26/02/2024
আমার বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে আসার ঠিক এক মাসের মাথায় আমার শাশুড়ি মারা যান! মরণ ব্যাধি ক্যান্সার তাঁকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছিল। তিনি মারা যাওয়ার সময় আমরা সবাই তাঁর পাশেই ছিলাম। ছিলো না কেবল আমার নতুন বাবা। ভালোবাসা মানুষটাকে চোখের সামনে হারাতে দেখতে পারছিলেন না হয়তো।
শাশুড়ি মা আমার হাত ধরে বলেছিল,
- 'মানুষ টা একা হয়ে গেলো রে মা। একটু দেখে রাখিস। নতুন একটা বাপের মতো আগলে রাখিস। পারবি না?'
সেই মুহূর্তে কি বলা উচিত ছিলো, আমার জানা নেই। আমি কেবল অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা নাড়িয়ে ছিলাম। আমি কখনও কোনো ছেলে মানুষকে কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু সেদিন আমার নতুন বাবাটাকে দেখেছিলাম। উঁহু সবার সামনে না। কিংবা হাউমাউ করেও না। কেবল গোপনে অশ্রু ফেলেছিলো।
আমার বর সোহান তাঁদের একমাত্র ছেলে হওয়ার সুবাদে শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর পুরো বাড়িটাই প্রায় ফাঁকা হয়ে গেলো। আমাদের বাসাটার সামনে যেই পুকুরটা আছে রোজ বিকেলে সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকতো। যেই বয়সটায় উনার একজন সঙ্গী বেশি দরকার ছিলো সেই সময়টায় লোকটা একদম একা হয়ে গেলো।
জড়তা ভেঙে আমি একদিন তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। আমার আলাপ পেয়ে উনি আমার দিকে তাকিয়ে চমৎকার করে হাসলেন। উনার পাশে থাকা গাছ পাকা আম টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
- 'আমাদের এই গাছের আমগুলো খুবই মজার। তোমার শাশুড়ি মা অনেক পছন্দ করতো। খেয়ে দেখো।'
আমার অসম্ভব ভালো লাগলো। আমার আব্বুর প্রতি যেই ভালোবাসাটা অনুভব করতাম উনার প্রতিও ঠিক সেই ভালোবাসাটা অনুভব করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এই মানুষটার একাকিত্ব যতটুকু পারি দূর করবো। আমার নিজের বাবা করবো, করবো। শাশুড়ির বলা, 'নতুন বাবা' বানাবো। আম টা নিতে নিতে বললাম,
- 'বাবা? আমি তো এই বাড়িটা ঘুরে দেখিনি এখনও। মা থাকলে হয়তো উনিই দেখাতেন। আপনি দেখাবেন ঘুরিয়ে?'
মানুষটার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। উচ্ছাস নিয়ে বললো,
- 'অবশ্যই দেখাবো মা। এখন দেখবা? অনেক বড় আমাদের বাড়িটা। তোমার ভিষণ ভালো লাগবে।'
ছোট একটা বাচ্চাকে তার পছন্দের কাজ করতে বললে যেমন খুশি হয়, আগ্রহ নিয়ে করতে চায় উনিও ঠিক তেমনটাই খুশি হয়েছিল, আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এতদিন চুপ হয়ে থাকা মানুষটা হঠাৎ-ই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। নিশ্চুপ বাড়িটা যেনো প্রাণ ফিরে পেয়েছিল।
মাঝে মাঝে আমাকে তিনি উনার আর শাশুড়ির গল্প শুনাতেন। মজার জায়গা গুলোতে হেসে লুটিয়ে পড়তেন। মধুর জায়গায় গুলোতে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ অব্দি নানান কর্মকাণ্ডে মেতে থাকতাম। কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের সম্পর্কটা হয়ে উঠলো বাপ-মেয়ের সম্পর্ক।
সময় কাটানোর জন্য আমাদের বাসার সামনে একটা বাগান বানালাম। নানান ধরনের শাক-সবজিতে ভরে উঠলো বাগানটা। কোনো গাছে নতুন কোনো সবজি হলে বাবার সেকি উল্লাস। রান্না করার পর যখন খেতে বসতো তখন সোহানকে গর্ব করে বলতো,
- 'খেয়ে দেখ কতো মজা হয়েছে। আমার আর আমার মেয়ের পরিচর্যার ফল এগুলা। তৃপ্তি করে খা। তাজা জিনিস। একদম নির্ভেজাল।'
সোহান মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলতো,
- 'হুম, বাপ-বেটি মিলে একটা বিজনেস দাঁড় করিয়ে ফেলো। ভালোই চলবে মনে হচ্ছে।'
বাবা কপট রাগ দেখিয়ে বলতো,
- 'আমার আর আমার মেয়ের কষ্ট টা তোর চোখে লাগলো না, না? টিটকারি মারলি? আমাদের বাগানের শাক-সবজি তোর জন্য নিষিদ্ধ যাহ।'
আমার দিকে তাকিয়ে বলতো,
- 'মা? ওর জন্য আমাদের বাগানে নির্ভেজাল সবজি গুলো নিষিদ্ধ করে দিয়েছি। ভালো করেছি না?'
