেফাজত করার দায়িত্ব যাদের, তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের শেষ নেই। এমন কোনো মাস নেই যে মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতারবাণিজ্য, চাঁদাবাজী, খুন, গুম, নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে না।
শিক্ষাব্যবস্থা:
শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মানসিকতা গড়ে ওঠে। শিক্ষাব্যবস্থা নির্ভুল হলে, সঠিক শিক্ষা পেলে নতুন প্রজন্ম আত্মত্যাগী, সৎ ও নিষ্ঠাবান হয়ে বেড়ে ওঠে, আর শিক্ষাব্যবস্থা ভুল হলে তারা হয়ে ওঠে স্বার্থপর, নীতিহীন। আমাদের শিক্ষাখাতের কী ভয়ানক অবস্থা তা নতুন করে বলার দরকার আছে? মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বের হচ্ছে অনুৎপাদনশীল একটি ধর্মীয় পেশাজীবী গোষ্ঠী, আর সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন একদল স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, ভোগবাদী মানুষ বের হচ্ছে যারা অর্থের কাছে, ক্ষমতার কাছে মাথা বিকিয়ে দিতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করে না। এরাই রাজনীতিতে গিয়ে গণমানুষকে ঠকাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ঢুকে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সেক্টরে ঢুকে কলমের একটি খোঁচায় হাজার কোটি টাকা ‘নাই’ করে দিচ্ছে। ন্যায়-অন্যায়বোধ তাদের নেই, কারণ ছোটবেলা থেকেই তারা ভোগবাদী দর্শন শিখে আসছে- ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।’ সেই গাড়ি ঘোড়াতেই যদি সে না চড়ল তবে লেখাপড়ার অর্থ থাকল কোথায়? ন্যায়কে বিসর্জন দিয়ে হলেও জীবনকে সার্থক করে থাকেন তারা।
সুতরাং-এই যদি হয় একটি জাতির সামষ্টিক চিত্র, ধর্ম যদি হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার, রাজনীতি যদি হয়ে দাঁড়ায় গণমানুষের সাথে প্রতারণার মাধ্যম, অর্থখাত যদি হয় লুটপাটের অভয়ারণ্য, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যদি রক্ষকের বদলে হয় ভক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা যদি হয় ভোগবাদের উপাসক, তবে সেই জাতি আর জীবিত থাকে না। জাতি হিসেবে অনেক আগেই আমাদের মৃত্যু হয়ে গেছে, ব্যক্তি ঠিক থাকবে কী করে? ব্যক্তিরও মৃত্যু হচ্ছে, হবে। সে মৃত্যু হতে পারে রাজনৈতিক কোন্দলে, ছিনতাইকারীর আঘাতে, চাপাতির কোপে, ভেজাল খাবারের বিষক্রিয়ায়, পারিবারিক কোন্দলে, গ্রাম্য হানাহানিতে কিংবা মানবসৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ঘটনায়। অন্যায়পূর্ণ সমাজে লক্ষ-কোটি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েও আমরা নিরাপদ থাকতে পারব না।