06/09/2024
বাসর রাইতে বৌ বললো, অ্যাই জানো? আমি না খাইতে অনেক পছন্দ করি, তুমি আমারে ডায়েট করতে বলবা না তো?
আমি হাসি। মাথায় হাত রাখি। গুলুগুলু গাল দুটো টেনে আদর করে দিই। পাগলি মেয়ে। ডায়েট করতে বলবো কেন? যত ইচ্ছা খাও, আমার কি আর টাকা পয়সার অভাব আছে?
মিলি আমার কথা বিশ্বাস করে না।বলে, সব ছেলেই বিয়ের রাইতে অমন কথা বলেই। পরে তো ঠিকই মোটকু বলবা। জানি না?
আমি ওকে অভয় দিই। বলি, মেয়ে মানুষ মোটাই আমার পছন্দ। হাড্ডি-গুড্ডির বস্তা একদমই পছন্দ না। বৌ হবে তুলার মতো নরম। আমি তোমারে খাইতে নিষেধ করবো না কখনও। তবে একটা শর্ত আছে।
মিলি ভয় ভয় চোখে তাকায়। বলে কিসের শর্ত?
আমি বলি, আমারেও কখনও খাইতে নিষেধ করা যাবে না। বলেই চোখ টিপ মারি।
মিলি এবার লজ্জা পায়। বলে, আপনি তো ভালো দুষ্টু আছেন।
আমি নজরুলের কাছে থেকে লাইন চুরি করি। তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ? এতো সুন্দর বৌ যার, তার কি দুষ্ট না হলে মানায়?
২.
পৃথিবীর সব মানুষেরই পছন্দের একটা খাবার থাকে। আমার বৌ, মানে মিলির পছন্দের কোন খাবার নাই। কারণ পৃথিবীর সব খাবারই তার পছন্দ।
এই মেয়ে বার্গার, পিজ্জা থেকে শুরু করে পান্তাভাত, সবকিছু পাগলের মতো খাইতে পারে। ওর খাওয়া দেখে বাড়ির সবাই ক্লান্ত হয়, ক্লান্ত হয় না শুধু মিলি।
আম্মু সবাইকে খাওয়াতে এতো পছন্দ করে, অথচ সেই আম্মুও বৌয়ের খাওয়া দেখে অবাক। একদিন আমাকে ডেকে চাপা গলায় বলে, বৌমারে ডাক্তার দেখা। এতো খাইলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে।
আমি আম্মুর উপর রাগ হই। এখন কি আর আগের যুগ আছে? বাড়ির বৌ কম খাবে? কম কথা বলবে? এখন নারী ক্ষমতায়নের যুগ। এই যুগে আপনি আপনার বৌ রে খাইতে দিবেন না?
আমার হম্বিতম্বি শুনে আম্মু কিছু চুপ করে যায়। আর কিছু বলার সাহস করে না। চোখে মুখে ভয় আর অপরাধবোধ নিয়া তাকাইয়া থাকে।
৩.
সবার বিয়ের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয় এক বছরে।
আমাদের বিয়ের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয় না দুই বছরেও।
এই দুই বছরে পদ্মায় জল গড়িয়েছে ৫ কেজি। আর মিলির ওজন বাড়সে ২৫ কেজি। বিয়ের শুরুতে আমি ওরে কোলে নিতে পারতাম। আর এখন ওই আমারে কোলে নিতে পারে।
পাশাপাশি দেখলে আমাদের মনে হয় বড় বোন আর ছোট ভাই। পাড়ার লোকজন কত কথাই তো বলে!! আমি কানে দিই না। শুনেও না শোনার ভান করি। ভালোবেসে মজনু নিজের প্রাণ দিতে পেরেছে আর আমি বৌয়ের ছোট ভাই হতে পারবো না?
রাতে মিলি ওর বান্ধবীদের সাথে ফোনে কথা বলে। বান্ধবীদের কারো জামাই মদ খায়, কারো জামাই ঘুষ খায়, কারো জামাই চিকন হতে বলে। কারো জামাই আবার মোটা বলে গালি দেয়।
এসব শুনে মিলি আমার প্রতি আরো উইক হয়। বলে সাদিক, তুমি এত্তো সাপোর্টিভ? আমার সাত জনমের ভাগ্য আমি তোমারে পাইসি। আমার জামাই আমারে মোটা বলার মতো হলে তখন আমার কী হতো?
আমি হাসি। কিছু বলি টলি না। আমি বাটার মোড়ের জিলাপির প্যাকেটটা ব্যাগ থেকে বের করি। জিলাপি দেখে মিলির চোখ চকচক করে। আর ওর চোখ চকচক করা দেখে আবার আমার আনন্দ লাগে। দাম্পত্যের চে বড় সুখ আর কী আছে পৃথিবীতে?
৪.
মিলি মারা গেল পরের বছর।
ডাক্তার বহুবারই নিষেধ করেছিলো। মিলি শুনেনি। বলা চলে, আমিই শুনতে দিই নিই। ডাক্তাররা তো কত কথাই বলে, শোনার দরকার কী?
