21/01/2025
#ফিগার_ইউ_আউট
#পর্ব_১০
#ইনায়া_রোজ
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
**************
ইতালির তুসকানির এক প্রাচীন শহরে অবস্থিত অর্ণবের পেইন্ট হাউজ। ১২ তলা বিশিষ্ট বহুতল এই ভবনের চারপাশে বিস্তৃত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। পেন্ট হাউজের একপাশে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে দেখা যায় শহরের এক ঝলক। আবার অন্য পাশে দাঁড়ালে দেখা যায় তুসকানি এর পাহাড়ি অঞ্চল, উপত্যকা এবং গাছপালার অপরূপ সৌন্দর্যের এক মহাকাব্য।
তুসকানি শহরের এক নতুন সকাল। ভোরের আলো ধীরে ধীরে জানালার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করছে। আকাশে সূর্যের প্রথম সোনালী কিরণ রোমাঞ্চিত করে তুলছে চারদিক। মেঝের উপর রাখা কালো মার্বেলের টাইলস উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত করছে আলো। সেই আলোর কিরণ অর্নবের চোখে মুখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় অর্ণব।
অর্ণবের সকাল শুরু হয় এক অদ্ভুত নীরবতা দিয়ে। যে শহরে রাত পেরোতে গো*লাগু*লি চো*রাগু*প্ত হা*মলা আর বিশ্বা*স ঘা*ত*কতার ছায়া ঘুরে বেড়ায় সেখানে অর্ণবের সকাল যেন এক মুহূর্তের জন্য শ্বাস ফেলার সুযোগ। ক্লান্ত রাতের রেশ মুছে ফেলে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায় অর্ণব। ফ্রেশ হয়ে চলে যায় নিজের জিম ঘরটিতে।
প্রশস্ত এবং সুশৃংখল কক্ষে স্বচ্ছ কাঁচের প্রবেশদ্বার ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে অর্ণব। সু বিশাল কক্ষে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক সারী অত্যাধুনিক জিম সরঞ্জাম আর এক দেয়াল জুড়ে লাগানো বিশাল বড় আয়না। পুরো কক্ষের মেঝেতে বিছানো কালো রঙ্গের রাবার প্যাড।
কক্ষের চারিপাশ জুড়ে রাখা ট্রেডমিল, এলিপটিকাল মেশিন, স্টেশনারি বাইক, ডাম্বেল, বার্বেল ক্যাটলবেল,স্কোয়ার্ট যার্ক, মাল্টি জিম মেশিন সাথে আরো অনেক কিছু। কক্ষের এক পাশের কর্নারে রাখা ওয়াটার স্টেশন আর রেস্ট এরিয়া।
অর্ণব জিম শুরু করে মৃদু স্ট্রেচিং দিয়ে। তার মাংস পেশীর প্রতিটি সঞ্চালন যেন নৈপুণ্যের এক প্রদর্শন। সূক্ষ্মভাবে গড়া তার শরীর যেন পারতে পারতে এক কঠোর পরিশ্রমের গল্প বলে। হাত বাড়িয়ে যখন অর্ণব স্ট্রেচ করে তার শরীরের প্রতিটি শিরা যেনো আলোয় চকচক করে ওঠে। স্ট্রেচিং শেষে অর্ণব চলে যায় ট্রেড মিলে দৌড়ে।
ট্রেড মিলের উপর তার প্রতিটা পদক্ষেপ এতই দৃঢ় আর ছন্দময় যেন মাফিয়া জগতের প্রতিটি পদক্ষেপে তার অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতির প্রতীক। এক অদম্য দৃষ্টিতে ফোকাস হয়ে অর্ণব তাকিয়ে আছে। কেননা সে শুধু শরীর নয় মন কেও শানিত করছে। এরপর প্রতিটি ডাম্বেল উছিয়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার।
