Sharmin Hridi

Sharmin Hridi Hello, I'm Hridi. Welcome To My Tiny world. Let's Grow Together From A Speck Of Sand To A Vast Desert
(1)

এই জোসনা ধারায়পর্বঃ ৩৮ইসরাত জাহান তানজিলামিনারা বেগম এশার হাতে লাঞ্চ বক্স ধরিয়ে দিয়ে বাসার গেটের সামনে থেকে রিক্সায় ত...
18/06/2024

এই জোসনা ধারায়
পর্বঃ ৩৮
ইসরাত জাহান তানজিলা

মিনারা বেগম এশার হাতে লাঞ্চ বক্স ধরিয়ে দিয়ে বাসার গেটের সামনে থেকে রিক্সায় তুলে দিলেন। রিক্সা চলতে শুরু করার আগ মূহুর্তে তিনি ওকে সতর্ক করে বললেন,

-খাবারে আবার কিছু মিশিয়ে নিয়ে যাস না।

এশার কপালে ভাঁজ পড়ে। ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়,

-কি আবোলতাবোল বলছো!

-আমি না, ফুয়াদ বলেছে।

-কোথায় কি ছিলো এতদিন! মাথায় বোধ হয় সত্যি গণ্ডগোল হয়েছে।

-আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ফুয়াদ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফুল গাছের টব গুলো দেখছে। ওর আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট খাওয়া কমিয়েই দিয়েছিলো। কিন্তু এখন এশা যা যন্ত্রণা করছে! এছাড়া নিজের মেজাজ ঠিক রাখার উপায় নেই।

এশা এখানে থাকলে ওর এই শখের গাছ গুলো অন্তত এভাবে পানির অভাবে শুকাতো না। মেয়েটা এমন অবুঝের মত আচরণ কেন করছে! এখন যদি খাবার নিয়ে না আসে তাহলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাবে। এত নির্দয় আচরণ তো ওর প্রাপ্য না!

ফুয়াদ দেখলো গেটের সামনে একটা রিক্সা থেমেছে। রিক্সা থেকে অতি রূপবতী এক রমণী প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে নেমে ধপধপ করে পা ফেলে বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে খাবার দরজার সামনে রেখেই চলে যাবে।

হাতের সিগারেটটা ফেলে দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে আসে ফুয়াদ। ওকে আগে থেকে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এশা মনে মনে বোধ হয় খানিকটা হতাশ হলো। এখন নিশ্চয়ই খাবার দরজার সামনে রেখে চলে যেতে পারবে না। কিছুটা সময় আবার তার মুখোমুখি ব্যয় করতেই হবে।

-এই নিন আপনার খাবার। আমি আসি।

ব্যস্ত কণ্ঠে ফুয়াদের দিকে লাঞ্চ বক্স এগিয়ে দিয়ে বললো এশা। ওর আসলে তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। তবুও ভান করছে। হয়ত বুকের মধ্যে জমে থাকা পাহাড় সমান রাগ, অভিমান, ক্ষোভের কারণে! এমন কোনো রাত নেই যে ও কাঁদেনি! প্রতিটা মুহুর্ত যন্ত্রণা নিয়ে কাটিয়েছে। ভাতের লোকমা গুলো দলা পাকানো কষ্টের মত গলা দিয়ে নেমেছে। ভেতরটা যে কতখানি পুড়েছে তা কাকে বুঝাবে!

-খাবার তো রেস্টুরেন্টেই খেতে পারতাম। তোমাকে ডেকেছি কেন তাহলে! তুমি এত বোকা এশা!

লাঞ্চ বক্স হাতে না ধরেই রহস্যময় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল ফুয়াদ। এরপর এশার হাত ধরে এক টানে দরজার সামনে থেকে ভিতরে নিয়ে আসে।

-আরে কি করছেন!

গম্ভীর, বিচলিত কণ্ঠ বলে উঠলো এশা। ফুয়াদও দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে ভারী গলায় বলল,

-তোমাকে একেবারে বোকা বলা অন্যায় হবে! তোমার মাথায় কিছুটা ভালো বুদ্ধি-জ্ঞানও আছে। তুমি আসলে ঠিকই ধরেছো। আমি শরীরের টানেই তোমার কাছে ঢাকায় এসেছি। লন্ডন গিয়ে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। পুরুষ মানুষ তো বুঝছো! এরকমই! শরীরই সব। দুনিয়াতে যা করে শরীরের টানেই করে। তাছাড়া তুমি যা সুন্দরী, তোমার যা ফিগার! তোমার হাজবেন্ডের এসব টান একটু বেশিই থাকবে।

এশাকে আতঙ্কিত দেখালো। এসব ফুয়াদের মনের কথা? তার চেহারা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তাহলে ওই বাসায় বসে যে ব্যাকুলতা দেখালো! সেসব মিথ্যা? সেই ব্যাকুলতা মিথ্যা হওয়ার আশঙ্কায় ওর বুকের ভিতর ধীরে ধীরে কেমন অসহনীয় ব্যথা অনুভব হতে লাগলো।

ফুয়াদ দীর্ঘ সময় এশার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর হতাশ কণ্ঠে বলল,

-ভয় পেলে নাকি? না এশা, তোমার মাথায় আসলেই কোনো বুদ্ধি-জ্ঞান নেই। তুমি হচ্ছো একজন বোকা সুন্দরী।

-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন।

-আমার বাসার ফ্রিজটা খালি। আমার উদ্দেশ্য হলো তোমাকে কে*টে টু*ক*রো টু*ক*রো ওটার ভিতর ভরে রাখবো। স্টুপিড!

-আমি বাসায় যাবো। দরজা খুলুন।

-তোমরা মেয়েরা পরিষ্কার, সোজাসাপ্টা কথা বুঝতে পছন্দ করো না। এখন শুনো বাঁকা করে বলি, আগামী সপ্তাহের শুরুতেই আমার ফ্লাইট। এই এক সপ্তাহ তুমি এখানেই থাকবে। এটাই তোমার বাসা। তুমি এই বাসার সম্রাজ্ঞী। মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। তোমার মনের সমস্ত রাগ, জেদ, অভিমান, অভিযোগ, ক্ষোভ.. যা কিছু আছে আমার প্রতি, সব এখানে বসেই ঝাড়ো। শুধু আমার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না হেনতেন এ সমস্ত কথাবার্তা বলবে না।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো। ওর দৃষ্টি অমনোযোগী।

ফুয়াদ লাঞ্চ বক্স খুলে প্লেটে খাবার বেড়ে এশার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করলো,

-আমার হাতে খাবে? আঙুলের স্পর্শ লাগবে কিন্তু ঠোঁটে। হ্যান্ড গ্লাভস পরে নিবো?

এশা চোখ তুলে ফুয়াদের দিকে তাকালো। বিষণ্ণ গলায় বলল,

-আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে নিন।

-আমি চলে যাওয়াতে তুমি বোধ হয় একটু বেশিই দুঃখ পেয়েছো। সেই অভিমান ভুলতে পারছো না। অভিমান নিয়েই না হয় তুমি এই কয়টা দিন আমার সাথে থাকো। এরপর যদি মনে হয় আমি খারাপ স্বামী তাহলে আমার সাথে বিয়ে রাখার দরকার নেই।

ফুয়াদ এক প্রকার জোর করে এশার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,

-আমাকে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে। ভাবছো আমি হয়ত আবারও নিখোঁজ হয়ে যাবো। তোমার এই অবিশ্বাস তৎক্ষণাৎ দূর করে দেওয়া তো সম্ভব না। তবে একটা প্রস্তাব দেই তোমাকে। এই এক সপ্তাহ আমি তোমাকে একটুও ছুঁবো না। তুমি যে ভয়াবহ খোঁটা দিয়েছো আমাকে! যেদিন তোমাকে লন্ডন নিতে পারবো সেদিন আবার নতুন করে ফুলসজ্জা করবো।

এশার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবৎ এই কান্না চেপে রেখেছিল। কেন কাঁদছে তা সঠিকভাবে গুছিয়ে ভাবতে পারছে না।

-এগুলো চোখের জল নাকি অভিমানের বরফ গলা পানি? তা হলে বেশি করে কাঁদো। যাওয়ার আগে যেন একবার জড়িয়ে ধরে যেতে পারি।

কতদিন পর পেট ভরে খেল এশা! যার সঙ্গে বিয়ে রাখবে না বলে তীব্র অভিমান নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে, তার হাতেই খেল! মানুষের মন কত বিচিত্র!

