24/03/2020
আমাদের রাজপুত্রের গল্প
-শেখ রিদওয়ান হোসাইন
মুশফিকের ময়না,ফ্যানদের নবাব,দেশের মানুষদের রাজা,মিডিয়ার পোস্টার বয়,ক্রিকেট বিশ্বে জীবন্ত কিংবদন্তি-এমন নানা নামেই ডাকা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের রাজপুত্রকে। যাকে নিয়ে আলোচনার সাথে পাল্লা দিয়ে সমালোচনার তীক্ষ্ণ তীরও ছুটে চলে প্রতিটি ক্ষণে। তিন ফরম্যাটেই ব্যাট বল হাতে এই রাজার রাজত্ব অতুলনীয়। দেশে রেকর্ডের পরিসংখ্যান যদি কোনো বোর্ডে টাঙিয়ে দেওয়া হয়,সেখানে একটি নামই বার বার ফিরে আসবে - 'সাকিব আল হাসান'।
মাগুরায় জন্ম নেওয়া ক্রিকেটের এই বরপুত্র উজ্জ্বল স্বমহিমায়। ২২ গজের একপ্রান্তে কখনো ছুটিয়েছেন রানের ফোয়ারা অথবা ভেঙে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের স্টাম্প। খেলেছেন অসংখ্য ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে। তবে দেশের জার্সি গায়ে সাকিবের চেহার অবয়ব সদা ভিন্নই! আমিরের বলে স্কুপ করতে বোল্ড হওয়া সাকিব সেকেন্ডেই স্টাম্পে ব্যাট দিয়ে আঘাত করে দেন। কারণ,বুঝে গিয়েছিলেন, ম্যাচটা ফিনিশ করতে তার মাঠে থাকা ছিলো অত্যাবশকীয়!
একটি কথা কিন্তু বৃদ্ধরা বলতেন যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সাকিব। এতো পরিশ্রম করো যে তুমি রেকর্ডের পিছনে নয়,রেকর্ড তোমার পিছনে দৌড়াবে! সত্যিই তাই-এই সাকিবের রেকর্ডনামা লিখে শেষ করার সাধ্য আছে কোন লেখকের? মাঠে নামলেই যিনি রেকর্ড গড়েছেন,সেই সাকিবই আজ সবার অগোচরে।
ক্রিকেটে সাকিবের হাতেখড়ি সেই ছোট্টবেল থেকেই। প্রথম আলোতে লিখা উৎপল শুভ্র একটি আর্টিকেলে বলেন,' সাকিব ছিলেন দক্ষ একজন ক্রিকেটার সেই ছোটবেলা থেকেই। সাকিবকে হায়ার করতো বিভিন্ন গ্রাম, বিভিন্ন দল তাদের হয়ে খেলার জন্য। এরকমই একটি ম্যাচে সাকিবকে দেখে কোনো এক আম্পায়ার সাকিবের মধ্যে দারুণ কিছু খুঁজে পান তাই মাগুরার ইসলামপুর পারা ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দেন।
জেনে অবাক হবেন যে ইসলামপুর পারা ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট বলে বোলিং করে নিজের প্রথম বলেই উইকেট পান। এর আগে সাকিব টেপ-টেনিসেই অভ্যস্ত ছিলেন। তখন সাকিবের স্পিন বোলিং তেমন এফেক্টিভ ছিলো না তাই ফাস্ট বোলার হিসেবেই দলে খেলতেন। তার ব্যাটিং স্টাইল ছিলো শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক। তাই তো এখনও তিনি মনে করেন,এ্যাটাক ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স।
তারপর সাকিব ৬ মাস বাংলাদেশ সরকারি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে তার বয়স যখন ১৭,খুলনা তাকে কিনে বিসিএল এর জন্য। সাকিব আন্ডার ১৯ ক্রিকেটে পা রাখেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে ২০০৬ সালে। সেই ম্যাচটি বাংলাদেশ জিতে এবং সেখানে সাকিব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ব্যাট হাতে ৩০ টি রান করেন এবং চিগুম্বুরার উইকেট নিয়ে তার বোলিং যাত্রা শুরু করেন।