পেশী গুলো টানটান হয়ে গভীর নিঃশ্বাসে তার বুক উঠানামা করে। তার হাতের শিরা গুলো ফুলে উঠতেই মনে হয় তার শরীরের প্রতিটি রক্তের কণা তার সাফল্যর সাক্ষ্য বহন করছে। প্রায় দেড় ঘন্টা শরীরচর্চা শেষে অর্ণব উঠে গিয়ে জিম কক্ষের জানালার পাশে দাঁড়ায়।
তুসকানির স্নিগ্ধ বাতাসে অর্ণবের চোখে পড়ে সূর্যের আলোয় ঝলমল করা তৃণভূমি। সেই মুহূর্তে অর্ণব অনুভব করে শক্তি আর শান্তি কেবল শরীরে নয় আত্মায় ও থাকতে হয়। এরপর বড় দুটি শ্বাস নিয়ে পেছনে ফিরতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় অর্ণব।
আরুশির যেন এক অনভিপ্রেত আবির্ভাব, দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। তার মুখে এক অদ্ভুত শান্ত অভিব্যক্তি, আর চোখে সেই দীপ্তি, যা কেবল আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাধীন মানুষদেরই থাকে।
অর্ণব এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। তার দেহের সমস্ত ক্লান্তি যেন মুহুর্তেই মিলিয়ে গিয়েছে , আর তার মন যেন কোনো অজানা সুরে ধ্বনিত হচ্ছে। আরুশিকে দেখে তার মনে হচ্ছে , যেন এই মুহূর্তে পুরো ঘরের বাতাস বদলে গেছে। ঘামের গন্ধ, ভারী শ্বাস, এবং মেশিনের শব্দের মধ্যেও সে এক হালকা সুবাস অনুভব করছে। মনে হয়, এক বুনো গোলাপের ঘ্রাণ যেন আচমকা এসে ঢুকেছে তার রুক্ষ জগতে।
আরুশি জিম ঘরের দরজার ফ্রেমে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। অর্ণব সেই হাসিতে অদ্ভুত কিছু খুঁজে পাচ্ছে। আরুশির এই হাসি যেন মৃদু ব্যঙ্গ নয়, বরং এক প্রচ্ছন্ন আমন্ত্রণ।
অর্ণবের হৃদপিণ্ড হঠাৎ করেই জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে, যা অর্ণবের মতো লোকের পক্ষে অস্বাভাবিক। এত যুদ্ধ, এত রক্ত আর দুঃসাহসিক কাজের মাঝেও এমন অনুভূতি তার জন্য একেবারেই বিরল। তবে হটাৎই এই অনুভূতি অর্নবের পছন্দ হয়। কিছুটা অস্বস্তিকর, কিন্তু গভীরভাবে আরামদায়ক।
অর্ণব আরুশির দিকে তাকিয়ে আছে তার মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখ যেন বারংবার বলে উঠছে,
- তুমি আসলে কে, যে আমার মতো কঠিন মানুষকেও থমকে দিচ্ছ বারংবার?
আরুশি অর্ণবের এই স্তব্ধতাকে বুঝতে পেরে কপালে একটুখানি ভ্রূকুটি তোলে, যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। এরপর নীরবতা ভেঙ্গে আরুশি বলে ওঠে,
- মিস্টার অর্ণব এক ধাপ হয়ে যাক তাহলে?
অর্ণব স্পষ্ট বুঝতে পারছে আরুশির কথা। সে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আরুশির হাতের দিকে। ব্যান্ডেজ ইতিমধ্যে গায়েব। শান্ত কণ্ঠে অর্ণব বলে উঠে,
- হাতের ব্যান্ডেজ কই?
কিছুটা হেসে আরুসি বলে ওঠে,
- খুলে ফেলেছি, এতদিন রাখতে হয় না।
- দশ দিনও হয়নি।
অর্ণবের কথায় তাচ্ছিল্য হেসে আরুশি বলে ওঠে,
- এটাই প্রথমবার নয় তাই আঘাতটা যৎসামান্য।
চোখ দুটো কিঞ্চি ছোট করে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে অর্ণব বলে ওঠে,
- আর ইউ শিওর দ্যাট ইউ ওয়ান্ট টু ডু ইট?
