18/06/2024
এই জোসনা ধারায়
পর্বঃ ৩৮
ইসরাত জাহান তানজিলা
মিনারা বেগম এশার হাতে লাঞ্চ বক্স ধরিয়ে দিয়ে বাসার গেটের সামনে থেকে রিক্সায় তুলে দিলেন। রিক্সা চলতে শুরু করার আগ মূহুর্তে তিনি ওকে সতর্ক করে বললেন,
-খাবারে আবার কিছু মিশিয়ে নিয়ে যাস না।
এশার কপালে ভাঁজ পড়ে। ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
-কি আবোলতাবোল বলছো!
-আমি না, ফুয়াদ বলেছে।
-কোথায় কি ছিলো এতদিন! মাথায় বোধ হয় সত্যি গণ্ডগোল হয়েছে।
-আমারও তাই মনে হচ্ছে।
ফুয়াদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফুল গাছের টব গুলো দেখছে। ওর আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট খাওয়া কমিয়েই দিয়েছিলো। কিন্তু এখন এশা যা যন্ত্রণা করছে! এছাড়া নিজের মেজাজ ঠিক রাখার উপায় নেই।
এশা এখানে থাকলে ওর এই শখের গাছ গুলো অন্তত এভাবে পানির অভাবে শুকাতো না। মেয়েটা এমন অবুঝের মত আচরণ কেন করছে! এখন যদি খাবার নিয়ে না আসে তাহলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এত নির্দয় আচরণ তো ওর প্রাপ্য না!
ফুয়াদ দেখলো গেটের সামনে একটা রিক্সা থেমেছে। রিক্সা থেকে অতি রূপবতী এক রমণী প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নেমে ধপধপ করে পা ফেলে বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খাবার দরজার সামনে রেখেই চলে যাবে।
হাতের সিগারেটটা ফেলে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে আসে ফুয়াদ। ওকে আগে থেকে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এশা মনে মনে বোধ হয় খানিকটা হতাশ হলো। এখন নিশ্চয়ই খাবার দরজার সামনে রেখে চলে যেতে পারবে না। কিছুটা সময় আবার তার মুখোমুখি ব্যয় করতেই হবে।
-এই নিন আপনার খাবার। আমি আসি।
ব্যস্ত কণ্ঠে ফুয়াদের দিকে লাঞ্চ বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো এশা। ওর আসলে তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। তবুও ভান করছে। হয়ত বুকের মধ্যে জমে থাকা পাহাড় সমান রাগ, অভিমান, ক্ষোভের কারণে! এমন কোনো রাত নেই যে ও কাঁদেনি! প্রতিটা মুহুর্ত যন্ত্রণা নিয়ে কাটিয়েছে। ভাতের লোকমা গুলো দলা পাকানো কষ্টের মত গলা দিয়ে নেমেছে। ভেতরটা যে কতখানি পুড়েছে তা কাকে বুঝাবে!
-খাবার তো রেস্টুরেন্টেই খেতে পারতাম। তোমাকে ডেকেছি কেন তাহলে! তুমি এত বোকা এশা!
লাঞ্চ বক্স হাতে না ধরেই রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল ফুয়াদ। এরপর এশার হাত ধরে এক টানে দরজার সামনে থেকে ভিতরে নিয়ে আসে।
-আরে কি করছেন!
গম্ভীর, বিচলিত কণ্ঠ বলে উঠলো এশা। ফুয়াদও দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে ভারী গলায় বলল,
-তোমাকে একেবারে বোকা বলা অন্যায় হবে! তোমার মাথায় কিছুটা ভালো বুদ্ধি-জ্ঞানও আছে। তুমি আসলে ঠিকই ধরেছো। আমি শরীরের টানেই তোমার কাছে ঢাকায় এসেছি। লন্ডন গিয়ে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। পুরুষ মানুষ তো বুঝছো! এরকমই! শরীরই সব। দুনিয়াতে যা করে শরীরের টানেই করে। তাছাড়া তুমি যা সুন্দরী, তোমার যা ফিগার! তোমার হাজবেন্ডের এসব টান একটু বেশিই থাকবে।
এশাকে আতঙ্কিত দেখালো। এসব ফুয়াদের মনের কথা? তার চেহারা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তাহলে ওই বাসায় বসে যে ব্যাকুলতা দেখালো! সেসব মিথ্যা? সেই ব্যাকুলতা মিথ্যা হওয়ার আশঙ্কায় ওর বুকের ভিতর ধীরে ধীরে কেমন অসহনীয় ব্যথা অনুভব হতে লাগলো।
ফুয়াদ দীর্ঘ সময় এশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হতাশ কণ্ঠে বলল,
-ভয় পেলে নাকি? না এশা, তোমার মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধি-জ্ঞান নেই। তুমি হচ্ছো একজন বোকা সুন্দরী।
-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন।
-আমার বাসার ফ্রিজটা খালি। আমার উদ্দেশ্য হলো তোমাকে কে*টে টু*ক*রো টু*ক*রো ওটার ভিতর ভরে রাখবো। স্টুপিড!
-আমি বাসায় যাবো। দরজা খুলুন।
-তোমরা মেয়েরা পরিষ্কার, সোজাসাপ্টা কথা বুঝতে পছন্দ করো না। এখন শুনো বাঁকা করে বলি, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই আমার ফ্লাইট। এই এক সপ্তাহ তুমি এখানেই থাকবে। এটাই তোমার বাসা। তুমি এই বাসার সম্রাজ্ঞী। মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। তোমার মনের সমস্ত রাগ, জেদ, অভিমান, অভিযোগ, ক্ষোভ.. যা কিছু আছে আমার প্রতি, সব এখানে বসেই ঝাড়ো। শুধু আমার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না হেনতেন এ সমস্ত কথাবার্তা বলবে না।
এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। ওর দৃষ্টি অমনোযোগী।
ফুয়াদ লাঞ্চ বক্স খুলে প্লেটে খাবার বেড়ে এশার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার হাতে খাবে? আঙুলের স্পর্শ লাগবে কিন্তু ঠোঁটে। হ্যান্ড গ্লাভস পরে নিবো?