খাওয়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই গলগল করে বমি করে দিলো এশা। সমস্ত বমি পড়লো ফুয়াদের গায়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় ফুয়াদ বিমূঢ় হয়ে গেল,

-তুমি কি গলায় আঙুল দিয়ে ইচ্ছে করে আমার গায়ে বমি করলে?

এশাকে চূড়ান্ত বিব্রত দেখালো। ও মুখ চেপে রেখে বলল,

-না, আমি ইচ্ছে করে করিনি। দুঃখিত।

ফুয়াদ দ্রুত বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

-কোনো ব্যাপার না। তুমি তোমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যেভাবে খুশি ঝাড়ো। আমার শরীরে ছু*রি দিয়ে আঘাত করলেও কিছু বলবো না। ইউ আর এলাওড টু ডু এভরিথিং।

ফুয়াদ একেবারে গোসল সেরে বের হয়ে দেখলো এশা বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। কয়েকবার ডেকে বুঝলো ঘুমিয়ে পড়েছে।

যে মেয়ে এখানে আসতেই চায়নি। বাধ্য হয়ে এসে আবার সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছে। ফুয়াদ জোরজবরদস্তি করে আটকে রাখলো! তা নিয়েও কিরকম প্রতিক্রিয়া করলো। সেই মেয়ে এইটুকু সময়ের মধ্যে কত নিশ্চিন্তে এখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েদের মন বুঝতে পারা এত কঠিন ব্যাপার!

এশার এখানে কোনো জামাকাপড় নেই। ফুয়াদের এখন প্রথম কাজ হলো ওর জন্য জামাকাপড় কিনে আনা। ঘুম থেকে উঠে গোসল করার জন্য জামাকাপড় না পেলে আবার ওর গায়ে বমি করে দিতে পারে।

ফুয়াদ বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বলল,

-এশা, বোকা সুন্দরী! মুঘল সম্রাজ্ঞী নূর জাহান। আমি একটু বের হচ্ছি।

এশা ঘুমে তলিয়ে আছে। ফুয়াদ বাসা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে বেড়িয়ে পড়লো।

মেয়েদের জামাকাপড় কেনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই ফুয়াদের। দোকানদার যা ভালো বলেছে তাই নিয়ে চলে এসেছে। বাসায় ফিরে দেখলো এশা সামনের রুমে বসে আছে। সদ্য বোধ হয় ঘুম ভেঙেছে।

-একটু কষ্ট করে দেখবেন প্লিজ আপনার গায়ে ঠিকঠাক হয় কিনা!

এই বলে বসতেও পারলো না ফুয়াদ। এর ভিতর কলিংবেল বাজে। এই বাসায় কে আসবে?

পলি বেগম এসেছেন। তিনি বাসার ভিতরে ঢুকলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কোনো ভূমিকা ছাড়া বললেন,

-কালকে বাসায় যাবে। তোমার তেজওয়ালা বউকেও নিয়ে আসবে। তোমাদের সবার সঙ্গে আমার কথা আছে। তোমার বাপকে গ্রাম থেকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে এনেছি। তোমাদের জন্য যেন পুলিশ পাঠাতে না হয়!

বড়লোকের বিরাট পুলিশি কারবার! তারা ডাকলেই পুলিশ হাজির! এগুলো কি ভাড়া করা নকল পুলিশ? কি মারাত্মক কাণ্ড! এশা আড় চোখে তাকিয়ে থাকে।

চলবে...

এই জোসনা ধারায়পর্বঃ ৩৭ইসরাত জাহান তানজিলাবিয়ে রাখবে না! বিয়ে না রাখার মত কি হলো! ফুয়াদের তীব্র আকুলতা কিছুটা রাগে গড...
17/06/2024

এই জোসনা ধারায়
পর্বঃ ৩৭
ইসরাত জাহান তানজিলা

বিয়ে রাখবে না! বিয়ে না রাখার মত কি হলো! ফুয়াদের তীব্র আকুলতা কিছুটা রাগে গড়ালো। কিন্তু ও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল এশার দিকে। মেয়েটার চেহারা কেমন শুকিয়ে গেছে। ক্লান্ত, অবসন্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু চোখ-মুখের অভিব্যক্তি খুবই কঠিন! ফুয়াদের প্রতি উপচে পড়া রাগ, অভিমান, ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ যেন।

ফুয়াদ স্থির হয়ে নরম গলায় বলল,

-আই থিংক আমার সাথে বিয়ে না রাখতে চাওয়ার মত কিছু হয়নি। আমি মেয়ে নিয়ে পালিয়ে যাইনি এশা। আমি আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কাউকে জানিয়ে যাইনি। কিন্তু ওই বিধ্বস্ত মনে তোমাকে ঠিকই লম্বা চিঠি লিখে জানিয়েছি। আমার মানসিক অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তুমি কি একটুও বুঝোনি এশা? যদি বুঝতে তাহলে তো তুমি আমার বাসায়ই থাকতে। রোদে পুড়ে টিউশনি করে চেহারার এই অবস্থা করতে না। আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে তোমার উপর। তবুও দেখো আমি নিজেকে শান্ত রাখছি। তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি। কারণ তুমি আমার জীবনে ম্যাটার করো এশা।

এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ওর মুখ ইস্পাতের মত কঠিন। ফুয়াদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,

-কতদিন পর দেখা হলো। হোক পু্রোটা আমার দোষ। তোমার রাগ, অভিমান, বিরক্তি, ক্ষোভ হতেই পারে আমার উপর। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসবের আড়ালে তো একটু অন্য অনুভূতিও থাকতে পারতো। তুমি বোধ হয় আমার জন্য অপেক্ষাই করোনি। মনে হচ্ছে আমি জীবনে ফিরে না আসলেও তোমার কিছু এসে যেতো না। অথচ আমি ভেবেছিলাম...।

ফুয়াদ থেমে বলল,

-সকালে তোমার সাথে দেখা হলো। তখন আমার ব্রেন ঠিকঠাক কাজ করছিলো না। কিন্তু তোমার ব্রেন তো ঠিক ছিলো। তুমি আমাকে ওভাবে এড়িয়ে চলে গেলে! আর এখন আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম! অথচ তুমি যন্ত্রের মত এখানে দাঁড়িয়ে আছো। কতটা ব্যাকুল হলে মানুষ একবার জড়িয়ে ধরার জন্য এভাবে অনুনয় করে এশা!

এশা এবার মুখ খুলে নিচু স্বরে বলল,

-মা ওখানে। রুমে গিয়ে কথা বলি।

-না, রুমে গেলে তো আমি তোমাকে খেয়ে ফেলবো। আমার স্পর্শ নাকি তোমার ভালো লাগবে না। তো কার স্পর্শ ভালো লাগবে? আমি কিসের জন্য ঢাকায় আসলাম! আমার তো সোজা লন্ডনের ফ্লাইট ধরা উচিত ছিলো।

এশা রুমে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর ফুয়াদও আসে। এশা রুমের দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,

-আমার কাছে আসবেন না। আমাকে কোনো ভাবে স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আমার খুব ভালো লাগবে।

ফুয়াদ টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

-ঠিক আছে।

-কি যেন বলছিলেন? আপনি আমাকে লম্বা চিঠি লিখে জানিয়ে গিয়েছেন। আপনার জীবনে আমি ম্যাটার করি। আপনি আমার জন্য ঢাকায় এসেছেন। আচ্ছা এগুলোকে কি আপনি আমার প্রতি মহৎ আচরণ ভাবছেন?