অর্নবের কথায় আলতো হেসে আরুশি একটা চোখ টিপ মারে।
আরুশির এই অঙ্গভঙ্গি অর্ণবের ঠোঁটের কোণে এক মৃদু হাসি এনে দেয়। অর্ণব হঠাৎ অনুভব করে , এই মেয়ে শুধুমাত্র তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়—বরং এই মেয়ে তার জীবনে এমন এক রহস্য, যা অর্ণব সমাধান করতে চায়।
জিমের ভারী পরিবেশ হালকা হয়ে যায়, আরুশির উপস্থিতি যেন সেখানে এক নতুন গল্পের সূচনা করেছে । অর্ণব হটাৎই অনুভব করে, এই মেয়ে কেবল তার শক্তিরই পরীক্ষা নেবে না, তার মনের গভীর কোণেও আলো ফেলবে।
জিম ঘরের বাতাস কিছুটা উত্তেজনায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুই হাতে বক্সিং গ্লাভস পড়ে অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অটুট আত্মবিশ্বাস আর শরীরের প্রতিটি শিরা তার শক্তির সাক্ষ্য দিচ্ছে। তার সামনে সবে মাত্র বক্সিং গ্লাভস পড়া শেষ করে দাঁড়ায় আরুশি। আরুশি যেনো তুষার শীতল বাতাসের মতোই শীতল এবং স্থির। তার চোখে সেই আগুন যা কোন প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে স্নান হয় না।
অর্ণব এবার শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
- এই পোশাকে পারবে তো ভেবে দেখো?
আরুশির পরনে একটি কালো ফুল স্লিভস স্কিনি টপ সাথে ব্ল্যাক ডেনিম প্যান্ট। অর্ণবের এমন কথায় নিজের দিকে একপলক তাকায় আরুশি। এরপর আলতো হেসে এক হাত উঁচিয়ে অর্ণবকে প্রথম আক্রমণের ইশারা দেয় আরুশি।
বাঁকা হেসে প্রথম মুষ্টি তুলে অর্ণব, বজ্রের মতো দ্রুতগতিতে। তার প্রতিটি আঘাতের ওজন নিয়ন্ত্রিত যেন আরুশিকে এক মুহূর্তেই হারিয়ে দিতে চায় । কিন্তু আরুশি মোটেও পিছিয়ে যায়নি। তার মুভমেন্ট এতটাই ফ্লুইড যেন এক নিত্য প্রদর্শন করছে সে। আঁকাবাঁকা হয়ে প্রতিটি আঘাত এড়িয়ে গিয়ে পাল্টা আঘাত করছে তীক্ষ্ণ এবং নিখুঁতভাবে।
এ যেনো এক বাঘ আর বাঘিনীর লড়াই। এবার আরো কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে আরুশি। তার প্রতিটি ঘুসি যেন অর্ণবের প্রতীক্ষার দেয়াল ভেদ করতে চায়। আচমকা আরুশির ডান হাতের ঘুসি অর্নবের চোয়ালে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে একধাপ পিছিয়ে যায় অর্ণব। তৎক্ষণাৎ তার মুখে ফুটে উঠে এক মৃদু হাসি। যেন শিকারি তার শিকারের শক্তি ইতিমধ্যেই পরখ করে নিয়েছে।
এবার কিছুটা অগ্রাসী হয়ে ওঠে অর্ণব। দুজনে কিছুটা ক্লান্ত তবে কেউই হার মানতে রাজি নয়। আরুশি এবার তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এক মারাত্মক আঘাত হানে অর্ণবের পাজরে। কিন্তু অর্ণব সেই আঘাত সামলে তুলে পাল্টা আঘাত হানে সরাসরি আরশির কাধ বরাবর। অজান্তেই আরুশির ব্যথাযুক্ত বাহুতে লাগে সেই আঘাত।
কিছুটা মৃদু আওয়াজ করে অর্ণবের চোয়াল বরাবর আরও একটা ঘুষি হাকায় আরুশি। এবারেও কিছুটা দূরে সরে যায় অর্ণব। অর্ণব আবারও তেড়ে আঘাত করতে নিলে নিজের হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় আরুশি। এরপরে নিজের বাহু ধরে চোখ মুখ খিচে এক মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। আরুশির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে একেবারে মৃদু কন্ঠে অর্ণব বলে উঠে,
- শীট্! হাউ কুড আই ডু দিস?