শেষবার ডাক্তার মিলিকে বলেছিলো, গরুর মাংস আপনার জন্য এখন বিষের মতো। এক এক পিস খাবেন, আর আয়ু এক এক মাস কমবে।
সেদিন রাতের বেলা মিলি সিদ্ধান্ত নিলো সে খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ডায়েট শুরু করবে।
আমি ওকে অভয় দিই। আরে বাদ দাও তো। ডাক্তারের কথা শুনে খাওয়ার আনন্দ বাদ দিবা কেন? তুমি খাও। আমার গুলুগুলু বৌ পছন্দ। হাড্ডি-গুড্ডি পছন্দ না।
পরেরদিন বাজার থেকে ৫ কেজি গরুর মাংস আনি। মিলি সেই মাংস দিয়ে তেহারি রান্না করে। চর্বিওয়ালা নরম মাংস। দাঁতে দেওয়ার সাথে সাথে গলে যায়। মিলি একেকটা টুকরা মুখে দ্যায় আর ওর চোখ দুটো আরামে বন্ধ হয়ে আসে। মানুষ মুগ্ধ চোখে প্রেমিকার ফুচকা খাওয়ার দৃশ্য দ্যাখে। আর আমি দেখি মিলির মাংস খাওয়ার দৃশ্য।
ভালো লাগে। আমার বড় ভালো লাগে।
এই খাওয়াই ছিলো মিলির শেষ খাওয়া।
সন্ধ্যায় ওর স্ট্রোক হয়। তিনদিন আইসিউতে থাকার পর মিলি মারা যায়।
৫.
বৌ হারিয়ে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই।
আম্মু আফসোস করে। আহারে!! মেয়েটা কত সুন্দর করেই না খাইতো!!
পাড়ার লোকজন আফসোস করে!! আহারে!! এতো কম বয়সেই বৌটা মরে গেল!! আহারে!!
আমি অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিই। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিই। সারাদিন মিলির ছবি সামনে নিয়ে পড়ে থাকি।
বন্ধুরা আমাকে সান্ত্বনা দ্যায়। কলিগরা সান্ত্বনা দ্যায়। মসজিদের ইমাম চাচা মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বাবারে, আল্লাহ পাক বলেছেন, কুল্লি নাফসিন জাঈকাতুল মাউত। সকল প্রাণী মরণের স্বাদ গ্রহণ করবে। তুমি মিলাদের ব্যবস্থা করো। আমাদের মিলি মায়ের জান্নাত নসিব হবে ইনশাআল্লাহ।
আমি বড় করে মিলাদ দিই। বাটার মোড়ের জিলাপি। আম্মু ডুকরে কেঁদে উঠেন, আহারে!! বৌটা আমার জিলাপি কত পছন্দ করতো!!
৬.
জীবন থেমে থাকে না।আমারও থেমে থাকেনি।
অফিস। বাজার। বাড়ি।
আবারও সেই রুটিনাইজ জীবন শুরু হয়। মিলিকে ভুলতে আমাদের সময় লাগলো ছয় মাস।
আমার বিয়ের কথা প্রথম তুললো ছোট খালা। পুরুষ মানুষ। কতদিন আর একা থাকবে?
আমি প্রথম দিন শুনেই ধমক দিয়ে উঠি। খবরদার।বিয়ের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবা না। মিলি ছাড়া আর কাউরে আমি বিয়ে করতে পারবো না।
দ্বিতীয় মাসে আমার ধমকের জোর কমে। তৃতীয় মাসে ধমক পরিণত হয় মৃদু আপত্তিতে। চতুর্থ মাসে আমি নতুন বিয়ের সম্মতি দিয়ে ফেলি।
তুফান ঘটককে মেয়ের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়। মেয়ের বংশ বনেদি হতে হবে। উঁচু, লম্বা হতে হবে। যেকোন রিজিওন হতে পারবে, তবে বরিশাল আর নোয়াখালী বাদ।
যাওয়ার সময় আমি তুফান ঘটককে পাশে ডেকে নিয়ে বলি, বংশ, বরিশাল আর নোয়াখালী সব বাদ দেন। মেয়ে হতে হবে সুন্দরী। আর অবশ্যই মেয়ে যেন প্রচুর খাইতে পছন্দ করে। অল্প খাওয়া মেয়ে আমার পছন্দ না।
এক মাস পর তুফান ঘটক জানালেন, মেয়ে পাওয়া গেসে। আম্মু বলে, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমি বলি, মেয়ে খাইতে পছন্দ করে তো? আমার কিন্তু হাড্ডি-গুড্ডি পছন্দ না।
আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। তুফান ঘটক আমাকে আশ্বস্ত করে। মেয়ে প্রচুর খাইতে পারে, টেনশন নিয়েন না।
৭.
বাসর রাইতে বৌ বললো, জানো, আমি না খাইতে অনেক পছন্দ করি, তুমি আমারে ডায়েট করতে বলবা না তো?
আমি হাসি। মাথায় হাত রাখি। গুলুগুলু গাল দুটো টেনে আদর করে দিই। পাগলি মেয়ে। ডায়েট করতে বলবো কেন? যত ইচ্ছা খাও, আমার কি আর টাকা পয়সার অভাব আছে?
নিলা আমার কথা বিশ্বাস করে না। বলে, সব ছেলেই বিয়ের রাইতে অমন কথা বলেই। পরে তো ঠিকই মোটকু বলবা। জানি না?
আমি ওকে অভয় দিই। বলি, মেয়ে মানুষ মোটাই আমার পছন্দ। হাড্ডি-গুড্ডির বস্তা একদমই পছন্দ না। বৌ হবে তুলার মতো নরম। আমি তোমারে খাইতে নিষেধ করবো না কখনও। তবে একটা শর্ত আছে।
নিলা ভয় ভয় চোখে তাকায়। বলে কিসের শর্ত?
আমি বলি, আমারেও কখনও খাইতে নিষেধ করা যাবে না। বলেই চোখ টিপ মারি।
নিলা এবার লজ্জা পায়। বলে, আপনি তো ভালো দুষ্টু আছেন।
আমি রবীন্দ্রনাথের কাছে থেকে লাইন চুরি করি। প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ। এতো সুন্দর বৌ যার, তার কি দুষ্ট না হলে মানায়?
রাত বাড়ছে। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত.......।
Collected best story