এশা চোখ তুলে ফুয়াদের দিকে তাকালো। বিষণ্ণ গলায় বলল,
-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।
-আমি চলে যাওয়াতে তুমি বোধ হয় একটু বেশিই দুঃখ পেয়েছো। সেই অভিমান ভুলতে পারছো না। অভিমান নিয়েই না হয় তুমি এই কয়টা দিন আমার সাথে থাকো। এরপর যদি মনে হয় আমি খারাপ স্বামী তাহলে আমার সাথে বিয়ে রাখার দরকার নেই।
ফুয়াদ এক প্রকার জোর করে এশার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,
-আমাকে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে। ভাবছো আমি হয়ত আবারও নিখোঁজ হয়ে যাবো। তোমার এই অবিশ্বাস তৎক্ষণাৎ দূর করে দেওয়া তো সম্ভব না। তবে একটা প্রস্তাব দেই তোমাকে। এই এক সপ্তাহ আমি তোমাকে একটুও ছুঁবো না। তুমি যে ভয়াবহ খোঁটা দিয়েছো আমাকে! যেদিন তোমাকে লন্ডন নিতে পারবো সেদিন আবার নতুন করে ফুলসজ্জা করবো।
এশার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবৎ এই কান্না চেপে রেখেছিল। কেন কাঁদছে তা সঠিকভাবে গুছিয়ে ভাবতে পারছে না।
-এগুলো চোখের জল নাকি অভিমানের বরফ গলা পানি? তা হলে বেশি করে কাঁদো। যাওয়ার আগে যেন একবার জড়িয়ে ধরে যেতে পারি।
কতদিন পর পেট ভরে খেল এশা! যার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না বলে তীব্র অভিমান নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে, তার হাতেই খেল! মানুষের মন কত বিচিত্র!
খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই গলগল করে বমি করে দিলো এশা। সমস্ত বমি পড়লো ফুয়াদের গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফুয়াদ বিমূঢ় হয়ে গেল,
-তুমি কি গলায় আঙুল দিয়ে ইচ্ছে করে আমার গায়ে বমি করলে?
এশাকে চূড়ান্ত বিব্রত দেখালো। ও মুখ চেপে রেখে বলল,
-না, আমি ইচ্ছে করে করিনি। দুঃখিত।
ফুয়াদ দ্রুত বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
-কোনো ব্যাপার না। তুমি তোমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যেভাবে খুশি ঝাড়ো। আমার শরীরে ছু*রি দিয়ে আঘাত করলেও কিছু বলবো না। ইউ আর এলাওড টু ডু এভরিথিং।
ফুয়াদ একেবারে গোসল সেরে বের হয়ে দেখলো এশা বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডেকে বুঝলো ঘুমিয়ে পড়েছে।
যে মেয়ে এখানে আসতেই চায়নি। বাধ্য হয়ে এসে আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছে। ফুয়াদ জোরজবরদস্তি করে আটকে রাখলো! তা নিয়েও কিরকম প্রতিক্রিয়া করলো। সেই মেয়ে এইটুকু সময়ের মধ্যে কত নিশ্চিন্তে এখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েদের মন বুঝতে পারা এত কঠিন ব্যাপার!
এশার এখানে কোনো জামাকাপড় নেই। ফুয়াদের এখন প্রথম কাজ হলো ওর জন্য জামাকাপড় কিনে আনা। ঘুম থেকে উঠে গোসল করার জন্য জামাকাপড় না পেলে আবার ওর গায়ে বমি করে দিতে পারে।
ফুয়াদ বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বলল,
-এশা, বোকা সুন্দরী! মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। আমি একটু বের হচ্ছি।
এশা ঘুমে তলিয়ে আছে। ফুয়াদ বাসা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে বেড়িয়ে পড়লো।
মেয়েদের জামাকাপড় কেনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই ফুয়াদের। দোকানদার যা ভালো বলেছে তাই নিয়ে চলে এসেছে। বাসায় ফিরে দেখলো এশা সামনের রুমে বসে আছে। সদ্য বোধ হয় ঘুম ভেঙেছে।
-একটু কষ্ট করে দেখবেন প্লিজ আপনার গায়ে ঠিকঠাক হয় কিনা!
এই বলে বসতেও পারলো না ফুয়াদ। এর ভিতর কলিংবেল বাজে। এই বাসায় কে আসবে?
পলি বেগম এসেছেন। তিনি বাসার ভিতরে ঢুকলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কোনো ভূমিকা ছাড়া বললেন,
-কালকে বাসায় যাবে। তোমার তেজওয়ালা বউকেও নিয়ে আসবে। তোমাদের সবার সঙ্গে আমার কথা আছে। তোমার বাপকে গ্রাম থেকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে এনেছি। তোমাদের জন্য যেন পুলিশ পাঠাতে না হয়!
বড়লোকের বিরাট পুলিশি কারবার! তারা ডাকলেই পুলিশ হাজির! এগুলো কি ভাড়া করা নকল পুলিশ? কি মারাত্মক কাণ্ড! এশা আড় চোখে তাকিয়ে থাকে।
চলবে...