কিছু মুহূর্ত পর নিজের ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করে অর্ণবের দিকে তাকায় আরুশি। দুজনেই কিছুটা হাঁপিয়ে গিয়েছে। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে অর্ণবের চোখে তাকাতেই এক মৃদু হাসি দিয়ে উঠে আরুশি। দুজনের মধ্যে কোন বিজয়ী নেই, তবে তারা দুজনেই একে অপরের প্রতি মুগ্ধ। যেন কোন কথা ছাড়াই দুজনের মধ্যে এক গভীর শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে।
অর্ণব যেন ভুলে যাচ্ছে আরুশি তার শত্রু আর অর্ণব তাকে নিজ স্বার্থের জন্য ব্যবহার করতে চায়। আরুশির ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারার দিকে নিষ্ফলক তাকিয়ে আছে অর্ণব। দুজনের মাঝে কোন শব্দ নেই শুধু চলছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আদান-প্রদান। অর্ণবের চোখে কঠোরতা কিন্তু মুখাবয়বে কেমন যেন এক অস্বস্তি।
আরুশির এই নিকষ কালো চোখ যেন এক জলন্ত স্পর্শ, সাহস আর মায়ার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সে মাফিয়ার কাছে বন্দী জেনেও যেন কোন ভয় নেই তার মধ্যে। বরং তার নিকষ কালো চোখের দৃষ্টি যেন বারংবার অর্নবের আত্মা চিরে দেখতে চায়। অর্ণবের সারা শরীর শক্ত হয়ে আছে তবুও তার অন্তরে কিছু একটা যেন পুড়ছে।
অর্ণব যেন কিছুতেই আরুশির থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না। নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অর্ণব মনে মনে আওড়ায়,
- কি করছিস তুই অর্ণব? এসব তোর স্বভাবের বিপরীত।
কিন্তু তার অন্তর যেন মস্তিষ্কের কোন কথাই পাত্তা দিচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীর পায়ে অর্ণবের দিকে কিছুটা এগিয়ে আসে আরুশি। তার চোখে এতটাই শীতলতা যেন সে পুরোপুরি জানে তার দৃষ্টি এই মুহূর্তে কতটা তীক্ষ্ণ আর শক্তিশালী। আরুশির এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টির চাপ সহ্য করা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে অর্ণবের পক্ষে।
অর্নবের কিছুটা নিকটে এসে দাঁড়িয়ে একেবারে মৃদু কন্ঠে আরুশি বলে ওঠে,
- দুর্বল জায়গায় আঘাত করা কাপুরুষদের লক্ষণ মিস্টার অর্ণব, এটাই শেষ নয়!
এক দিকে আরুশির নির্লিপ্ত আচরণ আর অপরদিকে তার আচমকা গভীর দৃষ্টি, আরুশির এই দ্বৈত আচরণের দোলাচল অর্ণবকে আরুশির দিকে আরো ক্রমাগত টেনে চলেছে। আরুশির এমন সুক্ষ্ম আচরণ অর্ণব কে ভাবতে বাধ্য করছে, সে দুর্বল হয়ে পড়ছে!
