13/01/2025
ভোজের রাত। জমিদার কৃষ্ণদেবের প্রাসাদে আলোর রোশনাই। আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই এসে পড়েছেন ইতোমধ্যে। বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। এসেছে কৃষকদের উপর অত্যাচারের নির্মম খড়্গ চালানো, শোষণের জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া নীল সাহেবরাও। তারা সব সময়ই জমিদারের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে। কারণ এই জমিদারেরাই তাদের শাসনকে এদেশে সুসংহত করে রেখেছে। এছাড়াও জমিদারদের জলসা বা ভোজ মানেই নির্মল বিনোদন।
নীল সাহেবদের ধারণা ঠিক৷ জমিদারদের ভোজ মানেই বিনোদন। আজকের বিনোদনের উপলক্ষ্য নিম্নবর্গের মণিভূষণ জোলার গর্ভবতী বউ সুমতি বালা।
ভোজের আয়োজন শুরু হলে কৃষ্ণদেবের দেহরক্ষী সুমতিকে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে এনে বসিয়ে দিলো কৃষ্ণদেবের উরুর উপর। সুমতি বসতে চাইল না, বিদ্রোহ করে বসল। কাঁদতে কাঁদতে অনুনয়বিনয় করতে লাগল। তার সতীত্বের দোহাই দিতে লাগল, ঈশ্বর ভগবানের দোহাই দিতে লাগল, দোহাই দিতে লাগল অনাগত সন্তানের। কিন্তু তাতে কারোই মন গলল না। না জমিদারের, না ইংরেজদের, না সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের, না ভগবান ঈশ্বরের। এগিয়ে আসার বদলে সবাই দাঁত বের করে সুমতিকে দেখতে লাগল। যেন একটা খেলা! আর সুমতি সেই খেলার কোনো উপকরণ। বাকিরা দর্শক। কারো কোনো বিকার নেই। এতে উৎসাহ বেড়ে গেল ক্রীড়নক কৃষ্ণদেবের, লকলকে জিহ্বা বের চেটে দিলো সুমতির গাল। যে দু’একজনের মনে একটু দয়ার উদয় হয়েছিল, জমিদারের উৎসাহ দেখে তাতে ভাটা পড়ল। যোগ দিলো হর্ষোল্লাসে। সুমতি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠে যেতে চাইল কিন্তু পারল না। কৃষ্ণদেব বাম হাতে ওর চুলের মুঠি খাঁমচে ধরে ওকে ঠেসে বসিয়ে রেখেছে উরুর উপর। এই বেলায় এসে চিৎকার করে করে সুমতি ভগবানকে ডাকতে লাগল, কিন্তু কোনো আওয়াজ এলো না। এলো শুধু ভোজে উপস্থিত মানুষের বিকৃত হাসির আওয়াজ। সুমতি মনে মনে ভাবল, ভগবান নিশ্চয় তাকে ত্যাগ করেছে; পৃথিবী মনে হয় ফিরে গেছে আদিম যুগে, হঠাৎ ঘুরে গেছে সভ্যতার চাকা। সবকিছু পেছনের দিকে চলতে শুরু করেছে। মানুষজন ধীরে ধীরে জীব-জন্তু হয়ে উঠছে। বনের পশু শিকার পেলে যেভাবে উন্মত্ততা প্রকাশ করে, তেমনিই উন্মত্ততা সে কৃষ্ণদেবের ভোজের অনুষ্ঠানে দেখতে পেল। হাল ছেড়ে দিলো সে, বন্ধ করে দিলো নড়াচড়া। কৃষ্ণদেবের উরুর উপর মূর্তির মতো বসে থাকল।
সুমতি মূর্তি হয়ে গেলে, থেমে গেল ভোজে আগতদের হাসি। বিনা বাঁধায় রাজ্য জয় করে যেমন আনন্দ নেই, তেমনি নির্যাতিত চুপ করে গেলে নির্যাতন করেও আরাম নেই। এতে ক্ষেপে গেলেন জমিদার কৃষ্ণদেব। সুমতির চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে উঠলেন,
‘তুই আমার পায়ের জুতোর ধুলোর যোগ্যও নস। তোর মতো নীচু জাতের কেউ আমার সামনেই আসার সাহস পায় না, সেখানে তোকে কোলে বসিয়েছি। তাতেও তোর এত দেমাগ! আজকে তোর দেমাগ ভেঙে শেষ করে দেবো আমি।’
সুমতির শরীরে তাও নড়াচড়া দেখা গেল না, দেখা গেল না জংলি হরিণীর মতো বিদ্রোহী মনোভাব।
এরই মধ্যে হুগলী নীলকুঠির মালিক উইলিয়াম স্টর্ম বলে উঠলেন, ‘শিকারকে কীভাবে বশ মানাতে হয় তা জমিদার কৃষ্ণদেবের কাছে শেখা উচিত। ছোটো জাতকে কীভাবে উচিত শিক্ষা দিতে হয়, তিনি খুব ভালো করে জানেন।’
আসলে নীলকর সাহেবরা জমিদারের এমন বিকৃত ও অভিনব কায়দায় অত্যাচার দেখে মজা পাচ্ছিল৷ তারা উপস্থিত দেশীয় জমিদার, অমাত্য ও অভিজাত ব্যক্তিদের চোখেমুখে কৃষ্ণদেবের কদাকার কাজকে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছিল। ইংরেজরা জানত, এদেশের জমিদারেরা যত ক্ষমতাশালী হবে, তাদের শাসন তত সুসংহত হবে, মজবুত হবে।
উইলিমা স্টর্মের কথা শুনে খুশি হলেন সরফরাজপুরের জমিদার কৃষ্ণদেব। আগের চেয়েও বেশি উৎসাহে সুমতির গাল চেটে দিলেন─থকথকে লালা আটকে গেল সুমতির নরম গালে। তবুও নড়ল না সে। বসে রইল নির্বিকার।
দর্শকদের কেউ কেউ হেসে ফেলল। কিন্তু কৃষ্ণদেব একে নিজের অপমান হিসেবে দেখলেন। মাথায় রক্ত উঠে গেল তার। এরপর উনি যা করলেন, তা হার মানাল মহাভারতের দুঃশাসনকেও। সবার সামনে দুমড়েমুচড়ে দিলেন সুমতির শরীর।
সুমতি তবুও নড়ল না, চড়ল না। চোখ দিয়ে শুধু গড়িয়ে পড়ল জল। শরীর ভেঙে বেরিয়ে এলো রক্ত।
সুমতির রক্ত, সুমতির কান্না, তার অসহায় করুণ চোখ, গর্ভ থেকে রক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা সন্তান ভোজে উপস্থিত কারও মধ্যে কোনো অনুভূতি জাগাতে পারল না। বরং তারা আরও বেশি আনন্দে ফেটে পড়ল, মদ গিলল, নোংরা জিহ্বা দিয়ে চেটে নিল ঠোঁট।
নীলকর সাহেবরা এই ঘটনাকে দেখল ক্ষমতার নিদর্শন ও নীচু জাতির প্রতি অভিজাতের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন হিসেবে।
প্রকাশিতব্য উপন্যাস তিতুমীর: জান অথবা জমিন থেকে।
পরাগ ওয়াহিদ ভাইয়ের প্রচ্ছদে তিতুমীর প্রকাশিত হবে শিরোনাম প্রকাশন থেকে।