24/02/2024
"বৃষ্টি" (ছোট গল্প)
নাজিম উদ্দিন
সবার সামনে যখন গ্লাস ভর্তি সরবত তার কোমল হাতে তুলে দিব ভাবছি, ঠিক তখনি কয়েকজন বলে উঠলো এভাবে না, আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে! আমি একটু ইতস্ততবোধ করছিলাম কিন্তু সমস্বরে সবাই বলল খাইয়ে দিন না দেরি করছেন কেন? গ্লাস হাতে নিতেই তার চোখে চোখ পড়লো, চোখ যে মনের কথা বলে! চোখ বলছে একজন অপরিচিত মানুষ তাকে নিজের হাতে সরবত পান করাবে কিন্তু না করতে পারবেনা! তার চোখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। সরবতের গ্লাস তার মুখের সামনে নিতেই আবারও দৃষ্টি তার চোখের উপর, এবার তার চোখে অন্য কিছু দেখলাম, মনে হলো এটা ভালো লাগার এক অন্য রঙ। অবশেষে নিজের হাতে পান করালাম গ্লাস ভর্তি সরবত! এই দৃশ্য দেখে সবাই খুশিতে তালি দিচ্ছে কিন্তু আমার চোখ আবারও তার চোখে। এবার চোখ বলছে যেন তুমি এটা কি করলে? আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম তার মিষ্টি দৃষ্টির দিকে।
বিয়ের আসরে এমন কিছু হবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের দেশের প্রথাগত নিয়মানুসারে বিয়েতে বরকে কনের বাড়িতে প্রবেশের আগে গেইটে ফিতা ধরা হয়, বর ফিতা কেটে কনের বাড়িতে প্রবেশ করে থাকে কিন্তু তার আগে বর ও বরযাত্রীদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করা হয় এরপর বিভিন্ন রঙের শরবত ও মিষ্টি দিয়ে প্রাথমিক আপ্যায়ন করা হয় বরকে। এসব কিছুর বিনিময়ে কনে পক্ষের লোকদের আর্থিক সম্মান করতে হয়। অনেক সময় টাকা নিয়ে অনেক দর কষাকষি হয়। কম-বেশি, খুশি-অখুশি, কথা কাটাকাটি ও বনিবনা অনেক কিছু হয়ে থাকে। অনেক সময় মরুব্বিরা এসে এসব সমস্যার সমাধান করে দেন। মজার বিষয় হলো অনেক সময় দু'পক্ষের লোকদের মধ্যে শ্লোক বা ধাঁধা বলা হয় যেখানে অনেক রসের কথা ও মজার উত্তর থাকে, উত্তর না দিতে পারলে বিভিন্ন রঙে বিভিন্ন কথার ঢঙে পক্ষ বিপক্ষকে পচানো হয়। সময়টা তখন একটা আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে।
বাঁশ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রঙের কাপড়ে মোড়ানো গেইট। গেইটের নিচে মধ্যখানে একটি টেবিল, সামনে দুটি চেয়ার আছে। সাধারণত একটিতে বর বসে আর অন্যটিতে প্রথাগত নিয়মে বরের বোনের জামাই সম্পর্কিত কেউ বসে। কিন্তু বরের সাথে কে বসবে এটা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়ে গেল বোনের জামাই সম্পর্কিত কেউ বসবে না। এক পর্যায়ে রব উঠে গেল আপনি বসেন আপনি বসেন, আমাকে বসতে হবে! ভাবতে পারছিনা। অবশেষে বরের অনুরোধে বসে পড়লাম তার পাশে। আর তখনি ঘটনার সূত্রপাত। কনের পক্ষের মেয়েরা বর বরণ করে নিতে গেইটের সামনে আসলো। হাতে ফুলের পাপড়ি, মালা, ডালা আর ট্রে ভর্তি সরবত মিষ্টি সহ অনেক কিছু। বরের সাথে আমাকেও ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হলো যা ছিল আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা! বরের সাথে আমাকেও সরবত খাওয়ানো হলো। এবার সবাই বলতে লাগলো আপনিও কিছু একটা খাওয়াতে হবে তাকে। মেয়েটির মধ্যে তখন লাজুক ভাব ফুটে উঠে। কিন্তু যা ঘটলো আমি নিজেই ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে!