মুহূর্তেই অর্ণবের মস্তিষ্ক স্বকচিত হয়ে উঠে। এতক্ষণের সকল অযাচিত অনুভূতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে অর্ণব বলে ওঠে,
- সেটা সময় হলেই দেখা যাবে মিস কায়নাত। কক্ষ থেকে বের হওয়ার অনুমতি পেয়েছ দেখে ভাববে না সকল স্বাধীনতা পেয়ে গেছো। তুমি এখনো অর্ণব ওয়াসিমের কাছে বন্দী। আর খুব শীঘ্রই তোমার দুঃসময় ঘনিয়ে আসছে।
শেষের কথাটা কিছুটা তিরস্কারের স্বরে বলে ওঠে অর্ণব। অর্নবের কথায় ধীরে ধীরে কিছুটা সাহসী অবজ্ঞা সূচক আর একটু তাচ্ছিল্যর ছোঁয়ায় রঙিন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে আরুশির ওষ্ঠে। শান্ত ভঙ্গিতে আরুশি বলে ওঠে,
- এসব ভয় দেখানোর কৌশল বেশ পুরনো হয়ে গেছে মিস্টার অর্ণব।
এরপর অর্ণবের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে নিরেট কণ্ঠে বলে ওঠে,
- আপনি হয়তো অনেককেই ভয় দেখিয়ে নিজের শাসনের মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন কিন্তু আমি আমি সেই ধরনের মানুষ নই। আমাকে ভয় দেখাতে চাইলে আরো ভালো কিছু চেষ্টা করুন।
অর্ণবের দৃষ্টি এবার আরো কিছুটা পখর হলো। এই এক রত্তি মেয়ে এত সাহস কোথা থেকে পায় বুজে পায় না অর্ণব। যেখানে তার অভ্যস্ত শিকার গুলো তার এক শীতল হুমকিতেই ভেঙ্গে পড়ে, সেখানে এই চুনোপুটি ন্যায় একরত্তি মেয়ে যেন তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে ছিন্ন ভিন্ন করার শক্তি রাখে। অর্ণব গম্ভীর কন্ঠে আবারো বলে ওঠে,
- আমি কি করতে পারি সেই সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই মিস কায়নাত।
নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারো কিছুটা হেসে ওঠে আরুশি। এরপর বলে ওঠে,
- আমি আপনার মত অনেককেই দেখেছি যারা ভাবে তারা অপরাজেও। কিন্তু ভেতরে তারা নিজেরাই ভাঙা কাচ।
অর্ণবের চোখ জোড়া এক মুহূর্তের জন্য সংকুচিত হয়। আরুশির এমন দৃঢ়তা তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত করে তোলে। পরমুহূর্তেই আবার শান্ত কণ্ঠে অর্ণব বলে ওঠে,
- সবাইকে কি নিজের বাবার মত মনে করো তুমি মিস কায়নাত?
অর্ণবের মুখে আকস্মিক এমন কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় আরুশি। তার বাবার সম্পর্কে অর্ণব কিভাবে জানল? আরুশিকে থমকাতে দেখে বাঁকা হাসে অর্ণব। আরুশি কম্পিত গলায় বলে উঠে,
- মানে?
- এতকিছু তোমাকে জানতে হবে না মিস কায়নাত। বরং তুমি ভাবো তুমি নিজে কতটা প্রস্তুত এই খেলায় শেষ হতে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নতুন উদ্যমে আরুশি বলে ওঠে,
- খেলার গুটি আমাকে কখনোই বানাতে পারবেন না মিস্টার অর্ণব বরং আপনি নিজে প্রস্তুতি নিন কারণ আমি জানি আপনি এমন একজন যার জিতার খুশির চেয়েও হারতে বেশি ভয়।
- আমি হারতে জানি না মিস কায়নাত, কারণ আমি কখনো প্রতিযোগিতার নিয়ম মেনে খেলি না।
নিরেট কন্ঠে আরুশি বলে উঠে,
- মেরে ফেলার থাকলে এক্ষুনি মেরে ফেলুন বাঁচিয়ে রাখলে আপনাকেই দুঃখ পোহাতে হবে।
আরুশির কথায় তাচ্ছিল্য হেসে অর্ণব বলে ওঠে,
- প্রতিশোধ কখনো তাড়াহুড়ো করে নিতে নেই মিস কায়নাত। প্রতিটি আঘাতকে সময় দিয়ে ধারালো করতে হয়, যেন এক কো*পেই সব নিঃশেষ করা যায়। ততদিন তুমি এটাকে নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে পারো।
বলেই এক ক্রুর হাসে অর্ণব। ভ্রু কুচকে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আরুশি মনে মনে আওড়ায়,
- এখন এই মুহূর্ত পর থেকে আমি তোমার সামনে দাঁড়াবো শুধুমাত্র তোমার পৃথিবীকে নড়বড়ে করতে মিস্টার অর্ণব। আর তুমি সেটা বোঝার আগেই তোমার এই অট্টালিকা ভেঙ্গে পড়বে। ধ্বংস হবে তোমার এই প্রাচুর্য, আর সেটা খুব শীঘ্রই!