সেই টিনেজার সাকিব ২০০৫-২০০৬ সালের মধ্যে খেলেন ১৮ ইয়ুথ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেখানে তার ছিলো ৫৬৩ আর গড় ৩৫.১৮। সেই সাথে বল হাতে তুলেছিলেন ২২ উইকেট মাত্র ২০.১৮ গড়ে। শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ডকে নিয়ে একটি ট্রি-নেশনস সিরিজের ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিলো শ্রীলঙ্কা। সেই ফাইনালে ৮৬ বলের দূর্দান্ত শতকের পাশাপাশি বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে একহাতেই হারিয়ে দেন শ্রীলঙ্কাকে।
ওয়ানডে ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তার ওডিআই যাত্রাপথে পারফরম্যান্সের জন্য কোনদিন আওয়াজ উঠে নি দল থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। সাকিব মাঠে থাকা মানে দলে ১২ জন ক্রিকেটার থাকা, এ কথাটি ধ্রুব সত্য। দলের প্রয়োজনে কখনো ব্যাট হাতে কখনো বা বল হাতে। বেশিরভাগ ম্যাচে দুটি বিভাবেই একসাথে দাপট দেখিয়ে গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড।
ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং পরিসংখ্যান দেখলে মনে করবেন এটা কোনো জেনুইন ব্যাটসম্যানের কারসাজি। আর বোলিং ফিগার দেখলে বলতে হবে দলের সেরা বোলারও তো এই মানুষটাই। হ্যাঁ,এজন্যই সাকিবকে বলা হয় এক দলে থাকা দুই প্লেয়ার। চলুন ছোটো করে দেখে নেওয়া যাক তার ওডিআই ব্যাটিং নামা-
ইনিংস- ১৯৪
রান- ৬৩২৩
সর্বোচ্চ - ১৩৪*
অপরাজিত - ২৭ বার
গড়- ৩৭.৮৬
অর্ধ-শতক - ৪৭
শতক- ৯
ডাক- ১০
চার- ৫৭৪
ছয়- ৪২
বল ফেসড- ৭৬৪২
স্ট্রাইক রেট- ৮২.৭৪
ওডিআই বোলিং নামা-
ওভার- ১৭৫২.৫
বল- ১০৫১৭
মেডেন- ৮৩
রান কনসিড- ৭৮৫৭
উইকেট- ২৬০
গড়- ৩০.২২
এক ইনিংসে ৪ উইকেট-- ১০ বার
এক ইনিংসে ৫ উইকেট- ২ বার
সেরা ফিগার- ৫/২৯
ইকোনমি রেট- ৪.৪৮
এটা শুধুমাত্রই একটি পরিসংখ্যান। এর কার্যকরিতা অভূতপূর্ব। বড় দল অথবা ছোটো দল, সাকিব খেলতেন সাকিবের মতো। তার দুর্দান্ত ফিল্ডিংও প্রতিপক্ষ বিপাকে ফেলে দিতো।এশিয়া কাপ,চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, বিশ্বকাপসহ সমস্ত আইসিসি ইভেন্টে সাকিব দুর্দান্ত। শেষ ওডিআই বিশ্বকাপে তো সাকিব একাই টেনেছেন পুরো বাংলাদেশ দলকে। ২০১৯ বিশ্বকাপে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান ও সর্বোচ্চ উইকেট দুটিই তার দখলে। এমনকি,বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র ক্রিকেটার যার বিশ্বকাপে ১০০০ রানের পাশাপাশি ৩০ টি উইকেটও রয়েছে!বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা প্লেয়ার হিসেবে হয়তো এটাই যথেষ্ট!
