05/09/2023
'আমাদের আরো একটা ব্যামো আছে। আমরা যখন পর্দার কথা বলি, পর্দা সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা করি, তখন আমাদের মানসপটে জ্বলজ্বল করে একটা বোরকা পরা নারীমূর্তির ছবি ভেসে উঠে। আমরা, পুরুষেরা ধরেই নিয়েছি যে, পর্দাটা কেবল নারীদের জন্যই। পুরুষ মানুষের আবার পর্দা কি? দুঃখের ব্যাপার হলো, পর্দা বলতে আমরা কেবল বোরকা-হিজাবকেই বুঝতে শিখেছি, ভাবতে শিখেছি। দৃষ্টিরও যে পর্দা আছে, শ্রবণেরও যে পর্দা থাকে, তা কি আমরা কখনো জানতে চেয়েছি?
কুরআনে সুরা আন-নুরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পর্দার বিধান নাযিল করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, সুরা আন-নুরের পর্দা সংক্রান্ত প্রথম আয়াতটাই পুরুষদের উদ্দেশ্য করে বলা, এবং ওই আয়াতে প্রধানত পুরুষদেরকে দৃষ্টির এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করতেই বলা হয়েছে। কুরআন যখন পর্দার বিধান নাযিল করেছে, সবার আগে, শুরুতে পুরুষদেরকেই উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে। কিন্তু অতীব দুঃখের ব্যাপার হলো এই, আজকের সময়ে আমরা পর্দা বলতে যা কিছু বুঝি, সবকিছু একচেটিয়াভাবে নারীদের ওপরেই চাপিয়ে দিই।
পর্দাটা নারী এবং পুরুষ, দু’জনের জন্যেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা ফরয করেছেন। একজন নারী যেমন নিজেকে বোরকা আর হিজাবে আবৃত করবে, নিজের রূপ-লাবণ্যকে পর-পুরুষের দৃষ্টি থেকে বাঁচাবে, ঠিক একইভাবে একজন পুরুষও এমন পোশাক পরবেনা, যা তার শরীরের গড়ন-গাড়নকে প্রকাশ করে দেয়।
ঢিলেঢালা পোশাকই সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী। আজকাল আমরা দেখি, অনেক মুসলিম পুরুষেরা এমন ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট পরেন যা তাদের শরীরের গড়নকে মেলে ধরে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ফ্যাশান কিংবা যুগের চাহিদা যা-ই বলা হোক না কেনো, এই ধরণের পোশাক নিজেকে এবং বিপরীত লিঙ্গের অন্য কাউকে যেকোন মুহূর্তে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। পর্দার আবশ্যিকতা-ই হলো এই কারণে যে, পর্দা আপনার দেহকে প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বাঁচাবে। কিন্তু, আমরা যারা ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট পরি, যা শরীরের সাথে একেবারে লেপ্টে থাকে, তা আদতে কতোখানি আমাদের প্রদর্শনেচ্ছা থেকে বাঁচায় সেটা অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ।
আমি বলতে চাইছি যে না যে ছিপছিপে শার্ট-প্যান্ট শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েজ কিংবা এই ধরণের পোশাক একেবারে পরাই যাবেনা। আসলে, আমি এখানে যা বোঝাতে চাই তা মোটাদাগে এই— সুন্নাহ সম্মত পোশাকের অর্থই হলো তা আমাদের শরীরকে এমনভাবে ঢেকে রাখবে, যাতে কোনোভাবে আমাদের শরীরের গঠন, গড়ন সেভাবে প্রকাশ পাবেনা। আমাদের পোশাকের চেহারা যদি হিন্দী কিংবা তামিল সিনেমার নায়কদের মতো হয়, তাহলে সেই পোশাক নিয়ে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ আছে বৈকি!
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, এ ধরণের পোশাক পরলে কি কেউ গুনাহগার হবে? প্রশ্নটার উত্তর অন্যভাবে দেওয়া যাক। গুনাহগার হবে কি না, সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে, উত্তম কিংবা অধিকতর উত্তমের কথা যদি আমরা চিন্তা করি, তাহলে হয়তো-বা এই ধরণের ছিপছিপে, গায়ে লেপ্টে থাকা পোশাক পরিধান না করাই উচিত।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, যুহদের স্তর হচ্ছে তিনটা। মানে, আল্লাহকে ভয় করে, কিংবা আল্লাহকে ভালোবেসে একজন মানুষ তিনভাবে জীবনযাপন করে থাকে।
প্রথম স্তরের মানুষেরা কেবল যাবতীয় হারাম থেকে বেঁচে থাকে।
দ্বিতীয় স্তরের মানুষেরা হারাম থেকে তো বাঁচেই, হালালের মধ্যে যা অতিরিক্ত, তা থেকেও বিরত রাখে নিজেদের।
তৃতীয় এবং সর্বোচ্চ স্তরের মানুষেরা হালালের মধ্যেও এমন সব জিনিস এড়িয়ে চলে যা সাধারণত আল্লাহর ভাবনা থেকে গাফেল করে দেয়।
এখন, যদি ধরেও নিই যে ছিপছিপে পোশাক পরিধানে কোন অসুবিধে নেই, এটা জায়েজ, তবুও এটা তো নিশ্চিত যে, এই পোশাকের চেয়ে ঢিলেঢালা পোশাক-ই সুন্নাহর অধিক নিকটে। সুতরাং, যে ব্যক্তি আল্লাহর অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠতে চায়, কিংবা আল্লাহকে বেশিই ভালোবাসতে চায়, তার কি উচিত নয় যে, এমন হালালের দিকে ঝুঁকে পড়া, যা অন্য একটা হালালের চাইতে অধিক উত্তম?
সাধারণত, বর্তমান আধুনিক জামানায় যে স্টাইলিশ হিজাব কতিপয় নারীকূল পরে থাকেন, তা অবশ্যই সর্বসম্মতিক্রমে অপছন্দনীয়। কিন্তু, আমরা যারা স্টাইলিশ হিজাব অপছন্দ করি, তারা যখন স্টাইলিশ শার্ট-প্যান্ট পরে, স্টাইলিশ হিজাবের বিরুদ্ধে বলতে যাবো, তখন কি আমাদের উচিত নয় আগে অন্তত একবার নিজের দিকে তাকানো?
আলোচনার সারবস্তু হলো, পুরুষেরও পর্দা আছে। পুরুষেরাও শালীন পোশাক পরিধান করবে এবং দৃষ্টির হেফাযত করবে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, পর্দার আয়াতে যেখানে আগে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলা হয়েছে, সেখানে আমরা পর্দার যাবতীয় হুকুম যেন নারীকূলের ওপরে উঠিয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাই।'