05/11/2024
বীভৎস রাতের কান্না!
রাত প্রায় তিনটা, নির্মল আকাশে তারার মেলা বসেছে।পাতার আড়ালে পাখিদের পাখা ঝাপ্টানি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। বারান্দার রেলিং ধরে মৌমিতা নীরব তাকিয়ে আছে দূরে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনটার দিকে।সারারাত ওখানে কুকুরের আনাগোনা চলে। ঐ ডাস্টবিনটার জন্য মৌমিতার ভীষণ মায়া, অন্য রকম অনুভূতি কাজ করে।কতবার মিউনিসিপ্যালটি থেকে লোকজন এসেছিল, তদারকি করে গেছে, এলাকাবাসী যেনো ওখানে ময়লা না ফেলে। দুই পাশের দেয়ালও ভেঙে দিয়েছিলো।তবু্ও কোনো সুরাহা হয় নি।বর্ষায় ঐ রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটা দুর্বিষহ হয়, ময়লার গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। যত যাই হোক, ডাস্টবিনটার জন্য একটা আলাদা টান, ভালবাসা কাজ করে মৌমিতার।
আঁধারের বুক চিরে মৌমিতা ফিরে যায় ৩০ বছর পিছনে।
তিরিশ বছর আগে বিয়ের পরে নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতেই সংসার শুরু হয় তার।শ্বশুরের ভিটা, তখন বাড়িটা এক তলা ছিলো। এল প্যাটার্নের বাড়ি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে বড় উঠোন, তারপর টানা বারান্দার একদিকে চারটা ঘর, আর অন্য দিকে তিনটা। এক সময় হৈচৈওয়ালা একটা বাড়ি ছিলো। কিন্তু বছর দশেকের মধ্যেই দুই ননদ আর একমাত্র ভাসুর বিদেশে পাড়ি জমালেন।মৌমিতারা এখানেই থেকে গেলো শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে। গত দশ বছর আগে শ্বাশুড়ি ও মারা গেলেন। মৌমিতা তিন সন্তানের জননী। বড় দুই বাচ্চা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থাকে। স্বামী,শ্বশুর আর ছোট ছেলেকে নিয়ে কেটে যায় সময়।
ঠিক ১৭ বছর আগে এমনই এক তারাজ্বলা রাত ছিলো। কিন্তু সেই রাতটা মোটেও নিস্তব্ধ ছিলোনা বরং অন্য যে কোনো রাতের চেয়ে ভয়াবহ ছিলো। রাস্তার কুকুর গুলোর মতোই হিংস্র ছিলো কিছু মানুষের আচরণ, অস্হির ব্যস্ততা ছিলো প্রকৃতির, কিছু উৎকন্ঠা ছিলো রাস্তার পাশের দুর্গন্ধযুক্ত ঐ ডাস্টবিনটার!
সেই রাতে কুকুর গুলোর অস্বাভাবিক চিতকারে ঘুম ভেঙে গেলো মৌমিতার স্বামী দিহানের। মাঝে মাঝে মাঝরাতে রাস্তার কুকুরগুলো ডাকে, বীভৎস ভাবে কাঁদে, ঠিক আছে। কিন্তু ঐ বীভৎসতার সাথে যেনো আজকের কুকুরগুলোর হাঁকডাক, চিতকারের বীভৎসতা, গোঙ্গানি একেবারে আলাদা, কোথাও একটা ছন্দপতনের আভাস।
দিহান দরজা খুলে বারান্দায় যায় ব্যাপারটা আসলে কি তা বোঝার জন্য। এমন শব্দে মৌমিতা ও জেগে উঠে বারান্দায় আসে দেখার জন্য। লাইট পোস্টের আলোয় তারা দেখছিলো ৪/৫ টা কুকুর কি যেনো মুখ দিয়ে টানার চেষ্টা করছে আর আশপাশ থেকেই কেমন একটা অদ্ভূত কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কুকুরগুলোও রাগে ক্রমাগত হিংস্র হয়ে উঠছে।দিহান বললো, শুনতে পাচ্ছো কান্নার আওয়াজ? মৌমিতা ভয়ে হীম হয়ে গেছে! ওটা মানুষ নাকি অশরীরী? ওটা কি কোনো মেয়ের কন্ঠ না কি কোনো বাচ্চার? কুকুররা নাকি অশরীরী দেখতে পারে তাই কি এমন অদ্ভূত আচরণ করছে? কিছুক্ষণ পর কান্নার আওয়াজ কিছুটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। নাহ্, আর কোনো শব্দ নেই। একটু বিরতি দিয়ে কুকুরগুলো আবার বিশ্রীভাবে শব্দ, ঘেউঘেউ করতে লাগলো। টেনেহিঁচড়ে একটা বস্তাকে এবার রাস্তায় নিয়ে এসেছে কুকুরের দল।এখন আর কান্না নয় গোঙ্গানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। দিহান বললো, মানুষ নাকি মানুষের বাচ্চা! আধামরা কোনো দেহ নাকি কোনো খুন! যদিও মৌমিতা যথেষ্ট ভয় পাচ্ছে মনে মনে কিন্তু দিহানের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো, ধ্যাৎ! এতোরাতে মানুষ কোথা থেকে পেলে তুমি? নিশ্চয়ই ভূত-পেত্নী। দিহান সন্দিহান।সে মৌমিতার কথা অগ্রাহ্য করেই সদর দরজা খুলে ময়লার ভাগারের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো আর হাঁক ছেড়ে বলতে লাগলো, কে ওখানে? এত রাতে কে কান্না করছে? কে?
মৌমিতা ও স্বামীর পিছে পিছে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, অসম্ভব ভয় লাগলেও কৌতূহল ও যেনো পিছু ছাড়ছেনা।
কাছাকাছি যেতেই মৌমিতা ভয়ে চিতকার করে দিহানের হাত শক্ত করে পেচিয়ে ধরলো। দেখলো বস্তার ভিতরে কিছু একটা নড়ছে, গোঙ্গানির শক্তি ও যেনো আর অবশিষ্ট নেই সেই প্রাণটাতে, দুটো পা বের হয়ে আছে , কুকুর গুলোও বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে প্রায় মৃত জীবটার দিকে।ওরাও হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে, এটা খাবার জিনিস কিনা, কামড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে খাওয়া যায় কিনা!
চট জলদি দিহান রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা লাঠি নিয়ে কুকুর গুলোকে তাড়া করলো আর ইট মেরে দূরে সরিয়ে দিলো।নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে কুকুরের চোখ গুলো তাদের দিকেই নিবদ্ধ। ভয়ে মৌমিতা নড়তে ভুলে গেছে। দিহান বস্তা থেকে টেনে বের করলো একটা বাচ্চা কে। কয়েক ঘন্টা আগেই মনে হয় জন্মেছে হতভাগা , শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন, কাঁদায় লেপ্টে আছে শরীর, ঘন ঘন শ্বাস ওঠানামা করছে।অতটুকুন শরীরটা কুঁকড়ে গেছে শীতে। দিহান কোলে নিল তাকে। বাচ্চাটার পিটপিট করা চোখে করুনা, কষ্ট আর বিস্ময়! লাইটপোস্টের আলোয় বাচ্চাটাকে ভীষণ মায়াবী মনে হচ্ছিলো। আর সেই মায়ার বাঁধনেই আজো জড়িয়ে আছে দিহান-মৌমিতার তৃতীয় সন্তান।