-না, আমার মত ব্যর্থ মানুষের কারো প্রতি মহৎ আচরণ করার সাধ্য নেই। কাউকে নিজের পরিস্থিতি বুঝানোরও ক্ষমতা নেই।

-মন মেজাজের দোহাই দিয়ে আপনি লাপাত্তা হয়ে যাবেন। একটা বার কল দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করবেন না। হুট করে নিজের মর্জি মতো ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইবেন। আবার নাকি আপনি লন্ডন যাবেন। যাওয়ার জন্য সবকিছু রেডি করে এসেছেন। আচ্ছা আমাদের তো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি এরকম হয়? এতটা ঠুনকো! লন্ডন, আমেরিকা কোথায়ও যেতে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না! আসলে আমি আপনার জীবনে এতটা গুরুত্বহীন যে আমার প্রতি সামান্য স্বাভাবিক আচরণও আপনার কাছে বিশেষ মনে হয়।

ফুয়াদ অধৈর্য মুখে বলল,

-ব্যাপার গুলোকে এত জটিল করে ভেবো না এশা। একটু সহজ ভাবে বুঝো। জীবনে একের পর এক বিভিন্ন ঝামেলায় আমার মন-মেজাজ অস্থির ছিলো। বিয়েটাও সেই অস্থিরতার ভিতরেই হয়েছে। এখন আমি স্থির হয়েছি। আর কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব, দ্বিধা নেই আমার মনে। আমি তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাই। আগের কথা বাদ দাও। দেশের বাইরে যাওয়ার সবকিছু আগেই হয়েছে। এখন হলে অবশ্যই তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম। এটা আমার জীবনের অনেক বড় একটা স্বপ্ন এশা। একটু এপ্রিশিয়েট করো। পরিবারের মানুষদের কাছ থেকে আমি জীবনে কোনো ব্যাপারে কখনো এপ্রিশিয়েশন পাইনি।

-হ্যাঁ আমি আপনাকে এপ্রিশিয়েট করছি। আপনার সকল স্বপ্ন পূরণ হোক। লন্ডনের জীবন সুন্দর হোক।

-তোমাকেও নিয়ে যাবো। আমাদের লন্ডনের জীবন সুন্দর হবে।

-আমার এত বড় স্বপ্ন নেই। মা বোধ হয় খাবার বেড়েছে। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি খেয়ে চলে যান।

ফুয়াদকে হতাশ দেখালো। এই হতাশা ছাপিয়ে ধীরে ধীরে প্রচণ্ড রাগ হতে লাগলো। সব মিলিয়ে কিরকম অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে ওর। সহজ কথা গুলো এশা কেন বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝতে চাচ্ছে না?

-লন্ডন যাওয়ার আগে কিছুদিন আমার সাথে থাকতে এসেছেন! শরীরের টানে এসেছেন। এরপর লন্ডন যাওয়ার পর আপনাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না আমি সেটা জানি। আপনাকে আগাগোড়া আমার চেনা হয়ে গেছে। কয়টা দিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। লন্ডন গেলে মেয়ের অভাব হবে না। আপনার ভালোবাসা.. সুন্দর হাসির মেয়ে সুস্মিতাও লন্ডন থাকে।

-তোমার কি ধারণা বাংলাদেশে মেয়ের অভাব আছে! শরীরের টানে তোমার কাছে এসে এভাবে একবার জড়িয়ে ধরার জন্য করুণা করতে হবে!

এই বলে ফুয়াদ ক্ষিপ্ত মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সজোরে দরজা খুলল। এশা বাঁধা দিলো না। মিনারা বেগম গোসলে ঢুকেছেন। বাসা থেকে বের হয়ে ক্রোধান্বিত পায়ে ধপধপ করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বেড়িয়ে পড়লো ফুয়াদ।

জীবনে কাউকে এভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেনি ও। কারো প্রতি এত ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করেনি। আজ করেছে। সর্বোচ্চ আকুলতা প্রকাশ করেছে। বিপরীতে কি পেল? বিরক্তি, অবহেলা!

মন থেকে চাওয়া সকল কিছুই ওকে এভাবে হতাশ করেছে। আজ এশাও করলো।
__

মিনারা বেগম গোসল সেরে বের হয়ে দেখলেন ফুয়াদ চলে গেছে। তার খুব রাগ হলো এশার উপর। এগুলো কেমন খামখেয়ালি আচরণ!

-ছেলেটা নিজে থেকে সেধে বললো আমাকে রান্না করতে। যত যা ই হোক, তুই ওকে এভাবে না খেয়ে যেতে দিলি কীভাবে?

-আমি তাকে খেয়ে যেতে বলছি!

-এশা, বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। সংসার জীবনে এর চেয়ে আরো অনেক কিছু হয়। ফুয়াদ যদি সেরকম খারাপ হতো আমিই তোকে ওর সাথে ফিরে যেতে দিতাম না। তোর ভালোটা আমি তোর চেয়ে বেশি বুঝি।

-আমি তো বলিনি মা ছেলেখেলা!

-ওর সঙ্গে যা। বাচ্চা হওয়ার খবরটা ওকে বল। এরপর যদি আবার মনে হয় ও তোকে অবহেলা করছে। তোর প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করছে। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো।

-বাচ্চা হওয়ার খবরটা উনি যেন কিছুতেই না জানে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি।

-এসবের মানে কি!

-সে বাচ্চা চায় না মা। সে লন্ডন চলে যাবে। আমার প্রতি এত অন্যায় আচরণ করে, এরপর হঠাৎ এসে আমাকে মাথায় তুলে নাচতে চাইলেই তার মাথায় উঠতে হবে? সে আবার যেকোন সময় পরিবর্তন হয়ে যাবে।

মিনারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-মান-অভিমান যা করার কর। কিন্তু ডিভোর্সের কথা মাথা আনিস না। তুই এখন আর একা নেই মা। তোর ভিতর আরেকটা প্রাণ আছে।

এশার চোখ ছলছল করছে। ও চোখ মুছে বিষণ্ণ গলায় বলল,

-সে লন্ডন গিয়ে আবার নিখোঁজ হয়ে যাবে। এই সন্তানের সমস্ত দায়-দায়িত্ব আমারই! আমি সেজন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত। দুঃখকে আমি ভয় পাই না। যা হওয়ার হবে। সারাজীবন কষ্ট করেই বড় হয়েছি।

-এত আগ বাড়িয়ে ভাবছিস কেন? ও তোর প্রতি অবশ্যই অন্যায় করেছে। সেই অন্যায়ের ব্যথায় আমার বুকেও যন্ত্রণা হয়েছে। কিন্তু এখন এর জন্য কি সংসার ভাঙার কথা চিন্তা করা উচিত হবে? ও যদি পরিবর্তন না হতো তাহলে আলাদা ব্যাপার ছিলো!

-এত অস্থির হচ্ছো কেন মা? তার পরিবর্তনের স্থায়ীত্ব কতটুকু সেটা আমাকে বুঝতে দাও! দেখেছো এইটুকুতেই কীভাবে রাগ করে চলে গেল! এত অধৈর্য আমার ব্যাপারে!

এর ভিতর ফুয়াদ ফোন করলো মিনারা বেগমের ফোনে। তিনি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বলল,

-আন্টি আমি খুব ক্ষুধার্ত। কাল থেকে কিছু খাইনি। আপনার মেয়েকে দিয়ে আমার জন্য খাবার পাঠালে খুব ভালো হতো। আর ওকে বলুন আমি ওকে কোনো ভাবেই স্পর্শ করবো না। আপনাকে সাক্ষী রেখে বললাম।

মিনারা বেগম বিব্রতবোধ করলেন। তিনি বললেন,

-ঠিক আছে। আমি ওকে দিয়ে তোমার জন্য খাবার পাঠাচ্ছি।

-আপনি শিওর ও আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে? আসার পথে ও আবার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। লক সিস্টেম কোনো লাঞ্চ বক্স থাকলে সেটায় খাবার দিয়েন।

মিনারা বেগমের কাছে লক সিস্টেম কোনো লাঞ্চ বক্স নেই। তার চেয়ে বড় ব্যাপার এশা শক্ত হয়ে বসে আছে। ও কিছুতেই ফুয়াদের জন্য খাবার নিয়ে যাবে না।

-মা, তুমি ওই লোকটাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করছো কেন? ক্ষুধার্ত হলে খাবার বাইরে থেকে কিনে খাক। আমার শরীর ভালো লাগছে না। আমি যেতে পারবো না।

-এমন নিষ্ঠুর আচরণ করছিস কেন? গাড়িতে করে গিয়ে খাবারটা দিয়ে আসবি শুধু। আর শোন ও বলেছে তোকে স্পর্শ করবে না!

