19/01/2025
ইন্টারে পড়াকালীন সময়ে অসুস্থতাজনিত কারনে প্রায় ৯ দিন একটানা কলেজে যেতে পারিনি। মোটামুটি একটা পর্যায়ে গিয়ে যেদিন কলেজে গেলাম, জানিনা সেদিন কলেজে গিয়ে কোনো ভুল করেছিলাম কিনা, কলেজটাকে, প্রিয় ক্লাসটাকে ভালোবাসতাম বলেই আব্বু আম্মুর কথা না শুনেই চলে গেছিলাম, আমাদের ম্যাথের শিক্ষক আমাকে এমনভাবে, এমন সব কথা বলে অপমান করলেন যে ১৬ বছর বয়সী আমিও আমার বন্ধুদের সামনে রাগে দুঃখে ক্ষোভে চোখের পানি আটকাতে পারিনি। স্যার ক্লাস থেকে চলে যাওয়ার পর পরই আমার বন্ধুদের সামনে ছোট বাচ্চার মত কেঁদেছিলাম।
স্যারের কথাগুলো সেদিন পর্যন্তও আমার কানে বাজতো....
১/ আমার আব্বু কৃষিকাজ করতেন, আমরা ৫ ভাই বোন, আমার সিরিয়াল ৪। স্যার বলেছিলেন "তোর বাপ পড়াইতে পারে না, খাওয়াইতে পারে না, তাইলে এতগুলো পয়দা করাইছে কেন???
2/ গোবরে কখনো পদ্মফুল হয় রে পাগল?? ওটা গোবরে পোকার জন্যই বরাদ্দ।
৩/ পড়াশোনা সবার জন্য না, যার স্যারেদের টাকা দিতে ২০০ টাকার টিউশানি করা লাগে, তার পড়াশোনা না করে লাঙল ধরাই ভালো।
৪/ ছোটবেলা থেকে এভাবে বড় হলে সারাজীবন এমন অসুখেই থাকবি, তা আর নতুন কি???
৫/.......
৬/.......
আরো আরো আরো আছে, যেগুলো লেখার যোগ্য নয়। তবে আমার ডায়েরিতে স্পষ্ট করে লেখা আছে।
আমার একটাই সমস্যা ছিলো, সে সমস্যার কথা প্রায় সব স্যারেরাই জানতেন, সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। রসায়নের স্যারের সাহায্য নিয়ে অন্য ইংরেজী, পদার্থ, জীববিজ্ঞান স্যারের কাছে মাসিক ২০০ টাকাতে পড়তে পারলেও, আমি সে স্যারের কাছে যাওয়ার সাহসও কখনো পাইনি। কারন স্যার ৫০০ টাকা করে নিতেন, বিশেষ ক্ষেত্রে (শীট/ সাজেশান)তা বেড়ে ৭০০/৮০০ টাকাও হয়ে যেত। প্যারাময় জীবনের অপর নাম মেডিকেল।আমি যে টাকাটা অন্যান্য স্যারেদের দিতাম সেটাও আমার সস্তা টিউশানির টাকা। অতএব আমি অন্য কলেজের একজনের কাছে পড়তাম, কিন্তু স্যার সেটা জানতে পারায় শেষ পর্যন্ত সেটাও পড়তে পারিনি।
ব্যাপারটা অনেকটা এমন "হয় আমার কাছে, নয়তো কারো কাছেই নয়"। যে মেসে থাকতাম ওই মেসেরই এলাকার এক ভাইয়ের কাছে পড়তাম। এবং এর পরিনতি হচ্ছে আমার প্রাকটিক্যালে ১৭ পাওয়া।
কথায় কথায় স্যারের এক প্রিয় ছাত্রকে বলেছিলাম বুয়েটে পড়ার ইচ্ছে আমার, সেটা নিয়েও ক্লাসে কম কথা শুনতে হয়নি, এবং এমন কাজ করে দিলেন, যাতে বুয়েটে পরীক্ষায় দিতে পারলাম না।
রেজাল্টের পর সব স্যারের সাথে দেখা করলেও উনার সাথে দেখা করিনি ভয়ে, যদি আরো বড় কিছু ক্ষতি করে দেন আমার, তখন বাড়িতে কি বলবো? সেদিনের অপমানের পর আমার বন্ধুরাই বলেছিলো "দোস্ত, চল অন্য কলেজে ভর্তি হই, আমরাও তোর সাথে এই কলেজ ছেড়ে দিবো"। কিন্তু আমি পারিনি কলেজ ছাড়তে, অন্য কলেজে ভর্তি হতেও তো টাকা লাগে, তা আমি কোথায় পাবো???
উপরে যে কথাগুলো বললাম তা আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগের কথা। ঠিক ঠিক তেরোটা বছর। আজকে বলছি যে তারও একটা কারন আছে। তা পরে বলছি।
সেদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখি সিরিয়ালে অনেক রোগী, ৬১ জন। তার মধ্যে আমার সেই স্যার আছেন। স্যারের পাশে গিয়ে বসে দেখি, সেদিনের সেই উজ্জ্বল মুখে বার্ধক্যের ছাপ বেশ ভালোমতই পড়েছে। পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম "স্যার চিনতে পেরেছেন??" আমি আপনার সেই গোবরে পোকা হাসু, ওরফে হিসু।" স্যার চিনতে পেরেছেন বলেই মনে হলো যেভাবে তাকালেন আমার দিকে, সাথে পুরানো সেই কথার টান "তা হাসু কি করো??" বললাম, "স্যার এই চেম্বারে থাকি, রোগী দেখাশোনা করি।" স্যার সেই অটঠাসি দিয়ে বললেন "দেখেছিস, আমার ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয় না"। বলেই আবার সেই হাসি দিলেন। হা হা হা হা।
জিজ্ঞাসা করলাম "স্যার,আপনার সিরিয়াল কত?? দেখি যদি একটু এগিয়ে দেয়া যায়।" দেখলাম স্যারের সিরিয়াল ৫৪। ডায়বেটিস, আর্থ্রাইটিস সহ একগাদা রোগে ভুগছেন। বললাম "স্যার, আপনিই সবার আগে ঢুকবেন, আমি বলে দিয়েছি"।
আরেকজনকে দিয়ে স্যারকে চেম্বারের মধ্যে ডাকালাম। স্যার ভিতরে ঢুকে আমাকে ডাক্তারের সিটে দেখে সেই যে হা করলেন আর বন্ধ হয়েছে কিনা জানিনা। ডাক্তার আমিই। ডা. আবু হাসমত আলি, এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি। সংক্ষেপে ডা.এ এইচ আলি।
সব দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বললাম "স্যার, আপনার ভবিষ্যতবাণী সত্য হয়নি." ভিজিট দিতে গেলে নেইনি। "ওটা আপনার কাছেই রেখে দেন, স্যার।" মনে মনে বললাম, "আপনার কাছে আমি চিরঋনী, আপনার উপর জিদ করেই আজ আমি ডাক্তার, ভালো থাকবেন স্যার। আমি ভাল আছি। "
আমি কোনোদিন ফেসবুকে লিখিনি, আজ লিখলাম, না লিখতে পারলে আমার হাসিটা আমি সবার মধ্যে দিতে পারতাম না। দুঃখগুলো নিজের আর সুখগুলো ভাগ করে নিতে অনেক আগেই শিখেছি আমি। সবাইকে ধন্যবাদ 🙂
লেখাঃ ডা. আবু হাসমত আলি (হাসু)