15/01/2025
পাল্টে যাচ্ছে দেশের নাম। থাকছে না ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। বিদ্যমান ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর স্থলে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ গঠন এবং বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সাম্য, বহুত্ববাদসহ পাঁচটি মূলনীতি করার প্রস্তাব করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে। এছাড়া মূলনীতিতে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করা হয়েছে, যার মেয়াদ হবে চার বছর করে। সংসদের মতো রাষ্ট্রপতির মেয়াদও হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। জীবদ্দশায় দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ ও স্থানীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠিত হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, অর্থপাচারসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কোনো দলের সদস্য হতে না পারা, আইসিটি আইনে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় নির্বাচন হবে। এমনসব সুপারিশ এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত চারটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে।
বুধবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরে বিকালে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পক্ষে আইন, পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান। এছাড়া সংস্কার কমিশনের প্রধানরাও পৃথক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের সুপারিশগুলো তুলে ধরেন। পাশাপাশি তারা ওয়েবসাইটেও সুপারিশমালা আপলোড করেন।
প্রধান উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ সমন্বয় করার জন্য প্রতিবেদন জমা দেওয়া চারটি কমিশনসহ মোট ছয়টি কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিশনগুলো বসে প্রাধান্যগুলো ঠিক করবে। এরপর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হবে। তবে সংস্কার কমিশনগুলো তাদের কাজ আগেভাগে শেষ করতে পারলে ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে সংলাপ শুরুর সম্ভাবনা আছে বলে জানানো হয়।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার সুপারিশে একটি কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। এগুলো হলো : স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর প্রস্তাব, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ ও মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ, সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।
কমিশন তার সুপারিশে জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনাসহ বিধিবদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনায় পরিবর্তন এনে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ পরিবর্তে ‘জনযুদ্ধ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ যুদ্ধের চেতনা এবং ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীনতার আদর্শে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। জনগণের সম্মতি নিয়ে এই সংবিধান ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে।
নাগরিকতন্ত্রের ক্ষেত্রে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ইংরেজি সংস্করণে ‘Republic’, ‘Peoples Republic of Bangladesh’ শব্দগুলো বিদ্যমানের মতো রাখার কথা বলা হয়েছে।
ভাষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র পাশাপাশি নাগরিকদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত সব ভাষা এ দেশের প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশি’ প্রতিস্থাপিত করার সুপারিশ এসেছে। বিদায়ী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে যুক্ত হওয়া সংবিধানবিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতা কমিশন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক ও ৭খ বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে।
সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এই সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিদ্যমান অধিকারের অনুচ্ছেদগুলোর সংস্কার- যেমন বৈষম্য নিষিদ্ধকরণের সীমিত তালিকা বর্ধিতকরণ, জীবনের অধিকার রক্ষায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জামিনে মুক্তির অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ এবং নিবর্তনমূলক আটক-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করছে; একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (National Assembly) ও একটি উচ্চকক্ষ (Senate-সিনেট)। দুটি কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।
এর মধ্যে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে। এর আসনসংখ্যা হবে ৪০০। এর মধ্যে ৩০০ জন একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। বাকি ১০০ জন নারী সদস্য হবেন। এ ক্ষেত্রে দেশকে ১০০টি নির্বাচনি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। সংসদ সদস্য নির্বাচনের বয়স বিদ্যমান ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। সংসদে দুজন স্পিকার থাকবেন, যার একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন।
কোনো নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিক দলের প্রধান একক ব্যক্তি হতে পারবেন না। অর্থবিল ছাড়া সব ক্ষেতে নিম্নকক্ষের সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। সবগুলো স্থায়ী কমিটির সভাপতি হবেন বিরোধীদলীয় সদস্যরা।
উচ্চকক্ষ ১০৫ জন সদস্য থাকবেন, যার মধ্যে ১০০ জন সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবেন। ১০০ জনের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজন সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। বাকি পাঁচটি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবেন।
রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কমপক্ষে সংসদ নির্বাচনে এক শতাংশ ভোট পেতে হবে।
সংবিধানের সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
আন্তর্জাতিক চুক্তির আগে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষ প্রস্তাব পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে।
তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতসহ ভারসাম্য রক্ষায় একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ কাউন্সিলের সদস্য হবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্ন ও উচ্চকক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং তৃতীয় প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠদের মনোনীত একজন সদস্য।
নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষেত্রে এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে।
রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেক্টোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন। আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্য, প্রতিটি ‘জেলা সমন্বয় কাউন্সিল’, ‘সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল’-এর পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন।
রাষ্ট্রপতির মতো প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও হবে চার বছর। কোনো ক্রমেই কেউ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না।
আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। এ সরকারের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৯০ দিন।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জুডিশিয়াল অ্যাপয়েনমেন্টস কমিশন) গঠন করা হবে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দিতে সুপারিশ করা হয়েছে। ‘অধস্তন আদালত’-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় আদালত’ ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি স্থানীয় সরকার কমিশন প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে, যা একজন প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনার ও চারজন কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে। সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হবে বলে সুপারিশ করা হয়।
সাংবিধানিক কমিশন হিসেবে মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন হবে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনগুলোর মেয়াদ হবে ৪ বছর।
জরুরি অবস্থার বিধানাবলি : কেবল এনসিসির সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না।
Via Daily Amar Desh