-ছিঃ! তোমার কাছে এসব বলেছে।

মিনারা বেগম একটু তড়িঘড়ি করে খাবার বাড়ে। এর ভিতর ফুয়াদ তাকে ফোন দিয়ে আবার বলল,

-আন্টি ও যদি আমার জন্য খাবার নিয়ে না আসে, আমি কিন্তু ওখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে আসবো। ও আমার বউ। ওকে তুলে আনলে কে আটকাবে বলুন! আপনি কি আটকাবেন?

এই লোকের দ্বারা এসব অসম্ভব ব্যাপার না। এসব তামাশা ভালো দেখাবে না! এশা শেষমেশ দায়সারা ভাবে তেতো মেজাজে রাজি হলো। কিন্তু ও মনস্থির করলো খাবার দরজার সামনে রেখে চলে আসবে।

চলবে...

ফেসবুক স্কল করতে করতে থেমে গেলাম।  কিছুক্ষনের জন্য মধ্যরাতে মোবাইলের স্কিনের আলোটা যেন আমার চোখে বিশাল একটা আলো ফেলল। জ্...
16/06/2024

ফেসবুক স্কল করতে করতে থেমে গেলাম। কিছুক্ষনের জন্য মধ্যরাতে মোবাইলের স্কিনের আলোটা যেন আমার চোখে বিশাল একটা আলো ফেলল। জ্বলজ্বল করছে, শীর্ণ জীর্ণ একটা ছবি।

আমার এই অপলক তাকিয়ে থাকা সুমনার চোখ এড়ায় নি। এক পাশ হয়ে শুয়ে সে মেয়েকে ফিডিং করাচ্ছিল। মেয়ের চোখ সবে লেগে এসেছে। এক হাতে সে মেয়েকে নিয়েছে অন্য হাতে তার মোবাইল।

আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

-কি রে এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন মোবাইলের দিকে? আবার ঘামছো ও?কোন প্রাক্তনের ছবি সামনে এলো নাকি?

আমি নিস্পৃহ চোখ দুটো কবে সিক্ত হয়ে উঠেছে তা আমার খেয়াল হয় নি।
সুমনার দিকে তাকাতে তার দুষ্টমি ভরা চেহেরাটা হঠাৎ উৎসুক হয়ে গেল। মেয়েকে হাত থেকে বিছানায় রেখে আমার দিকে এগিয়ে এলো।
গালে আলতো হাত রেখে বলল,

- এই রণ। কি হয়েছে?
সে মোবাইলের তাকিয়ে দেখল, তেমন কিছুই যেন তার চোখে পড়ে নি এমন ভাবে আবার আমার দিকে তাকালো।
যেন তার চোখ জানতে চায়ছে, কি দেখলাম আমি?

আমি তাড়াতাড়ি মোবাইল টা পাশে রেখে শুয়ে পড়লাম।
গলাটা ধরে এসেছে। তারপর ও একটা কাশি দিয়ে বললাম,
-কিছু না, ঘুমিয়ে পড়।

আমার এই টোন টা সুমনার অচেনা। তাই সে কথা বাড়ালো না।
ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। তারপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। একটু পরে ও ভারী নিশ্বাস শুনতে পেলাম। মেয়ের পেটের উপর আলতো করে হাত রাখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সারাদিন ক্লান্ত থাকে ছোট বেবি নিয়ে।

আমার চোখ আবার খুলে গেল। কোণা বেয়ে গরম চোখের পানি কানে ঢুকে পড়ছে। আমি মুছার কোন চেষ্টা করলাম না।

প্রায় এক যুগ পর তাকে দেখলাম। এক ঝলকেই যেন পুরো আজাদপাড়ার জীবন টা সামনে চলে আসছে।

সে যখন আমাদের জীবনে এসেছিল তখন আমি সদ্য সেভেনে উঠেছি। ভাইয়া কলেজে পা দিয়েছিল। রুমানা আপু ক্লাস নাইনে। আর সুমি মাত্র হাটা শিখছে।

আমরা ছোট বেলা থেকে যেমন খুশি তেমন আবদারে বড় না হলেও অভাব আমাদের ছিলো না। দুবেলা ভাত অনায়সে খেয়েছি। ধরা যায় আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত ছিলাম।
সেটা আরো পাকাপোক্ত হলো যেদিন সে এসেছিল আমাদের ঘরে।
নিজেই হাসলাম, যেন আমি কোন প্রিয় মানুষের কথা ভাবছি।
প্রিয় মানুষ?
শব্দ টা নিজেই আওড়ারালাম, কোন জড় বস্তুও যেন প্রিয় মানুষের জায়গা নিতে পারে সেদিন ও আমরা বুঝি নি। যখন সন্ধ্যায় সবাই পড়তে বসেছিলাম আমাদের লম্বা বারান্দায়। ঘরের সামনে বেলি গাছ লাগিয়েছিল রুমানা আপু। সবে বেলি আসা শুরু হয়েছে। কোথায় যেন এক নাগারে ঝি ঝি ডাকে। কিন্তু ভ্যাপসা গরম কারেন্ট চলে গেসে। তীব্র আলো দেওয়া চার্জলাইট টা জ্বলছে, কিছু পোকা এসে জড়ো হয়। কিছুক্ষন পর এইগুলো ডানা ভেঙে পড়ে।

বাবা প্রথম ডাক দিলো,
- এই রণ, এই রানা, এই রুমানা দেখ।

খোলা বই ওভাবেই ফেলে আমরা ছুটলাম। আমাদের কাঠের দরজাটা দিয়ে বাবা ঢুকল তার সদ্য কেন বাইক টা নিয়ে।

বাবা নিয়ে ঢুকল তার প্রথম আর শেষ বাইক টা।
লাল আর কালো রং এর ছিল। প্রথমে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি।
সবে সিনেমায় নায়ক দের বাইক স্টান দেখা শুরু করেছিলাম।
অনেক খুশি হলাম। বাবার খুশি ছিল উপরে পড়ার মত।আমার খাটুনি ছাপ পড়ার বাবার চেহেরায় সেদিন হীরে বসানো আন্টির মতো জ্বলজ্বল করছিল চোখ গুলো। গাল গুলো লালচে হয়ে উঠেছিল। আমি জানি না। আমি বাবাকে এমন ভাবে খুশি হতে আর কখনো দেখেছি।

না আর দেখি নি। কখনো দেখি নি৷ হয়ত আমাদের কারো জম্মের সময় বাবার এমন চেহেরাটা ছিল। জানা নেই।
সেও ছিল বাবার আরেক সন্তান।

বাইক টা আসায় পুরো পাড়া,পুরো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে আমাদের লেভেল যেন অনেক উপরে উঠে গেল। যেই আসুক ঘরে আগে বাইক দেখতে আসতো। হাত বুলাতো। পাড়ার ছেলেরা ভীড় জমাতো।
বাবা সকালে যখন অফিসে বের হতো আমাদের মন খারাপ। বাইকের জন্য। বাবা ফিরলে,ভাইয়া নিয়ে বের হতো। জিদ করলে মাঝেমধ্যে আমিও উঠতাম মাঝেমধ্যে।
মোড়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালে সবাই সমীহ চোখে তাকাতো।
মেয়েরাও আঁড় চোখে তাকাতো ভাইয়ার দিকে। আমিও খেয়াল করে একটা মুচকি হাসি দিতাম।

লং ড্রাইভ শব্দ গুলো তখন আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল।
তবে মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা নামার পর মা তার ন্যাপথলিন দিয়ে তুলে রাখা কাজ করা শাড়ি টা পড়তো। একটু ক্রিম মাখতো। পেছনে টেনে চুল বেঁধে একটা পাথরের ক্লিপ লাগাতো। একটা টিপ পরতো। আপুর ড্রায়ার খুলে সবচেয়ে হাল্কা লিপস্টিক টা লাগাতো৷ কি যে সুন্দর লাগতো মাকে।

