10/04/2024
জান্নাতের কিছু বর্ণনাঃ
“জান্নাতের মাটি আর জমীন হচ্ছে জাফরান আর কস্তুরীর। এর ছাদ হচ্ছে আল্লাহর আরশ। শিলাখণ্ড গুলো মণিমুক্তোর। দালানগুলো সোনা রূপায় তৈরি। গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো সোনা রূপার। ফলগুলো মাখনের চেয়ে নরম, মধুর চেয়ে মধুর। পাতাগুলো সবচেয়ে কোমল, কাপড়ের চেয়েও কোমল। কিছু নদী দুধের। যার স্বাদ কখনো বদলায় না। কিছু শরাবের। যারা পান করবে তাদের তৃপ্তি মিটবে। কিছু নদী পবিত্র মধুর। কিছু নদী সতেজ পানির। যে ফলমূল তারা চাইবে তা-ই তাদের খাবার। যে-পাখির গোশত তারা খেতে চাইবে তা-ই পাবে। তাদের পানীয় হচ্ছে তাসনীম, সজীবতা উদ্দীপক ও কাফূর। তাদের পেয়ালাগুলো স্বচ্ছ, সোনারূপার তৈরি।
এর ছায়া এত বড় যে, দ্রুতগতির কোনো অশ্বারোহী একশ বছর ধরে চললেও সেই ছায়া থেকে বের হতে পারবে না। এর বিশালতা এত বেশি যে, জান্নাতের সবচেয়ে নিচু অবস্থানে যে থাকবে তার রাজত্বে যেসব দেওয়াল, ভবন আর বাগান থাকবে সেগুলো পার করতে হাজার বছর লেগে যাবে। এর তাঁবু আর শিবিরগুলো যেন লুকোনো মুক্তো। একেকটা প্রায় ষাট মাইল লম্বা। এর ভবনগুলোতে রুমের উপর রুম। তাদের নিচ দিয়ে নদী বয়ে যায়। এগুলোর উচ্চতা যদি জানতে চান তাহলে আকাশের যেসব উজ্জ্বল তারা দেখা যায় সেগুলোর দিকে তাকান। দৃষ্টি যেসব তারার নাগাল পায় না সেগুলোও দেখার চেষ্টা করুন।
জান্নাতবাসীর পোশাক হচ্ছে রেশম আর স্বর্ণ। তাদের বিছানায় যেসব কাঁথা থাকবে সেগুলো হবে সবচেয়ে উঁচু মাপের রেশমি কাপড়ের। তাদের চেহারা হবে চাঁদের মতো। তাদের বয়স হবে ৩৩। মানবজাতির পিতা আদমের অবয়বে। সেখানে তারা শুনবে তাদের পবিত্র স্ত্রীদের গান। তার চেয়েও ভালো হচ্ছে সেখানে তারা ফেরেশতা আর নবিদের কণ্ঠ শুনতে পাবে। এর চেয়েও ভালো হচ্ছে সেখানে তারা নিখিল বিশ্বজগতের প্রভুর কথা শুনতে পাবে। তাদের খেদমতে থাকবে চিরতরুণ বালকেরা। তাদের নমুনা হচ্ছে ছড়ানো-ছিটানো মুক্তোদানার মতো। তাদের স্ত্রীরা হবে পূর্ণ-যৌবনা। তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গে যৌবনের উন্মাদনা ছড়াতে থাকবে। সে যদি তার সৌন্দর্য দেখায় তাহলে মনে হবে চেহারায় যেন সূর্য খেলে গেল। তার হাসিতে আলো চমকে উঠবে। তাদের ভালোবাসা হবে দুই আলোর মিলন। কোনো স্বামী যখন তার স্ত্রীর দিকে তাকাবে তার গালে নিজের চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখবে। যেন কোনো উজ্জ্বল আয়নায় তাকিয়ে আছে। তার পেশি আর হাড়ের পেছন থেকে দ্যুতি ঠিকরে পড়বে।
সেই স্ত্রী যদি দুনিয়াতে তার সৌন্দর্য অবারিত করত, তাহলে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের মাঝে যা কিছু আছে সবকিছু সুন্দর সুবাসিত বায়ু দিয়ে পূর্ণ হয়ে যেত। সব সৃষ্টি তার প্রশংসা করত, গুণকীর্তন করত। পূর্ব-পশ্চিম সব তার সৌন্দর্যে আলোকিত হতো। সব চোখ কেবল তারই দিকে ফিরে থাকত। সূর্যের আলোয় যেমন তারার আলো হারিয়ে যায়, তার সৌন্দর্যে সূর্য সেভাবে হারিয়ে যেত। পৃথিবীর বুকে সবাই তখন চিরঞ্জীব সেই মহান সত্ত্বা এক আল্লাহয় বিশ্বাসী হতো। তার মাথার অবগুণ্ঠন পৃথিবী ও এর মাঝে যা কিছু আছে তার সবকিছুর চাইতে ভালো। সময়ের সাথে সাথে কেবল তার সৌন্দর্য বাড়তেই থাকবে। নাভির নাড়, সন্তান জন্ম, মাসিক এগুলো থেকে সে হবে মুক্ত। থুথু, মূত্র, শ্লেষ্মা ও অন্যান্য নোংরা জিনিস থেকে পবিত্র। তার যৌবন কখনো মিইয়ে যাবে না। পোশাক কখনো জীর্ণ হবে না। তার স্বামী কখনো তার কাছ থেকে বিরক্ত হবে না। স্ত্রীর মনোযোগ কেবল তার স্বামীর দিকেই থাকবে। সে তাকে ছাড়া আর কাউকে চাইবে না। স্বামীর চাওয়া-পাওয়াও কেবল তাকে ঘিরেই হবে। দুজন দুজনকে নিয়ে থাকবে সর্বোচ্চ স্বস্তি ও নিরাপত্তায়। মানুষ কিংবা জিনদের মধ্যে থেকে কেউ তাকে কখনো ছুঁয়ে দেখেনি।
সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী আল্লাহর চেহারা—যিনি সব ধরনের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত—সেদিন এমনভাবে দেখা যাবে যেভাবে দুপুর বেলায় সূর্য দেখা যায়। কিংবা মেঘমুক্ত আকাশে যেভাবে চাঁদ দেখা যায়। এক আহ্বানকারী ডেকে বলবে, “জান্নাতবাসী! তোমাদের সুমহান আল্লাহ তাঁকে দেখার জন্য ডাকছেন। কাজেই তাঁকে দেখতে আসো!” তারা বলবে, “আমরা শুনলাম ও মানলাম!”