আমি হেসে দিয়ে বলতাম,
- 'একদম ঠিক করেছেন। ওর জন্য বাজারের দুই নাম্বার খাবারই পারফেক্ট।'
সোহান অসহায় মুখ করে বলতো,
- 'লে! আমি এখন ‘থার্ড পারসোন সিঙ্গুলার নাম্বার’ হয়ে গেলাম?'
ঠিক তখন ছোট্ট সংসারটা খিলখিল হাসির ধ্বনিতে মেতে উঠতো।
বিয়ের আগে আব্বু বাজার থেকে আসার সময় আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। বিয়ের পর আমার নতুন বাবাটা আব্বুর জায়গায়টা নিয়ে নিলো। রোজ কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। বাজার থেকে এসেই 'মা' বলে একটা ডাক দিতো। ভালোবাসা মেশানো ডাকটা শুনলেই আমি সব কাজ ফেলে ছুটে চলে আসতাম।
সোহান মুখ বাঁকিয়ে বলতো,
- 'ইশশশ! বুড়ি একটা মহিলার জন্য দরদ দেখলে আর বাঁচি না। আর কয়েকদিন পর চুল পেকে যাবে তার জন্য আবার হাবিজাবি নিয়ে আসা হচ্ছে।'
বাবা বিরক্তি নিয়ে বলতেন,
- 'তুই তো খুব হিংসুক রে! শোন? আমার মেয়েকে আমি যা ইচ্ছে খাওয়াবো। দরকার পড়লে পুরো বাজার সুদ্ধ উঠিয়ে নিয়ে আসবো। তোর কি রে? এমন লক্ষিমন্তর একটা মেয়েকে যে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিস সেটা তোর বাপের ভাগ্য বুঝছিস?'
সোহান হেসে দিয়ে বলতো,
- 'হ্যাঁ। বাপের-ই ভাগ্য। আমার আর কি? থাকো তোমরা বাপ-মেয়ে।'
ইউটিউব দেখে দেখে নতুন কোনো রেসিপি করে দিলে সেটা খেতে যতই বিদঘুটে হোক না কেন, তৃপ্তি নিয়ে খেত আর বলতো,
- 'আহ! আহ! কি যে সুস্বাদু হয়েছে! পৃথিবীর সেরা খাবার! সোহান ঠিকই বলছে রে মা, তোরে নিয়ে একটা বিজনেস দাঁড় করানো লাগবে। উরাধুরা চলবে। হা হা হা।'
সেবার সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পরে হাত পা ভেঙে টানা দুই মাস হসপিটালে ছিলাম। তখন বাবার সেই পাগলের মতো আহাজারি আর বাচ্চামি গুলো মনে পড়লে আজও অবাক হই ভিষণ। আমার শাশুড়ির মৃত্যুর সময়টাতেও যেই মানুষটা আড়ালে কেঁদেছিলো সেই মানুষটা সেদিন হাউমাউ করে হসপিটাল ভর্তি মানুষের সামনে কেঁদেছিলো।
হয়তোবা দ্বিতীয়বার কাউকে হারানো ভয়ে গ্রাস হয়ে গিয়েছিলো। কতটা আপন হলে মানুষ এতটা ভয় পেতে পারে আমার জানা নেই। আমার হাত ধরে বলেছিলো, ‘তোর নিষ্ঠুর মা-টা তো সেই কবেই তোর এই বাপটারে একা করে দিয়ে চলে গিয়েছে। এখন তুইও চলে যেতে চেয়েছিলি মা? এই বাপটা যে তোরে অনেক ভালোবাসে। আমার মেয়ে তুই, আমার মা তুই! আর সেই সাথে আমার একাকিত্বের সঙ্গিটাও যে তুই রে মা!’
মা-বাবাদেরকে আপন করে নেওয়া খুবই সহজ আসলে। অবশ্য মা-বাবারা কখনও আপন-পর হয় না। তাঁরা সবাই এক। সবাই আপন। পৃথিবীর সব মা-বাবা গুলোই তার সবটা দিয়ে সন্তানদের ভালোবাসে। তাঁদেরে একটু ভালোবাসা দিলে বিনিময়ে তাঁরা এক পৃথিবী ভালোবাসা বিলিয়ে দেয়। শুধু একটু আপন করে নিতে হবে। তাঁদের সুখের-দুঃখের সঙ্গী হয়ে উঠতে হবে।
অণুুগল্প
নতুন_বাবা
কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া