তখন সন্তানদের সামনে মায়েদের রোমেন্স হতো না। মা ভীষণ রাগী গলায়, ব্যস্ত সুরে আমাদের বলে যেত, মা কোন দরকারি কাজে যাচ্ছে। এসে যেন দেখে সবার বাড়ির কাজ শেষ।

আমারা মাথা নাড়তাম৷ মা ভীষণ লজ্জিত মুখে বাবার পেছনে উঠে বসতো।

আমরা হাসতাম না। তবে কি একটা ঠান্ডা বাতাস যেন চোখে লাগতো। ওটা তে বেলি ফুলের সেই সুভাষ ও থাকতো।

বাবা বার বার বলে,
- ভালো করে ধরে বসো। পড়ে গেলে হাড্ডি-গুড্ডি ভাঙ্গবে। আমাকে ধরে বসো।
মায়ের মুখ লাল হয়ে উঠতো।

অস্থির গলায় বলে উঠতো,
-বেশ পারব।
গলা নামিয়ে বলতো,
-তোমার আর আক্কেল হবে না। বাচ্চাদের সামনে।

বাবা চুপ হয়ে যেত ভীষণ আস্তে আস্তে বাইক চালাতো৷ মোড় পাড় হলে মায়ের হাত বাবার কাঁধে উঠে যেত।
ঘুরে আসতো। আমরা জানতাম না। যখন জেনেছি, তখন কেউ বলে নি আমাদের। যখন বয়স হয়েছে তখন জেনে গেলাম আপনাআপনি।

ভীষণ লোডশেডিং হতো। অনেক সময় চার্জলাইট ও থাকতো না। তখন বাইকের লাইট জ্বালিয়ে বাইরে বসে সবাই ভাত খেতাম। যেন পিননিক চলে।
বাইকটাও মনে হতো হাসছে আমাদের কান্ড দেখে৷

বাইকের কোথায় ও কোন এক্সিডেন্ট হলে কষ্টটা ভীষণ লাগতো।

ভাইয়া একটা সাইড মিরর ভেঙে ফেলেছিল। বাবা ভাইয়াকে স্যান্ডেল দিয়ে কি মাইর দিয়েছিলো।

আমরা সবাই রেগে ছিলাম এমন কি মা ও।
যেন ঘরের সবচেয়ে আদরের দুলালীকে কেউ আঘাত করেছে।

প্রায় আট বছর ছিলো আমাদের সাথে বাইক টা। কত আত্মীয় স্বজনের কাজে লেগেছে। বাবার ভাইয়া আমি রাত দুপুরে ছুটেছি। কত কাজে অকাজে আমাদের ভুলে নিজে আঘাত সয়ে নিয়েছে সেই বাইক টা।

ভাইয়া আর কামিনী আপুর প্রেম টাও ধরা পড়েছিল বাইকের কারণে। ভাবী এখনো মাঝে মধ্যে বলে,
- তোমার ভাইয়া বাইক দেখিয়ে, বাইকে চড়িয়ে তখন আমাকে প্রেমে ফেলেছে আর কি।

মায়ের যখন ক্যান্সার তখন ভাবী যে সেবা মাকে করেছে আমরা অবাক হতাম। হয়ত বাইক টা না থাকলে এমন ভাবী আমরা পেতাম না।

বাইক টার শক্তি কমে আসছিল আজ এই সমস্যা তো কাল এই সমস্যা। এইটার ব্যয় যেন আলাদা একটা বাজেট।
শেষের দুইবছর আমিই ব্যবহার করেছি বাইক টা। চাকরি টা হয়েছে অনেক দূরে। বাইক ছিল বলেই চাকরি টা পাওয়া হয়েছিল।
যেন অন্তরের অন্তর একটা বন্ধু। কত স্মৃতি আছে। গাড়িটা মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে যেত। তখন বন্ধুরা বলত।
-এই ভাঙ্গারী বিক্রি করে ভালো একটা বাইক নেয়।
আমি শুধু মুচকি হাসতাম। কিন্তু বুকে কি যেন ফুটতো। যেন কোন প্রিয় প্রেমিকা ছেড়ে দিতে বলছে কেউ।

বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা যাওয়া আর মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়াতে পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে গেল। রানু আপুর বিয়ে হয়ে গেল৷ ভাইয়ার একা ইনকামে সব। আমার সামান্য কিছু ইনকাম তখনো।

তারপর ও বাইক টা বিক্রি করার কথা কেউ ভাবে নি।

কিন্তু মায়ের শেষ কেমোটার জন্য টানাটানি পড়ে গেল।

না চাইতেও সবাই যেন,
ভাবতেই গলাটা আটকে গেল। টানাটানির সংসারে তখন বাইক টা মস্ত বড় বিলাসিতা।

মাকে জানানো হয় নি। কিন্তু মা হসপিটালে থেকে বুঝেছিল। মা জিজ্ঞেস করেছিল,
-গাড়ি কোথায় রেখেছিস?

আমার না বলা উত্তর মা কি যেন বুঝলো। বলল-
-আমি তো মরেই যাব। গাড়িটাও হলেও তোর বাবার স্মৃতি -

মা শেষ করতে পারে নি।
মা আরো এক বছর বেঁচে ছিলেন। মায়ের রুমে ওয়ারড্রাবের উপর বাবার ছবির পাশে হেলমেট টা ছিলো অনেক গুলো দিন।

আজ অনেক গুলো বছর পর পুরানো সেই বাইক টা পুরানো জিনিস পত্র বিক্রির একটা গ্রুপে দেখলাম।
হয়ত একই মডেলের অনেক গাড়ি আছে। কিন্তু এইটা সেই গাড়ি। সেই বাইক। সে বাইকে বাবার ঘাম। বাবা মায়ের কিছু মূহুর্ত। ভাইয়া ভাবীর প্রেম। আমার দূরের সেই চাকরির সাথী। মায়ের শেষ কেমো। ভেঙ্গে যাওয়া সেই সাইড মিরর বাবার যত্নে লাগিয়েছিলো সুপার গ্লু দিয়ে। দাগ দেখা না যাওয়ার জন্য একটা লাল স্টিকার লাগানো হয়েছিল। সেটা এখনো আছে।
আমি কোথায় ও নিয়ে গেল হারিয়ে আসব সে ভয়ে সুমি সিটের পাশে নেইলপালিশ দিয়ে লিখে দিয়েছিল ''R''.

মোবাইল টা আবার হাতে নিলাম। পোস্ট দাতাকে নক করলাম। আমি এইটা নিতে চাই। যত দাম হোক।

দেখলাম সে সিন করে নি। ভাবলাম ঠিকানাটা দিলে সকালেই গিয়ে নিয়ে নিব।
ভাইয়ার বাংলো বাড়ি এখন।
আমার এপার্টমেন্ট আমাদের দুজনের জন্য দুইটা কার বর্তমানে। বাইক থাকে না সে গ্যারেজে।

রুমানা আপুর ও এখন বাচ্চাদের জন্য ও গাড়ি। সুমির এখনো বিয়ে হয় নি। চাকুরী তে মনোনিবেশ এখন। তার একটা গাড়িতে এখন লাগেই।

ভাবতে লাগলাম বাইক টা নিয়ে এসে সারপ্রাইজ দেওয়া যায়।

এখন রাত চার টা। সুমনা কে ডেকে তুললাম।
ওকে ডাকতেই ধরপড়িয়ে উঠে বসল সে,
-কি কি?
প্রথমেই মেয়েকে চেক করলো৷

- কি হয়েছে?
-কিছু না। কাল সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিলে তোমার অসুবিধা হবে?

বেশ অবাক হয়ে বলল,
- আমার কি অসুবিধা হবে?

-না মানে, সব জোগাড় করা, রান্না বান্না একটা ব্যাপার আছে না?

-কেন? কি হয়েছে? কি উপলক্ষে? কিছু আছে কাল? কারো জম্মদিন?