**********
ধীরপায়ে অর্ণবের পিছু পিছু এসে পেন্টহাউসের ড্রয়িং রুমে দাড়ায় আরুশি। এই প্রথমবারের মতো এখানে এসেছে সে। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই কিছু মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এক পলকেই যেন তার চোখে মুগ্ধতা এবং অবিশ্বাসের মিশ্রণ ছড়িয়ে যায়।
বিশাল সিলিং থেকে ঝুলে থাকা জটিল ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, সূক্ষ্ম মার্বেলের মেঝে, বিশাল কাচের জানালার বাইরে থেকে ঝলমলে তুসকানির সৌন্দর্য যেন একই সঙ্গে তার শ্বাস আটকে দিয়েছে।
আরুশির চোখ ধীরে ধীরে ঘরের প্রতিটি কোণে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। ঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো সিলিং থেকে ঝুলে থাকা বিশাল আকারের ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। যা অসংখ্য সূক্ষ্ম ক্রিস্টালের মালার সমন্বয়ে তৈরি। ঝাড়বাতির আলো বিশাল ড্রয়িং রুমে একটি উষ্ণ আর সোনালী আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ড্রয়িং রুমের কেন্দ্রে আধুনিক ধাচের কালো লেদারের একটি বৃহৎ এল আকৃতির সোফা রাখা। সোফার সামনে রাখা দুটি গাঢ় রঙের গোলাকার টেবিল। পুরো মেজেটি গাঢ় কাঠের তৈরি, যার উপর আধুনিক ধাচের গ্রে এবং সাদা প্যাটান যুক্ত কার্পেট বিছানো। ড্রয়িং রুমের এক কোণে একটি কালো ধাতব এবং কাচের সমন্বয়ে সর্পিলাকার একটি সিঁড়ি রয়েছে।
ফ্লোর টু সিলিং কাঁচের জানালা ঘরটির আরও একটি দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্য। যা দিয়ে তুসকানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একেবারে স্পষ্টভাবে উপভোগ করা যায়। জানালার সাথে লাগানো ভারী পর্দা যা প্রাইভেসি নিশ্চিত করে আবার প্রয়োজন অনুসারে আলো নিয়ন্ত্রণ করে।
ঘরের প্রতিটি জিনিস এত নিখুঁতভাবে সাজানো যে আরুশির মনে হচ্ছিল এই স্থানে বিন্দুমাত্র কোনো ত্রুটি থাকার সুযোগ নেই। এত কিছুর মাঝে আরুশির কেমন যেন একটা অস্বস্তি কাজ করছিল। এই অভিজাত্যের মাঝেও সে অনুভব করল চারদিকে যেন কেমন রহস্য ঘেরা। এখানের প্রতিটি কোণে অজানা কোন গল্প লুকিয়ে আছে।
অর্ণবের এই অট্টালিকা শুধু সৌন্দর্য নয় বরং অদৃশ্য ক্ষমতা ও বিপদেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে। আরুশি গভীর শ্বাস নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,
- এই জায়গা শুধু চমৎকার নয়, এটা ভয়ংকর! সে যতটা সহজ ভেবেছে ততটাও সহজ হবে না কিছুই।
অর্ণব আরো আগে গিয়েই টেবিলে বসে পড়েছে। আরুশিকে এইভাবে স্তব্ধ হয়ে সবকিছু পরখ করতে দেখে মনে মনে হাসলো অর্ণব। তখনই একজন সার্ভেন্ট এসে ডাক দিল,
- ম্যাম ইউর ফুড ইজ রেডি।