বরকে সাথে নিয়ে কনের বাড়িতে প্রবেশ করলাম। প্যান্ডেলের ভিতর বরের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বসলাম আমরা। কিন্তু আমার হৃদয়ে মেয়েটির ছবি বার বার ভেসে উঠতেছে, কেন জানি তার কথা বার বার মনে হচ্ছে। এমন সময় আমার এক বন্ধু এসে বলল তোকে ঐ মেয়েটি কিন্তু ফলো করছে। আমি বললাম কোথায় কখন কিভাবে? বন্ধু বলল ঐ ঘটনার পর থেকে আমি বিষয়টা লক্ষ করছি। তার সাথে গেলাম বিষয়টা নিশ্চিত হতে, দেখলাম এবং বুঝলাম ঘটনা সত্য। এরপর আমি যখন যেদিকে যাই বাড়ি ভর্তি মেহমানদের মধ্যেও সে আমাকে নজরে রাখছে। আমি না দেখার ভান করে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম নাা, চিন্তা করে দেখলাম বিষয়টা দেখি কোথায় গিয়ে ঠেকে।
খাওয়ার পর্ব শেষ, এখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। বউকে সাজানো হয়ে গেছে। আমার বন্ধু বলল চল বউ দেখে আসি। আমিও বললাম চল। ঘরে প্রবেশ করার আগে দেখলাম সেই মেয়েটি ছাদের উপর বসে আছে। আমি তাকাতেই মিষ্টি একটা হাসি দিল আমিও মুসকি হাসতে হাসতে ঘরে ডুকলাম। বউ দেখে বের হতেই সিঁড়ির সামনে দেখলাম মেয়েটি দাড়িয়ে। চোখে চোখ রাখতেই টের পেলাম সে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারেনা। মেয়েটি আবার ছাদে চলে গেল আর আমি তার চলে যাওয়াটা দেখছিলাম।
চেনা নেই জানা নেই তবু কেন জানি মেয়েটির প্রতি একটা অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি হলো মন মন্দিরে। লক্ষ করলাম আমি যেদিকে যাই মেয়েটি সেই দিকে আমার আশেপাশে ঘুরাফিরা করে। আমি যতবারই তাকাই ততবারই দেখি কিছু একটা বলতে চায় মেয়েটি কিন্তু বিষয়টা বুঝাতে গিয়েও যেন সে বুঝতে দেয় না। সময়ের সাথে সাথে মেয়েটির প্রতি ভালোলাগা আরো গভীর হতে লাগলো।
বিয়ে শেষ, এখন বরের হাতে কনেকে তুলে দেওয়া হবে। হঠাৎ কেন জানি মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী'র কথা যেখানে বিয়েতে বর অপুর হাতে যখন হৈমন্তীকে তুলে দেওয়া হয়েছিল তখন অপু বলেছিল "আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম, এই যে মানবী তার রহস্যের কি অন্ত আছে?" অবশেষে হৈমন্তী'র মত বরের হাতে কন্যা সম্প্রদান করা হলো। আর আমার মনে হলো এই যে মানবী তার রহস্যের কি অন্ত আছে? ঐ মেয়েটির মত যার রহস্য আমি বুঝতে পারছিনা। সুখ-দুঃখ আর কষ্টের অশ্রুসিক্ত বিদায় দেয়া হল কনেকে। আমরা চলে যাচ্ছি, আমি ঐ মেয়েটিকে মনে মনে খুঁজতেছিলাম, দেখলাম দুরে একা দাড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকাতেই দেখি হাত নেড়ে বিদায় বলছে তার মুখে তখন অন্যরকম হাসি যে হাসির ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
ঘুম-নির্ঘুম একটি রাত কাটলো। মেয়েটিকে ভুলতে পারছিনা, হৃদয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি হয় তাকে ভেবে। বউ-ভাতের অনুষ্ঠান চলছে বরের বাড়িতে। দুপুরে কনে পক্ষ আসবে, মেয়েটি আসবে তো? ভাবিতেছিলাম। চিন্তা করলাম যদি আসে কথা বলবো, কারণ মনে কোন সংশয় রাখা ঠিক হবে না।
অবশেষে কনে পক্ষের মেহমানরা আসলো, মেহমানদের মাঝে আমি মেয়েটিকে খুঁজছি। শেষের দিকে মেয়েটি বাড়িতে ডুকলো। খয়েরী রঙের সালোয়ার কামিজ পড়া দেখতে দারুন লাগছে। আমি দুরে দাড়িয়ে আছি। আমাকে দেখে মেয়েটি আমার দিকে আসতেছিল, এসে আমার সামনে দাড়িয়ে রইলো। আমি চুপ থাকলাম ও নিরব কিন্তু চোখাচোখি হচ্ছে। নিরবতা ভেঙে বললাম, কেমন আছেন? মেয়েটি বলল ভালো।
- নাম কি?
- বৃষ্টি।
বৃষ্টি নাম শুনে কেন জানি ভালো লেগে গেল।
কথা বলে নিশ্চিত হলাম মেয়ের গ্রামের বাড়ি কিন্তু কনের গ্রামে নয়, মেয়ের বাড়ি এই বরের গ্রামে! আমি শুনে আশ্চর্য হলাম।
আর কি জিজ্ঞেস করবো বুঝতেছিনা। বৃষ্টিও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছেনা। শুধু দু'হাতের আঙ্গুল কচলাচ্ছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে মুসকি হাসছে। আমি আমার অজান্তে তুমি বলে ফেললাম, বললাম আমি শুধুই জিজ্ঞেস করবো তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে না? সে একটা হাসি দিয়ে সামনে থেকে চলে গেল। আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম!
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পালা। দেখলাম বৃষ্টি চলে যাচ্ছে, দুরত্ব বজায় রেখে আমি তাকে ফলো করছি। সে সোজা পথে গিয়ে বামের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি আর দেখছি তার পথচলা। হঠাৎ ফিরে তাকালো সে, আমাকে দেখে দাড়িয়ে গেল, আমিও দাড়িয়ে গেলাম। হাতের ইশারায় আমাকে কি যেন বলতে চাচ্ছে, আমি ঠিক বুঝলাম না! কয়েকবার বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর পর বুঝলাম বৃষ্টি বলতে চাচ্ছে আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি কি আমায় ভালোবাসবে?
বৃষ্টির কথা বুঝে মনে এক সুখানুভূতি হল। বৃষ্টির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি হাসতেছি আমার হাসি দেখে বৃষ্টিও হাসতেছে আর চলতে লাগলো তার গন্তব্যে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম দেখলাম মেঘের ঘনঘটা এই বুঝি বৃষ্টি নেমে আমাকে সিক্ত করবে। বৃষ্টির পথে তাকালাম, দেখলাম বৃষ্টি আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। তাকে আর দেখা যায় না।