-তেমন কিচ্ছু না। তবে ভীষণ স্পেশাল।

সুমনা অবাক হলেও তেমন কিছু আর জিজ্ঞেস করল না।

হাই তুলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,
- কাল সকালে ফোন দিবে আর কি। এখন সবাই ঘুমাচ্ছে।

-আচ্ছা।
বলে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম আসছে না।
মোবাইল হাতে নিয়ে আবার নক করলাম সে সেলার কে।
-ভাইয়া আপনার লোকেশন টা দিয়েন। কাল সকালে আসব।

মেসেজ ডেলিভার হয়েছে তবে সিন হচ্ছে না। হওয়ার কথাও না রাত চারটা বাজে।

সকাল ছয়টার দিকে চোখ লেগে এসেছিল একটু পরেই মেসেঞ্জারে টুং করে উঠল। নরমেলি সারাদিন এর্লাম বাজলেও ঘুম ভাঙ্গে না। মেয়ের কান্নাতেও ঘুম ভাঙ্গে না। সুমনা রাগ করে বলে,
-এমন মরার ঘুম কেমনে ঘুমাও?
কিন্তু আজ ঘুম ভেঙে গেল সামান্য মেসেজের শব্দে।

হ্যাঁ, সে সেলারেই রিপ্লে করেছে।

-সরি ভাইয়া এইটা তো আপনি নক দেওয়ার আগেই বুক হয়ে গেল। দশটার নিতে আসবে। দুঃখিত আমি ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সেল পোস্ট টা ডিলিট করতে পারি নি।

যে একটা অনুভূতি নিয়ে পুরো জেগে ছিলাম। নরম তুলতুলে সে রাজহাঁসটা এতক্ষন সাঁতার কাটছিল। তার গলার কেউ যেন শক্ত চামড়ার জুতো দিয়ে পা চেপে ধরেছে। গোঁ গোঁ একটা শব্দ বের হয়ে আসছে। যার কোন শব্দ নেই।

দুচোখ বেয়ে আবার যেন গড়িয়ে পড়ছে মায়ের সে লাজুক চেহেরাটা আবেগ হয়ে।

আমি মেসেস দিলাম,
-প্লিজ এইটা আমি নিতে চাই।
-আমার কাছে আরো অনেক মডেলের নতুন পুরাতন গাড়ি আছে৷ আমি এইটা তো দিতে পারছি না।

-আমার এইটায় লাগবে। আপনার লোকেশন টা দেন আমি আসছি।

সে লোকেশন দিল। আবার বলল,
-ভাইয়া আমি ঝামেলায় পড়বো যে। দুজন কে কীভাবে দিই?
-একটু বলে দেখেন। দরকার হলে আমি বুঝাবো।

-আচ্ছা দেখি।
আমি আর দেরি না করে দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম। যে লোকেশন দিয়েছে তা গাড়িতে করে গেলেও তিন থেকে চার ঘন্টা লাগবে।

রেডি হয়েছি দেখে সুমনা বলল,
- এই ছুটির দিনে কই যাচ্ছো?

তাড়াতাড়ি করে বের হতে হতে বললাম,
- আমি কাজে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি আসব। তুমি সবাইকে আসতে বল।

-আরে শোন, আমি বলেছি। তবে ভাবী বলছিল আজ নাকি রিতুর জম্মদিন। ওরা ভেবেছিল কিছু করবে না। এখন সবাইকে যখন করব বলেছি ভাবী বলছিল ওখানে চলে যেতে।

-তাহলে ঠিক আছে। যাও। সবাই যেন থাকে। আমি সারপ্রাইজ নিয়ে আসছি বলো।

-কি সারপ্রাইজ?

-তুমি বুঝবে না।

আজ ড্রাইভার নেই। নিজেই ড্রাইভ করে বের হয়ে গেলাম।

মোবাইলে সেই সেলার ফোন দিচ্ছে। আমি ধরছি না। যদি সে বলে, দিতে পারবে না।
না, আমি কোন না শুনতে চাইছি না। সেখানে পৌঁছালে কিছু একটা করার সুযোগ থাকবে।

টানা তিন ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে পৌঁছালাম সেখানে।

আমাকে দেখে ছেলেটা বুঝতে পারলো, বলল,
-আমি ফোন দিচ্ছিলাম আপনাকে,না আসার -

সে কথাটা শেষ করার আগেই আমি বলে উঠলাম।
-বাইক টা কোথায়?
সে কেমন যেন চোখে বলল, আছে ভাই। তবেই এখনিই উনি নিতে আসবে।

-আপনি উনাকে অন্য গাড়ি দেন।
- ভাই ওটা বড় একটা কোম্পানি। ওরা পুরানো গাড়ি গুলো নিয়ে ভেঙে ফেলে-
আমার পুরানো ক্লায়েন্ট। কীভাবে যে মানা করি?

বুক টা আবার মোচড় দিয়ে উঠল।
- না না। প্লিজ।আমার এই গাড়ি টা লাগবে।

সে আমার কারের দিকে তাকিয়ে বলল,
-পুরানো বাইকের জন্য এমন করছেন কেন?

আমার চোখের পানি এইবার ছল ছল করছে, এত দূর এসে কি হাত ছাড়া হয়ে যাবে?

অন্য জন ক্রেতাটাও চলে আসল, তাকে অনেক বুঝিয়ে বললাম,
-এইটা আমার বাবার শেষ স্মৃতি।

অনেক বলেন বুঝানোর পর বাইকটাকে দেখলাম।

কেমন যেন সিক্ত হয়ে গেল বুক টা। অনেক চেষ্টার পর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।
বাইক টা সামনে দাঁড়িয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
কাল থেকে মনে পড়া সব স্মৃতি যেন হুর হুর করে বের হয়ে আসছে।

সেলার ছেলেটা আমাকে ধরে বলল,
-ভাইয়া সামলান নিজেকে। কে নিয়ে যাবে এইটা? আপনি তো গাড়ি এনেছেন।।

-আমিই চালিয়ে নিয়ে যাব। গাড়িটা আমি রেখে যাচ্ছি আমার ড্রাইভার কে আমি পাঠিয়ে দেব।

বাইক টার উপরে উঠে বসতেই যেন ঝাকুনি দিয়ে উঠল।

ঝর ঝর করে ঝড়ে পড়ছে। খুব প্রিয় মানুষ কে বুকে লাগালে যে একটা প্রশান্তি অনুভূতি হয় তা যেন হতে লাগল।যেন জমানো কোন ক্ষতে মলম লাগালো কেউ,প্রথমে জ্বললো তারপর ঠান্ডা হতে শুরু করল৷

সুমনাকে ফোন দিলাম কোথায় ওরা। ও জানালো সে ভাইয়ার বাংলো তে আছে। সবাই ওয়েট করছে ওর জন্য।

সুমনা কে বললাম, আর দশ মিনিট পর সবাইকে নিচে আসতে বলো। ভাইয়া আপু আর সুমিকে।

-কেন?
- আসলে দেখবে।

বাইক টা চালিয়ে যখন ভাইয়ার বাংলোর গেইটে ঢুকলাম বুঝাতে পারব না কি ভালো লাগছিল।

ভাইয়া আপু প্রথমে বুঝত্র পারল না। আমি গিয়ে বাইক থামাতেই বলল,
- কি রে কেন আসতে বলেছিস?

ভেতর থেকে সুমি দৌড় দিল,
- আমাদের সেই বাইক টা?