মহিলা সার্ভেন্টের কথায় সম্মিত ফিরে আরুশির। এরপরই সার্ভেন্টের দেখানো পথে এগিয়ে যায় বিশাল ডাইনিং রুমের দিকে। একটি বিশাল কালো মার্বেলের উপর সোনালী কারুকাজের একটি টেবিল যা চকচকে এবং নিখুঁতভাবে পলিশ করা। ছাদ থেকে ঝুলছে একটি ক্রিস্টাল চ্যান্ডেলিয়ার যা আলো ছড়িয়ে পুরো জায়গাটিকে উজ্জ্বল করে তুলছে।
আরুশি এগিয়ে গিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়ে। তার সামনে মুখোমুখি বসে অর্ণব একটি অ্যাভোকাডো টোস্ট খেয়ে চলেছে। আরুশি বসতেই সার্ভেন্ট এসে তার সামনে একটি স্ক্যামলভ এগ এবং একটি ফ্রুট প্লেটার রাখে। যেখানে ব্লুবেরি,রাস্পবেরি, কিউই, পাপায়া এবং ড্রাগন ফুট রাখা। আর সাথে ফ্রেশ অরেঞ্জ স্কুইজড জুস।
অর্ণবের সাথে লড়াই করে কিছুটা ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত থাকায় আগ পিচ না ভেবেই আরুশি খেতে শুরু করে দেয়। তখনই সেখানে উপস্থিত হয় আদি। এক প্রফুল্ল হেসে অর্নবের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
- গুড মর্নিং ভাই।
- ভাই!
আদির মুখ থেকে ভাই কথাটা শুনে ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয় আরুশির। কাল পর্যন্ত অর্ণবকে বস ডাকা আদি আজকে হঠাৎ ভাই বলে সম্বোধন করছে, কিছুই বোধগম্য হলো না আরুশির। তখনই আরুশিকে টেবিলে বসে খেতে দেখে এক মোহিত হাসি দিয়ে আদি বলে ওঠে,
- হ্যালো মিস গ্রাম্পি গুজ!
আদির এরূপ সম্বোধনে কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে আরুশি। সবাই তার সাথে এমন নরমাল বিহেভ করছে কেন? যেন তারা সকলেই তার পূর্ব পরিচিত। আরুশি কে চুপ থাকতে দেখে আদি হেসে আরুশির পাশে বসে পড়ে।
- যতদিন না ভাই রেগে যায় ততদিন এটাকে নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে পারো। তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাকো তাহলে কোন ভয় নেই তোমার।
আদির এমন ইঙ্গিত পূর্ণ কথা কিছুই বোধগম্য হলো না আরুশির। বরং আরুশি একবার আড় চোখে তাকালো খাবার নিয়ে মগ্ন থাকা অর্ণবের নিকট। তখনই হঠাৎ আরুশি নিজের কণ্ঠনালী থেকে এমন এক বাক্য বের করল যা মুহূর্তে অর্ণবকে নাড়িয়ে তুলল। অর্ণবের চোখ মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। হাতের কাটা চামচ সজরে থালায় রেখে এক কঠোর অভিব্যক্তি নিয়ে অর্ণব তাকালো আরুশির পানে।
চলবে......
#ইনায়া_রোজ
[ আপনাদের অপেক্ষা না করিয়ে গল্প দিয়েই দিলাম। আশা করি আপনারা চুপি চুপি পড়ে চলে না গিয়ে লাইক কমেন্ট করবেন। আসলে আপনাদের জন্য এত কষ্ট করে লিখে আমার কোন লাভই হয় না। মাঝে মাঝে আপনারা শুধু কিছু মন্তব্য করে আমাকে উৎসাহ দেন ব্যাস এতটুকুই। কিন্তু সেটাও দিতে যেন আপনাদের অনেক কষ্ট হয়। যথাযথ মন্তব্য না করলে আমি গল্প দেওয়া বন্ধ করে দিব।]