ওডিআইতে প্রতিটি বিভাগেই সাফল্যের জন্য ২০০৯ সালে নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডার হিসেবে আবির্ভূত হোন সাকিব আল হাসান। তারই সাথে সাথে টেস্টে মোহাম্মদ আশরাফুলকে টপকিয়ে ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্বও পড়ে সাকিবের কাঁধে। তরুণ সাকিবের হাত ধরেই দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ড বধের ইতিহাস রচনা হয়।
২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে জয় ছাড়া কিছুই ছিলো বলার মতো বাংলাদেশের। এই ব্যর্থতার জন্য সাকিবকে দায়ী করা হলেও এই বছরই আইপিএলে কলকাতার হয়ে আগুন ঝরা পারফরম্যান্স দেখান সাকিব আল হাসান। তবুও সেই সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে ক্যাপ্টেন্সি থেকে বাদ দিয়ে দেয় বিসিবি।
ক্যাপ্টেন্সি থেকে বাদ পড়ে গেলেও সাকিব কি থামবার পাত্র? মোটেও না। সেই সফরেই তিনি নিজেকেও ছাড়িয়ে যান আর প্রমাণ করে দেন দলে তার প্রয়োজনীয় কতটুকু। তাই তো ওডিআই এবং টেস্ট উভয় ফরম্যাটেই দলের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট ছিলো তার দখলেই উক্ত সিরিজে। ব্যাট হাতে দুই ওডিআইতে মোট ৭৯ রানও করেছিলেন।
২০১১ সালেই ঘরের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হয় ডিসেম্বর নাগাদ। সেই সিরিজের দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ও উইকেট এবারও তার দখলেই থেকে যায়। এই সিরিজেরই দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে একই ইনিংসে শতক ও ৫ উইকেটের দেখা এই নবাব। ফলপ্রসুতে, এই সিরিজের পরে সাকিব প্রথমবারের মতো টেস্টে আইসিসির 'নাম্বার ওয়ান টেস্ট অলরাউন্ডারের' তকমাও লাগান।
২০১২ সালের এশিয়া কাপের কথা তো না বললেই নয়। সেই টুর্নামেন্টে রেকর্ড ২৩৭ রান করেন যার মধ্যে ৩ টি অর্ধশতকের দেখাও ছিলো। বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। এই টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো ফাইনালে যায় বাংলাদেশ যেখানে সাকিবের অবদান ছিলো মূখ্য। কিন্তু ভাগ্যে লিখা ছিলো না এশিয়ার সেরা দল হওয়ার,ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র দুই রানের তিক্ত হারের স্বাদ পেয়েছিলো টাইগার বাহিনী। সেই টুর্নামেন্টে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দাপুটে খেলার জন্য টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় আর কেউ নয়,বরং সাকিবই নির্বাচিত হোন। সেই টুর্নামেন্ট পরেই সাকিব পুনরায় তার হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেন। তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার সেরা অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনকে হটিয়ে আবারও বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার ঘোষিত হোন ময়না।
টেস্টে ১০০ উইকেট পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় নি সাকিব আল হাসানের। ২০১২ সালেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চলমান সিরিজে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এই মাইলফলকে পৌঁছান সাকিব। শুধু কি দেশের হয়েই সাকিবের নবাবী? সাকিব বিশ্বে দ্রুততম ক্রিকেটার যিনি টেস্টে ১০০ উইকেট ও ১০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। তার এই অর্জনে পৌছাতে লেগেছে মাত্র ২৮ টি টেস্ট!
এগুলো তো তার এখনকার পরিসংখ্যানে তুচ্ছ! বর্তমান সাকিব ওয়ানডেতে বিশ্বের দ্রুততম ৫০০০ রান ও ২০০ উইকেটের একক মালিক।ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় প্লেয়ার যার ওয়ার্ল্ড কাপের একটি ম্যাচে অর্ধ-শতকের পাশাপাশি পাচঁ উইকেটের রেকর্ডও রয়েছে।