কথাটায় ভাইয়া আর আপু চমকে উঠে তাকালো। তারা যেন বিশ্বাসেই করতে পারল না এমন চোখে তাকালো। ভাইয়াও চিন্তে পারলো।
ভাইয়ার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
হাত নেড়ে বুঝাতে চায়ছে, আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
- হ্যাঁ আমাদের সেই লাল বাইক টা।

ভাইয়ার চোখে পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা চলছে কিন্তু পারছে না।
রাবেয়া আপু ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। উড়নার কোণা তখন ভিজে গিয়েছে। সুমির কান্নার শব্দে পরিবেশ টা ভারী হয়ে উঠেছে।
সবাই বের হয়ে এলো। বাচ্চারা বুঝতে পারছে না সবাই এইভাবে কাদঁছে কেন। কিন্তু ভাবী পরম যত্নে হাত বুলালো।

আমি নেমে ভাইয়ার হাতে চাবি দিলাম ভাইয়ার হাত থর থর করে কাঁপছে।

কেউ কোন কথা বলতে পারছে না। শুধু আমার নয় সবার মনেই এতগুলো বছর ধরে গেঁথে আছে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের বিলাসিতার সেই লাল বাইক টা।

আমাদের লাল বাইকটা
দোলনা বড়ুয়া তৃষা

এই জোসনা ধারায়পর্বঃ ৩৬ইসরাত জাহান তানজিলারাহাতের বাসার দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সম্পা ফট করে দরজা না খুলে লুকিং গ্লাস ...
15/06/2024

এই জোসনা ধারায়
পর্বঃ ৩৬
ইসরাত জাহান তানজিলা

রাহাতের বাসার দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সম্পা ফট করে দরজা না খুলে লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলো ফুয়াদ এসেছে। একা আসেনি সঙ্গে দুইজন পুলিশ নিয়ে এসেছে।

কী আশ্চর্য, ভয়ঙ্কর কাণ্ড! সম্পা চেঁচিয়ে ভীতু গলায় বলল,

-দেখো ফুয়াদ সত্যি পুলিশ নিয়ে এসেছে।

রাহাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত রেগেমেগে আগুন হয়ে দরজার কাছে গেল। সে ভাবতে পারেনি ফুয়াদ সত্যি পুলিশ নিয়ে আসবে। ফাজলামি, খামখেয়ালির একটা সীমা থাকে! এই সামান্য কারণে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের বাসায় কেউ পুলিশ নিয়ে আসতে পারে! পুলিশ নিয়ে আসা কোনো তামাশার ব্যাপার নাকি! তাও এই ভাড়া বাসায়! আর পুলিশের কাছে কি বলে অভিযোগ করেছে ও?

সম্পা রাহাতকে দরজা খুলতে বাঁধা দিয়ে বলল,

-প্লিজ দরজা খুলো না। সত্যি আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।

রাহাত বিরক্ত মুখে সম্পাকে সরিয়ে দিয়ে সজোরে দরজা খুলে। ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,

-এদেরকে কোথা থেকে ভাড়া করে এনেছিস? বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু! এদেরকে নিয়ে এক্ষুণি এখান থেকে যা।

ফুয়াদ নির্লিপ্ত মুখে বলল,

-ভাড়া করে আনিনি। ওনারা আসল পুলিশ।

রাহাত আরো খেপে গেল,

-মা তোকে পুলিশে দিয়েছে বলে আমরা বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তোর তো আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিলো বিদেশ যাওয়ার। টাকা-পয়সা সরিয়েছিস। আমাদের তো কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। হাতে টাকা পয়সা যা ছিলো সব কাছিয়ে এসেছে। এই মাস পরই চাকরির খোঁজে বের হতে হবে। মা ও আমাদের বাড়িতে সাধছেন না। সকালে টেবিল ভর্তি নাশতার বদলে এখন শুধু পরোটা ভাজি জুটে। সতেরো পদের তরকারি পাই না ভাতের টেবিলে। এসি রুমে ঘুমিয়ে অভ্যাস! এসি গাড়িতে চলাফেরা করে অভ্যাস। এখন রোদের মধ্যে রিক্সায়...।

ফুয়াদ কথার মাঝে রাহাতকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-নশ্বর এই পৃথিবীতে এত সুখ করে কি হবে!

এরপর ও পুলিশকে বলল,

-এই মামলার আসামি এই একজনই। আমার ধারণা ভাবী নির্দোষ। তার মত সহজ-সরল নরম মনের মানুষ নিশ্চয়ই এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় ছিলেন না।

সম্পা এবার দরজার সামনে এসে ভারী আহত গলায় বলল,

-তুমি সত্যি মামলা করেছো ফুয়াদ! এই তুচ্ছ বিষয়ে কেউ মামলা করে! ভাইয়ে ভাইয়ের ব্যাপার। মামলা না করে আমাকে বলতে। প্রয়োজন হলে আমি তাকে দুই দিন খেতে দিতাম না।

রাহাত উত্তেজিত মুখে বলল,

-অনেক ফাজলামি হয়েছে। যা এখান থেকে। নয়ত এই পুলিশ সহ তোকে বাথরুমে আটকে রাখবো। এই বদমাইশ কিসের মামলা করেছিস? কি অভিযোগে? কত ধারায়?

সম্পা চাপা গলায় ফিসফিস করে বলল,

-বাথরুমে আটকানোর দরকার নেই। বাসায় ঢুকলেই কিন্তু ও আমার প্লেট, গ্লাস...।

-থামো তুমি।

ধমকে উঠলো রাহাত। এর ভিতর একজন পুলিশ সদস্য গুরুগম্ভীর গলায় বলল,

-আপনি কিন্তু আমাদের অপমান করছেন। আমরা নকল পুলিশ নই। দুই মিনিট সময় দিলাম আপনাকে। শার্ট গায়ে দিয়ে দ্রুত আমাদের সাথে চলুন। আপনার নামে কি অভিযোগ, কত ধারায় মামলা হয়েছে থানায় গেলেই জানতে পারবেন। দুই মিনিট সময় কিন্তু। কোনো গড়িমসি করলে জোর করে ধরে নিয়ে যাবো। সেটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না।

সম্পা অসহায় মুখে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এই তুচ্ছ কারণে তুমি সত্যি সত্যি নিজের ভাইকে পুলিশে দিবে!

দুই মিনিট পেরিয়ে গেলেও রাহাত শার্ট গায়ে দিলো না। দরজার সামনেই অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাগে ওর মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। ভাড়া বাসা বলে চিৎকার, চেঁচামেচি করতেও পারছে না।

-দুই মিনিট পেরিয়ে গেছে কিন্তু।

রাহাত থমথমে গলায় সম্পাকে আদেশ করলো,

-যাও একটা শার্ট নিয়ে আসো।

-সত্যি তোমাকে থানায় নিয়ে যাবে!

-দেখতে পাচ্ছো না! এত কথা বলছো কেন? যাও শার্ট নিয়ে আসো।

সম্পা শার্ট এনে বলল,

-আমিও তোমার সাথে যাবো।

আমিনুল নামের পুলিশ সদস্যটি বললেন,

-আপনাকে এই মামলার আসামি করা হয়নি। আমরা আপনাকে নিতে পারবো না। দুঃখিত!

রাহাত শার্ট গায়ে দিতে দিতে ফুয়াদের দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বলল,

-আসি থানা থেকে। তোকে যে আমি কি করবো।

-এসো চল্লিশার দাওয়াত তোমাকে।

সম্পা ভেবেছিল ফুয়াদ শেষমেশ নিশ্চয়ই বলবে এসব ফাজলামি। কিন্তু না! রাহাতকে সত্যি সত্যি পুলিশে নিয়ে গেল। সম্পা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছে। ওর এবার কান্না পাচ্ছে।

ফুয়াদ পুলিশের সঙ্গে যায়নি। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পায়ে জুতা খুলছে। জুতা খুলে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে বলল,

-ভাবী দুপুরে আমার জন্য রান্না করার প্রয়োজন নেই। আমি এশাদের ওখানে খাবো। আচ্ছা গতকাল রাতে আমি ফুল নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো কোথায়?

ফুয়াদের আচরণে সম্পা বাক্যহারা হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর বিহ্বল হয়ে বলল,

-আমার স্বামীকে তুমি পুলিশে দিয়েছো। আবার আমাদের বাসায় ঢুকে শুয়ে আছো! এসব কি মশকরা শুরু করেছো!

-রিল্যাক্স ভাবী! আপনি সন্তানসম্ভবা মানুষ। এত চাপ নিবেন না।

-আমি তোমাকে মনে মনে কুৎসিত বকাঝকা করছি ফুয়াদ। ভদ্রতার খাতিরে শুধু মুখ দিয়ে বের করতে পারছি না।

-ভেরি গুড ভাবী। আপনার এই ভদ্রতা আমাকে আপ্লুত করছে। আচ্ছা এশা কোন বাসায় টিউশন করে আপনি চিনেন? ওর নতুন ফোন নম্বর জানেন?