তারা সবাই যখন প্রশস্ত উপত্যকায় জড়ো হবে, মহামহিম আল্লাহ তাঁর চেয়ার আনতে বলবেন। আলোর মিম্বার আসবে। আরও আসবে মুক্তো, খনি, সোনা-রূপার মিম্বার। জান্নাতের সবচেয়ে নিচু মর্যাদার অধিকারী কস্তুরীর চাদরে বসবে। আর তার উঁচু মর্যাদায় যারা থাকবে তারা যা দেখবে সে তা দেখবে না। যখন তারা সবাই আয়েশ করে বসবে, তখন আহ্বানকারী ডেকে বলবে, “জান্নাতবাসী! আজ তোমাদের সঙ্গে আল্লাহর এমন এক সাক্ষাত হবে যেখানে তিনি তোমাদের পুরস্কার দেবেন!” তারা বলবে, “আবার কী পুরস্কার? তিনি কি ইতোমধ্যেই আমাদের চেহারাকে উজ্জ্বল করেননি, আমাদের ভালো কাজের পাল্লাকে ভারী করেননি, জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে দেননি? [আর কী বাকি আছে!?]”
এমন অবস্থায় হঠাৎ করে পুরো জান্নাত জুড়ে আলোর রৌশনিতে ভরে যাবে। তারা তাদের মাথা উঁচু করে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইবে। মহান আল্লাহ বলবেন, “জান্নাতবাসী! আস-সালামু ‘আলাইকুম!” [এই লাইনটা অনুবাদ করার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। মহান আল্লাহ জান্নাতবাসীদেরকে নিজের মুখে সালাম জানাচ্ছেন! আল্লাহু আকবার!!!] জান্নাতাবাসীরা উত্তরে বলবে, “আল্লাহ, আপনিই শান্তি! আপনার থেকেই শান্তি আসে! আপনি সুমহান। সব সম্মান আর মাহাত্ম্য আপনারই!” সুমহান আল্লাহ তখন তাদের দিকে তাকিয়ে হাসবেন [এই জায়গাটা লেখার সময়ও গা শিউরে উঠছিল, ভাবা যায় স্রষ্টা নিজে তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আর সৃষ্টি তা দেখছে!]। বলবেন, “জান্নাতবাসী! তারা কোথায় যারা আমাকে না দেখে আনুগত্য করত? এটাই হচ্ছে ইয়াওমুল-মাযীদ (সর্বোচ্চ দিন)!”
তারা সবাই তখন উত্তর দেবে, “আমরা সন্তুষ্ট, আপনিও আমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান!” তিনি বলবেন, “জান্নাতবাসী! আমি যদি তোমাদের উপর সন্তুষ্ট না হতাম, তাহলে আমার জান্নাতের অধিবাসী তোমাদের করতাম না!” তারা সবাই সমস্বরে বলবে, “আপনার চেহারা দেখান যাতে আমরা দেখতে পারি!” সুমহান আল্লাহ তখন তার আবরণ সরিয়ে দেবেন। তাদেরকে মহিমাময়িত করবেন। তার আলো দিয়ে মুড়ে দেবেন। আল্লাহ যদি ইচ্ছে না করতেন তাহলে এটা তাদের পুড়িয়ে ফেলত। জনে জনে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, “তোমার কি সেই দিনের কথা মনে আছে, যখন তুমি এটা করেছ, ওটা করেছ?” তিনি তখন তাদেরকে তাদের দুনিয়ার কিছু খারাপ কাজের কথা মনে করিয়ে দেবেন। সে তখন বলবে, “প্রভু, আপনি কি আমাদের ক্ষমা করবেন না?” তিনি বলবেন, “অবশ্যই! আমার ক্ষমা ছাড়া তুমি জান্নাতের এই জায়গায় পৌঁছাতে পারতে না।”
কর্ণকুহরে এই ধ্বনি কতই না মধুর। পরকালে তাঁর মহিমান্বিত চেহারা দেখে ধার্মিকদের চোখ কতই-না শীতল হবে।”
[হাদি আল-আরওয়াহ ইলা বিলাদিল-আফরাহ, ইবনুল-কাইয়্যিম (রাহি.), পৃষ্ঠা ১৯৩]
— Shihab Uddin