২০১৯ এর জুনে,সাকিব দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে ৬০০০ রানের পাশাপাশি ২৫০ উইকেটর মাইলস্টোনের দেখা পান। যেটি ছুঁতে সাকিবের দরকার হয়েছিলো মাত্র ১৯৯ টি ওডিআই ম্যাচ! এমন অসংখ্য রেকর্ডের ছড়াছড়ি সাকিবকে নিয়ে গেছে 'নাগালের' মাইল দূরে।
বিশ্বকাপের ৮ ইনিংসে সাকিবের রান ছিল যথাক্রমে ৭৫, ৬৪, ১২১, ১২৪*, ৪১, ৫১, ৬৬ ও ৬৪। শচীন টেন্ডুলকারের পরে মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ৭টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসে মালিক হন বাংলাদেশের সাকিব।বিশ্বকাপের ৮ ইনিংসে সাকিবের ব্যাট থেকে আসে মোট ৬০৬ রান। যারমধ্যে ৭টি ছিল অর্ধশতাধিক ইনিংস। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুইটি শতকও হাঁকিয়েছিলেন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার। উইকেটশিকার করেছিলেন মোট ১১টি।
ও হ্যাঁ, সাকিবের টেস্ট নামা তো এখনও দেওয়াই হলো না- একনজরে সাকিবের টেস্ট ব্যাটিং পারফর্ম্যান্স-
ইনিংস - ১০৭
রান- ৩৮৬২
সর্বোচ্চ - ২১৭
অপরাজিত - ৭
গড়- ৩৯.৪১
অর্ধশতক - ২৪
শতক- ৫
দ্বিশতক- ১
চার- ৪৭৫
ছয়- ২১
স্কোরিং রেট- ৬২.০৫
বল হাতে সাকিব-
ওভার- ২১৭০
বল- ১৩০২০
মেডেন- ৩৯২
উইকেট - ২১০
রান কনসিড- ৬৫৩৭
ইনিংসে পাঁচ উইকেট- ১৮ বার
ম্যাচে দশ উইকেট- ২ বার
বেস্ট ইনিংস ফিগার- ৭/৩৬ (যা দেশের হয়ে সেরা)
বেস্ট ম্যাচ ফিগার- ১০/১২৪
ইকোনমি রেট- ৩.০১
২০০৭ থেকে টেস্ট যাত্রায় ২০১৯ পর্যন্ত মোট ১৩টি বছর দেশের হয়ে টেস্টে সার্ভিস দিয়ে গেছেন এ ক্রিকেটার। দেশসেরা অলরাউন্ডারের তকমা ছাপিয়ে তিনি অল-টাইম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের একজন। ক্রিকেট বিশ্ব যখন মোহাম্মদ হাফিজ,জ্যাক ক্যালিস,শেন ওয়াটসন,জ্যাকব ওরাম,ফ্লিনটফদের অলরাউন্ড রাজত্ব চলছিলো,সেখানে একটা বাঙালি ছেলে গিয় রাজা হয়ে বসে থাকবে সেটা কালেভদ্রেও কি কেউ চিন্তা করেছিলো?
শুধু একটি ফরম্যাটেই যদি সাকিব বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হতেন,তাহলে সাকিবকে অতিসাধারণ তকমা দেওয়াই যেতো,তাই না? ২০১৫ সালে আইসিসির ৩ ফরম্যাটেই একই সাথে বিশ্বের অলরাউন্ডার হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে জানান দেন যে,সাকিব সাধারণ কিছু নয়! সাকিব এক বিস্ময় বালক। যার মৃদু হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকে জয়ী হওয়ার বড় অদ্ভুত ক্ষিদা।
ক্রিকেট পরিপূর্নতা পেতো না যদি না একটা নবাব এখানে তার পদধূলি দিতো। পৃথিবীতে ক্রিকেটের যাত্রার পর থেকে দেখা মিলেছে অসংখ্য ক্রিকেট কিংবদন্তির।স্যার ডন ব্রাডমান থেকে হালের কোহলি-স্মিথরা তাদের দাপট দেখিয়ে চলেছেন এই খেলার সৃষ্টিলগ্ন থেকে। শচীন-সাঙ্গার মতো নিখাঁদ ভদ্র ক্রিকেটার বলেন অথবা স্টোকসের মতো উগ্র,দিনশেষে সবাই ক্রিকেটের পাল্লায় এসে ক্রিকেটার ট্যাগে। সেই ক্রিকেটে 'বেয়াদব' উপাধি পাওয়ার লিস্টে অনেক এগিয়েই আছেন এই সাকিব। ক্রিকেটের বাইরেও জড়িয়েছেন অনেক কর্মকান্ডে যা সাকিবের সাথে কখনোই যায় না।
তবে,সাকিব যতোটা না বাজে কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে দোষী,তার চেয়েও বেশি দোষী তার বউ পর্দা করে না এমন মন্তব্যেই! কখনো তার বউ পর্দা করেনা,কখনো সে কাজের মেয়েকে খাবার দেয়া না,দেশের হয়ে ভালো করেনা,কিভাবে নাম্বার ওয়ান এমন সব অদ্ভুত মন্তব্য করে অনেক বাঙালিই তাকে ছোটো করেছে এবং এখনোও করছে। কথায় আছ,বাঙালিরা নাকি সত্যিকারের সোনাকে মূল্য দিতে জানেনা। সেটা হয়তো প্রমানিত হতো না যদি না সাকিব এ দেশে জন্ম নিতো!