সম্পা আর কোনো কথা না বলে ধপধপ করে পা ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। শব্দ করে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।

ফুয়াদ কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে এরপর উঠে গতকালের ফুল গুলো খুঁজলো। টেবিলের উপরে রেখেছিল। সেখানেই পেল। সম্পাকে ডেকে বলল,

-ভাবী আমি বের হচ্ছি। দরজা আটকে দেন।

সম্পা দরজা আটকে এশাকে ফোন করলো।

-শুনো এশা তোমার স্বামী রাহাতকে পুলিশে দিয়েছে।

-মানে! কি বলছেন ভাবী!

-যা শুনছো তাই বলছি। তুমি কোথায় এখন?

-আমি ক্যাম্পাসে। দুইটা ক্লাস শেষ হলো। ফুয়াদ রাহাত ভাইয়াকে পুলিশে দিয়েছে কেন?

এশা বিচলিত গলায় জানতে চাইলো।

-সেই কাহিনী বলার মেজাজ নেই এখন। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলবো। ওই বদমাইশের সঙ্গে এত সহজে ভাব করো না। সহজে পাওয়া জিনিসের মানুষ কদর করে না। ওকে নাকি দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। নিজের ভাইকে পুলিশে দিয়েছে ও!

এই বলে সম্পা ফোন কেটে দিলো। এশা আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। ও সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করলো। এই মুহূর্তে সম্পার ফোনে কথা বলার মেজাজ নেই। সে ফোন ধরলো না।
__

ফুয়াদ অস্থির ভঙ্গিতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চৈত্র মাসের কাঠফাটা রোদে যেমন ভীষণ পানির তৃষ্ণা পায়। ওর ও সেরকম এশাকে জড়িয়ে ধরার তৃষ্ণা পাচ্ছে। ওই মেয়েটাকে বুকের মধ্যে আধা ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে রাখতে পারলে বোধ হয় ওর সকল অস্থিরতা দূর হবে।

এশার সঙ্গে সংসার করবে, ওকে যত দ্রুত সম্ভব লন্ডন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় ফিরেছিলো ফুয়াদ। তবে ওর জন্য এত আকুলতা, তৃষ্ণা নিয়ে ফিরেনি। রাহাতের এক কূট-বুদ্ধিতে ও কেমন ওলটপালট হয়ে গেল!

এশাকে আগে জড়িয়ে ধরবে নাকি ফ্ল্যাটে না থাকার জন্য ধমক দিবে? রাহাত এই কাজ না করলে আগে কিছুক্ষণ প্রচণ্ড রাগারাগি করতো, ঝাড়ি দিতো। এশা নিশ্চয়ই তীব্র রাগ, অভিমান করে আছে। এই মেয়ের এত অভিমান ও আগে বুঝতে পারেনি। বোঝার চেষ্টাও তো করেনি। এখন বুঝতে হবে রাগ, অভিমান, অভিযোগের তীব্রতা কতখানি। লন্ডন যাওয়ার আগে ভাঙাতে পারবে তো?

কয়েক কেজি মিষ্টি, ফলমূল কিনে মিনারা বেগমের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো ফুয়াদ। এশা এখনো ফিরেনি! অসহ্য ধরণের অপেক্ষা। ফুয়াদের মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ঘুরেফিরে সেই রাহাতের উপর গিয়েই রাগটা চাপছে! সে অমন ভয়াবহ ফাজলামি না করলে ওর মন এত উতলা হতো না।

মিনারা বেগম মাছ, মাংস কিনে আনে মেয়ের জামাইয়ের জন্য। একা হাতে এত রান্নাবান্না করতে সময় লাগছে। দুপুর গড়িয়েছে। তার রান্না এখনো শেষ হয়নি।

ফুয়াদ রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-আন্টি আমি রান্নাবান্না মোটামুটি জানি। আপনাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি?

এই ছেলের মাথায় কি সত্যি গণ্ডগোল হলো! তার সেই বড়লোক, নাক উঁচু মেয়ের জামাই আজ তাকে রান্নায় সাহায্য করতে চাচ্ছে। কি ভয়াবহ ব্যাপার!

-আপনি কি আবার ভাবছেন আমার মাথায় সত্যি সমস্যা হলো কিনা! আসলে এশা এখনো ফিরছে না তো। অপেক্ষা ব্যাপারটা খুব কষ্টদায়ক। আপনাকে রান্নার কাজে সাহায্য করলে সময়টা একটু দ্রুত কাটতো।

ফুয়াদ এশার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছে! কি এক আনন্দে মিনারা বেগমের মন পুলকিত হয়। সেই আনন্দ তার গলায়ও প্রকাশ পেল,

-না, বাবা! কি বলছো। আমার রান্নাবান্না প্রায় শেষ। শুধু মুরগি ভুনাটা বাকী আছে। তোমার কোনো সাহায্য করতে হবে না।

-ঠিক আছে তাহলে মুরগিটা আমি ভুনা করার চেষ্টা করি।

ফুয়াদ রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকে মুরগি রান্না শুরু করে। মিনারা বেগম একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখেমুখে আশ্চর্য ভাব।
__

এশার শরীর দুর্বল লাগছে। ও আজ ক্লাস শেষে টিউশনে না গিয়ে বাসায় ফিরলো। দরজার সামনে এসেই ফুয়াদের জুতা দেখতে পেল। ওর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। কেমন উত্তেজনা, অস্থিরতা অনুভব করে। যে মানুষটাকে ও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তার উপস্থিতি ওর মনে এত ব্যগ্রতা তৈরি করছে কেন? সন্তান হওয়ার খবর জেনে ওর মন কি অজান্তেই সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেছে? নাকি এটা না হলেও একই অনুভূতি হতো?

ধীর পায়ে বাসার ভিতর প্রবেশ করলো এশা। দুই রুমে উঁকি দিলো। ফুয়াদকে দেখছে না। বাথরুমও বাইরে থেকে আটকানো। ও রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে অস্থির গলায় ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

-মা দরজার সামনে জুতা কার?

এশার আওয়াজ পেয়েই ফুয়াদ ভীষণ উদগ্রীব হয়ে এসে তৃষ্ণার্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অতিশয় আকুল গলায় বলল,

-এশা আমি তোমাকে এক ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে রাখতে চাই। আন্টি এখানে। রুমে চলো প্লিজ।

ফুয়াদের এই তীব্র আকুলতা উপেক্ষা করে এশা নীরস গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি রাহাত ভাইয়াকে পুলিশে দিয়েছেন কেন?

-এসব কথা পরে বলবো। তোমাকে জড়িয়ে ধরার তৃষ্ণায় আমার বুকের ভিতর চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

-আগে বলুন।

ফুয়াদ অধৈর্য গলায় বলল,

-এই খবর তোমাকে কে দিলো! সে আমার অনেক বড় উপকার করেছে। আমাকে কিছু ব্যাপার সঠিকভাবে উপলব্ধি করিয়েছে। যেগুলো আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

-তাহলে তাকে পুলিশে দিলেন কেন?

-পুলিশে দিয়েছি এটা সঠিক। তবে পুলিশ তাকে থানায় নেয়নি। বিরিয়ানি খাওয়াতে নিয়েছে।

-কিসব তামাশা করেন আপনারা!

-এখানে বসেই জড়িয়ে ধরবো তোমাকে?

ফুয়াদের গলা কিছুটা অসহায় শুনালো। এশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রত্যুত্তর করলো,

-আপনার স্পর্শ আমার ভালো লাগবে না। দুপুরে খেয়ে এখান থেকে চলে যাবেন। আমি আপনার সাথে বিয়েটা রাখবো না।

চলবে...

Address

Cox's Bazar

Telephone

+8801610000000

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Sharmin Hridi posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Sharmin Hridi:

Videos

Share


Other Digital creator in Cox's Bazar

Show All