26/12/2024
"সাংবাদিকতা ও রাজনীতির মধ্যে সঠিক সীমারেখা: রাজনৈতিক কর্মী সাংবাদিকদের প্রাধান্য ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের কোণঠাসা অবস্থা"
বর্তমান তথ্যপ্রবাহের যুগে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকতা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, নিরপেক্ষ এবং সঠিক তথ্য প্রদান করে, যার মাধ্যমে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত গঠন করতে সক্ষম হয়। তবে, যখন সাংবাদিকতা রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে চলে আসে, তখন তা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, ভুল ধারণা এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে। এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক, কারণ জনগণ সঠিক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে।
সাংবাদিকতার মৌলিক নৈতিকতাঃ
সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য হলো সত্য প্রকাশ এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। সাংবাদিকতা কখনো কোনো দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত নয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করা, যাতে জনগণ তাদের জীবনযাত্রা, সিদ্ধান্ত এবং প্রয়োজনীয় বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা—এই তিনটি মূলনীতি সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড।
যখন সাংবাদিকরা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে, তারা নিরপেক্ষভাবে ঘটনার চিত্র তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু যখন সাংবাদিকতা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তখন তা সাংবাদিকতার নৈতিকতা এবং জনগণের আস্থার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাংবাদিকতা ব্যবহৃত হলে জনগণ সঠিক তথ্য না পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে সমাজে বিভাজন এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
রাজনীতি ও সাংবাদিকতার সম্পর্কঃ
রাজনীতি এবং সাংবাদিকতা দুটি পৃথক ক্ষেত্র হলেও, তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। রাজনীতি হলো শাসনব্যবস্থা এবং নীতি নির্ধারণের একটি ক্ষেত্র, যা জনগণের কল্যাণকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। অন্যদিকে, সাংবাদিকতা জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানোর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে, যা সরকারের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করে। তবে, যখন এই দুটি ক্ষেত্র একে অপরের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন তা একটি বিপজ্জনক মিশ্রণ তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক নেতারা যদি সাংবাদিকতাকে জনগণের মনোভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করেন, তবে তা জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে, যদি সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ শুরু করেন, তাহলে জনগণ তাদের প্রকাশিত তথ্যের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ সঠিক তথ্যের অভাবে জনগণ তাদের মতামত স্বাধীনভাবে গঠন করতে পারে না।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুশাসনঃ
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জনগণের মতামত প্রকাশের অধিকারসহ সম্পর্কিত। একটি সুষ্ঠু সমাজ গড়তে হলে গণমাধ্যমকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব বা চাপ থেকে মুক্ত হয়ে সংবাদ প্রকাশ করা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যখন গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন এটি সরকারের ভুল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সক্ষম হয়, যা একটি সুশাসিত রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষা ও সচেতনতা: আমাদের দায়িত্বঃ
সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব এবং নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অবশ্যই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ হয়ে কাজ করা উচিত নয়। এই ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি, রাজনৈতিক নেতাদেরও বুঝতে হবে যে গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য পরিবেশন কখনো নিজেদের স্বার্থে বা দলীয় প্রচারে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি শুধুমাত্র জনগণের কল্যাণে এবং সমাজের উন্নয়নে ব্যবহৃত হতে পারে।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাংবাদিকদের নৈতিকতা রক্ষা, দুটি বিষয়ই গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে এবং সমাজে সঠিক তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। এই প্রক্রিয়ায় আমরা একটি সুস্থ, সুশাসিত এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা অটুট থাকবে।
যদি আমরা সাংবাদিকতা এবং রাজনীতির মধ্যে সঠিক সীমারেখা বজায় রাখি, তবে আমাদের গণতন্ত্র, সুশাসন এবং সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। সাংবাদিকতা হোক সত্যের প্রতীক, এবং রাজনীতি হোক জনগণের সেবা—এই আদর্শে চললে, সমাজে বিভাজন এবং অবিশ্বাসের পরিবর্তে একটি সুষম, উন্নত এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।