30/12/2024
আমাদের মহল্লার গলিটার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বাসটা যেন কোনো দুঃস্বপ্নের মতোই রহস্যময় ছিল। সারা রাত তার জানালাগুলো থেকে ছিটকে বের হতো আবছা আলো। আর তার ভেতর থেকে ভেসে আসা পাতার ওলটানোর শব্দ—মনে হতো কেউ একটা অদ্ভুত নিয়মে বই পড়ছে, থেমে থেমে, যেন কোনো গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করছে।
সেদিন সন্ধ্যা। আমি, ইসমাম , ছাদে দাঁড়িয়ে বাসটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার শৈশবটা ছিল বড্ড একা। বাবা-মা সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি সারাক্ষণ কেবল নিজেকেই সঙ্গ দিতাম। এমন সময়ই বাসটা এলো। কেউ বলল, এটা নাকি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। কিন্তু আমার কৌতূহল ছিল অন্য কিছু নিয়ে। কেন এই বাসটা এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে?
পরদিন সকালে সাহস করে বাসটার কাছে গেলাম। দরজাটা খোলা ছিল। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখতে পেলাম অদ্ভুত এক মহিলা। তার গায়ে সাদা শাড়ি, চুল এলোমেলো, আর তার সামনে টেবিলে সারি সারি পুরনো বই। আমাকে দেখে সে হাসল।
"ভয় পেয়েছ, ছোট্ট মেয়ে?"
আমি মাথা নাড়লাম।
"তাহলে ভেতরে এসো," সে বলল।
বাসের ভেতরে পা দিয়ে আমি যেন অন্য এক জগতে চলে গেলাম। ছোট্ট টেবিল, পাশে বইয়ের স্তূপ। মহিলাটি আমাকে একটা বই এগিয়ে দিল। "এটা তোমার প্রথম বই। পড়ো, আর বুঝতে চেষ্টা করো, জীবন আসলে কী।"
বইটা হাতে নিয়ে দেখি, এটি **‘মুখ ও মুখোশ’—এক পুরনো গল্পের বই।** সে বলল, "বই পড়া মানে শুধু গল্প পড়া নয়, নিজের গল্প খুঁজে পাওয়া।" তখন হয়তো তার কথা বুঝিনি, কিন্তু বইয়ের পাতা ওলটাতে গিয়ে আমি সেই প্রথম অনুভব করলাম, বইয়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা পৃথিবী কেমন।
তবে বাসটা শুধু একটা লাইব্রেরি ছিল না। বাসটার সাথে জড়িয়ে ছিল এক কল্পনাতীত ইতিহাস। রাত্রিবেলা বাসের জানালা দিয়ে আলো বের হতো, কিন্তু বাসের ভেতরে কেউ থাকত না। মহল্লার লোকেরা বলত, বাসটা নাকি জাদুকরী। আমি একদিন মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনারা কেন এই বাস নিয়ে ঘুরে বেড়ান?"
সে বলল, "বই হলো জীবনের আলো। এই আলো নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই, যাতে এমন শিশুরা এই আলোয় পথ খুঁজে পায়, যারা অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।"
একদিন আমি বাসে গিয়ে দেখি, মহিলা চুপচাপ বসে আছেন। তার চোখে পানি। আমার সাহস হলো না জিজ্ঞেস করার, কিন্তু বাস ছাড়ার আগে তিনি আমাকে একটি বই দিয়ে বললেন, "এই বইটা শুধু তোমার জন্য।" বইটা খুলে দেখি, তার ভেতরে লেখা: প্রিয় ইসমাম, তোমার জীবনের গল্পটা তুমি নিজেই লেখ। কারণ সত্যিকারের নায়িকা শুধু গল্পে থাকে না, বাস্তবেও থাকে।'
সেই বইটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বইয়ের ভেতর লেখা কথাগুলো আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে একা থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে হয়।
কিছুদিন পর বাসটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। মহল্লার কেউ জানত না, বাসটা কোথায় গেল। আমি যেন একটা শূন্যতায় ডুবে গেলাম। বাসটার অভাব আমাকে কষ্ট দিত, কিন্তু তার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার জীবন বদলে দিয়েছিল।
আজ, অনেক বছর পর, আমি যখন কোনো শিশু দেখি বই হাতে নিয়ে, তখন মনে পড়ে সেই রহস্যময় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আর তার ভেতরের সেই মহিলাকে। তার গল্পগুলো হয়তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার বইয়ের আলো আজও আমার জীবনে জ্বলছে।