সাকিব যে শুধু দেশের জার্সি গায়ে লড়েছেন,তা নয়।বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার যিনি ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে খেলে দেশের নাম রাঙিয়েছেন। সবখানেই পেয়েছেন অভাবনীয় সাফল্য। তিনি যে দলগুলোর হয়ে ডোমেস্টিক ক্রিকেট খেলেছেন তার একটি লিস্ট--
খুলনা ডিভিশন,উরকাস্টারশায়ার,কলকাতা নাইট রাইডার্স,খুলনা রয়েল বেঙ্গলস,উথুরা রাইডার্স,ঢাকা গ্লাডিয়েটর্স,লেস্টারশায়ার,বার্বাডোস ট্রাইডেন্স,এ্যাডিলেট স্ট্রাইকারস, মেলবোর্ন রেঞ্জারস,রংপুর রাইডার্স,করাচি কিংস,জ্যামাইকা তালাওয়াস,ঢাকা ডায়নামাইট, পেশওয়ার জালমি ও সান রাইজার্স হায়দ্রাবাদ।
এখানে কাউন্টি ক্রিকেট,বিপিএল,পিএসএল,আইপিএল,এসপিএল,সিপিএল সবকিছুই রয়েছে। বেশিরভাগ দলগুলোর হয়ে ট্রফিও জিতেছেন তিনি। বিশেষ করে বিপিএলে ক্যাপ্টেন্সি করেও দলকে জিতিয়েছেন ২ বার। তাছাড়া ক্রিকেটের টি-২০ ধামাকা আইপিএলে তার রেকর্ড ঈর্ষণীয়।২০১২ ও ২০১৪ সিজনে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল শিরোপা জিতেন এ কিংবদন্তি। যেখানে দলের হয়ে মূল কারিগরের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এগুলো সব লিখে-বলে শেষ করা যাবে না।
নিদহাস ট্রফিতে সাকিবের 'এই তোরা উঠে আয়' কাহিনি মনে আছে?টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের কন্ডিশনে দ্বিশতক হাঁকানোর পরেও যে সাকিব একটা ছোটো হাসি দিয়েই সেলিব্রেশন সেরে ফেলেছিলো, সেই সাকিবের ভিন্ন রুপ দলের বিপক্ষে আম্পায়রদের ডিশিসন যাওয়ায়। সেই ঘটনায় সমালোচিত হলেও অনেক ক্রিকেট বোদ্ধার কাছে এটি সাকিবের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটি মোমেন্ট। ম্যাচের মোমেন্টাম ঘুরিয়ে দেওয়া তার এই সাহসী প্রতিবাদের পরক্ষণেই মাহমুদউল্লাহ ছক্কায় ম্যাচ জয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশ ক্রিকেটে অন্তত আমি এতোটা প্যাশনেট দ্বিতীয় কাউকে দেখি নি!
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডকে বিদায় দেওয়া কাব্যের কথা তো মনেই আছে? সেই সুখস্মৃতি খুব দূরের তো নয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বাংলাদেশের। টূর্নামেন্টে জিততে হলে জিততেই হবে বাংলাদেশকে। সেই ম্যাচে সাকিব মাঠে নামেন যখন দেশের ব্যাটিং অবস্থা নাজুক, ১২ রানে ৩ উইকেট। পরক্ষনেই সেটি হয়ে দাড়ায় ৩৩/৪। জয়তো তখন দূরের কাব্য, অল-আউট এড়াতে পারলেই জান বাঁচে এমন একটি অবস্থা বাংলাদেশের। সেখান থেকে ১১৪ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস খেলেন সাকিব! মাহমুদউল্লাহকে সাথে নিয়ে সেদিন দেশের হয়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পার্টিনারশিপটি গড়ে দেন তিনি। দল জিতে অবিশ্বাস্য এক জয়,নিজে জিতেন ম্যাচজয়ী পুরুষ্কার আর নিউজিল্যান্ড দেখে বিদায়।
একই টেস্টে শতক ও ১০ উইকেট এমন বিরল কীর্তি ছিলো মাত্র দুজনের,ইয়ান বোথাম ও ইমরান খানের। সেই বিরল কীর্তিতেও গিয়ে ভাগ বসান এই ক্রিকেট রাজা।
সাকিবের বিয়ে ও গার্লফ্রেন্ড রিলেটেড একটি প্রশ্নে একদিন সাকিব বলেন," অসংখ্য বিয়ের অফার পেয়েছি। যা আমি গুণেও শেষ করতে পারবো না।" নভেম্বর ২০১১। তারপর তো ১২-১২-১২ এই স্পেশাল তারিখে বিয়ের পিড়িতে বসে তিনি এখন দায়িত্বশীল স্বামী ও পিতা। ছোটো মেয়ে আলাইনাকে নিয়ে স্বপ্নের অন্ত নেই এই পিতার।
সাকিব সম্পর্কে হাবিবুল বাশার-
সাকিবের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে সাকিব একই ভূল দ্বিতীয় বার করে না। সে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায় আর আগের করা ভালো পারফরম্যান্স এর ঘোর নিমিষেই কাটিয়ে উঠতে পারে।
