06/11/2025
বাংলাদেশের মিডফিল্ডের সোনালি অধ্যায়ের স্থপতি আশিষ ভদ্র
ঢাকার ফুটবলের সোনালি যুগ,যে সময়টিকে এখনো স্মরণ করেন প্রবীণ সমর্থকরা, সেই সময়ের মাঠে এক নীরব কিন্তু দৃঢ় উপস্থিতি ছিল এক ফুটবল শিল্পীর।
তিনি ছিলেন দলের ছন্দ নির্মাতা, বলের জাদুকর, আর বাংলাদেশের ফুটবলের মাঝমাঠের স্থপতি।
নাম - আশিষ ভদ্র।
আশিষ কুমার ভদ্র জন্মগ্রহণ করেন ১৪ মার্চ ১৯৬০ সালে, চট্টগ্রামে। শৈশব থেকেই পায়ের কাছে বল এলেই যেন সময় থমকে যেত। ফুটবলের প্রতি সেই টান তাঁকে নিয়ে যায় খাজা রিক্রিয়েশন ক্লাব - এর হয়ে খেলার মধ্য দিয়ে পেশাদার যাত্রার পথে।
৭০-এর দশকের শেষ দিকে স্থানীয় টুর্নামেন্টে দারুণ পারফরম্যান্সে তাঁর নাম পৌঁছে যায় ঢাকার বড় ক্লাবগুলোর কানে।
১৯৭৮ সালে তিনি যোগ দেন রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে। মাঠে তাঁর ঠাণ্ডা মাথা, মাপা পাস ও খেলার ছন্দ নিয়ন্ত্রণ দ্রুতই তাঁকে আলাদা করে তোলে।
১৯৮১ সালে আশিষ ভদ্র পাড়ি জমান দেশের জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। সেখানেই জন্ম নেয় বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত মিডফিল্ড জুটি - খুরশিদ আলম বাবুল ও আশিষ ভদ্র।
ঢাকার মাঠে এই জুটি ছিল যেন সুর ও তালের মেলবন্ধন। একজনের পাসে অন্যজনের ছোঁয়া, আর দল এগিয়ে যেত আক্রমণের ঢেউয়ে। আবাহনীর হয়ে আশিষের সময়টিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়।
১৯৮০ এর দশকে আবাহনীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জয়ে ছিল তাঁর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও কৌশল।
তাঁর নিখুঁত থ্রু পাস, দূরপাল্লার শট, এবং মাঝমাঠে স্থির নিয়ন্ত্রণ, দর্শকদের চোখে ছিল এক আলাদা আনন্দের উৎস।
১৯৮৪ সালে আশিষ খেলেছিলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব-এর হয়ে। তবে বছর না ঘুরতেই তিনি ফিরে যান নিজের প্রিয় নীল জার্সিতে, আবাহনীতে। সেখানেই ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে ছিলেন তিনি।
১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের ডাক পান আশিষ ভদ্র। বাংলাদেশ তখন আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেদের অবস্থান খুঁজে পাচ্ছিল, আর আশিষ ছিলেন সেই প্রজন্মের অন্যতম ভরসা।
১৯৮৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে তিনি নেতৃত্ব দেন জাতীয় দলকে। ইরান, ইরাক, কাতার, ভারত, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়, পরিপূর্ণ দায়িত্ববোধে। তাঁর সংগঠক মানসিকতা ও নেতৃত্ব তখনকার কোচদের মুগ্ধ করেছিল।
জাতীয় দলের হয়ে আশিষ খেলেছেন ৩২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, গোল করেছেন ৫টি, যা সে সময়ের একজন মিডফিল্ডারের জন্য ছিল প্রশংসনীয় সাফল্য।
বাংলাদেশের ফুটবলে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আশিষ ভদ্র পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।
তাঁর এই অর্জন শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি ৮০-র দশকের সেই স্বপ্নবাজ প্রজন্মের প্রতীক, যারা নিজেদের আবেগ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন দেশের ফুটবল সংস্কৃতি।
আশিষ ভদ্র ছিলেন খেলোয়াড়ের চেয়েও বেশি কিছু-
তিনি ছিলেন এক স্থপতি, যিনি মাঝমাঠ থেকে সাজাতেন খেলার গতি ও রিদম। তাঁর খেলায় ছিল ঠাণ্ডা মাথার সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পাস, ও বলের নিয়ন্ত্রণে অতুলনীয় দক্ষতা।
খেলার জীবন শেষে তিনি আলোচনার বাইরে চলে গেলেও, তাঁর নাম রয়ে গেছে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক অমর অধ্যায় হিসেবে।
বিশ্লেষকদের চোখে এখনো তিনি বাংলাদেশি মিডফিল্ড স্কুল -এর এক প্রতীকী নাম।
আজকের তরুণ ফুটবলারদের জন্য আশিষ ভদ্রের গল্প এক অনুপ্রেরণা। তিনি শেখান- “নাম নয়, খেলাই কথা বলে।” বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে তাই আশিষ ভদ্র থাকবেন, একজন শিল্পী, নেতা, আর সেই সোনালি যুগের মিডফিল্ডের সোনালি স্থপতি হিসেবে।
#সংগৃহীত