সাকিব সম্পর্কে জ্যাক ক্যালিস-
সাকিব খেলোয়াড় হিসেবে যেমন অসাধারণ, মানুষ হিসেবেও ঠিক তেমনি অসাধারণ।
সাকিব সম্পর্কে মনোজ তিওয়ারি-
অবিশ্বাস্য খেলোয়াড়, অবিশ্বাস্য রেকর্ড এবং অবিশ্বাস্য একজন মানুষ। সাবাস সাকিব। নাম্বার ওয়ান স্তম্ভ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর অবদান অতুলনীয়। হ্যাটস অফ তাঁর প্রতি। ভবিষ্যতে সে যেন আরও রেকর্ড গড়তে পারে সেই কামনা করছি, যদিও ভারতের বিপক্ষে নয়। আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুণ বন্ধু।’
সাকিব সম্পর্কে ডেল স্টেইন(২০১৯ বিশ্বকাপের পর)-
সাকিব,তুমি অত্যাধিক ভালো।
সাকিব সম্পর্কে স্টিভ রোডস-
বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ওয়ানডে অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানটা ফিরে পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এরপরই বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে বাংলাদেশ দলের কোচ স্টিভ রোডস উচ্চসিত গলায় এ বিষয়টার প্রশংসা করেছিলেন। আশা প্রকাশ করেন, ‘সাকিব যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবার সেটা প্রমাণের সময় এসেছে।’ তারপর সেই বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স উপরেই দেওয়া আছে!
সাকিব সম্পর্কে ইংলিশ ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস খুব অবাক হয়েই বলেছিলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই সাকিবকে র্যাংকিংয়ের উপরে দেখে হতবাক হয়ে যান।’ কেন? এর কারণ কি তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে না পারা? অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অলরাউন্ডার হিসেবে অসংখ্য সব রেকর্ডের মালিক সাকিব।
হ্যাঁ, এই সাকিবই গেলো দশকের সেরা ক্রিকেটারে জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু তার আগে ক্রিকেটে তার সবচাইতে কালো অধ্যায়টি পূরণ হয়ে যায়। ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন সাকিব। যদিও সাকিবের অপরাধ কি বা কতটুকু তা দেখেছে পুরো বিশ্বই। ফিক্সিংয়ের জন্য অফার পেয়েও ফিরিয়ে দেন সাকিব। আর সেটি কোন এক কারণে বলেননি আইসিসিকে। যার দরুণ সাকিবকে ঘটনার দুই বছর পর একবছরের জন্য ব্যান করে দেওয়ায়।
ক্রিকেট এখন সাকিব বিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। দলের উত্থান পতনের সরব সাক্ষী সাকিবকে ছাড়া দল কল্পনাও করা যায় না। সাকিব বিহীন বাংলাদেশ দলকে সাজানোটাও হয়ে যায় দূরুহ ব্যাপার। এক্সট্রা বোলার, নাকি এক্সট্রা ব্যাটসম্যান? কাকে রাখবেন নির্বাচকরা সেটা নিয়েই পড়ে থাকেন দ্বিধায়।
আজ এই নবাবের ৩৩ বছর পূর্ণ হয়ে গেলো। দেশের ক্রিকেটে যেভাবে সার্ভিস দিয়ে আসছেন সেটি পূর্ণ করে দেওয়ার এখনো একটু বাকি৷ পুরো ১৬ কোটি মানুষ চেয়ে আছে সাকিবের ফিরার দিনের দিকে।ব্যান খাওয়ার পর অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন সাকিব অবসরে চলে যাবেন। তবে তিনি সরে যান নি। সাকিবের হাত ধরে ২০২৩ বিশ্বকাপে মাঠ মাতাবে বাংলাদেশ, এই স্বপ্নেই বিভোর কোটি জনতা।
কখন নামবে সাকিব? কখন হবে সেই অবিশ্বাস্য কামব্যাক? কখন হবে সাকিব সাকিব বলে উল্লাস? যেই সাকিব উল্লাসের উপলক্ষ করে দিয়েছেন বার বার,যেই সাকিবকে ভালোবেসে লক্ষ তরুণরা আসক্ত হয়ে গেছেন ক্রিকেটে,সেই সাকিবকে আমরা ফিরত চাই। আমরা নাম্বার ওয়ানকে আবারো তার রাজ্যে ফিরে আসতে দেখতে চাই- আমরা ব্যাকুল।
শুভ জন্মদিন জীবন্ত কিংবদন্তি।