19/05/2025
চাৱিযুগ
চারি যুগের মহামন্ত্র।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি-এই চারিযুগের কল্পনা করা হইয়াছে। মূলত: সত্য হইতে, ত্রেতা ত্রেতা হইতে দ্বাপর এবং দ্বাপর হইতে কলিযুগের মধ্যে কোন প্রাচীর দ্বারা একটি হইতে অপরটিকে ভাগ করা নাই। সূর্য গগনে উদিত হইলে দিবস সূচিত হয় এবং অস্ত গেলে রাত্রির আগমন ঘটে। এইরূপে অনাদিকাল হইতে সূর্যের
দ্বারা দিন-রাত্রি সম্পন্ন হইতেছে। সূর্য গগনে উদিত না হইলে দিন-রাত্রি কিছুই থাকিত না কিন্তু একটি অনন্ত বা অখণ্ড কাল প্রবহমান- রূপে অবস্থান করিত। এই অখণ্ড কাল সময়) সত্য হইতে কলিকাল পর্যন্ত একই ভাবে প্রবাহিত হইতেছে।
সত্যযুগে অগ্নির যেরূপ উত্তাপ ছিল, জলের যেরূপ শীতলতা ছিল,কলিযুগেও সেইরূপই আছে। সত্যযুগে চিনি যেরূপ মিষ্ট স্বাদযুক্ত ছিল, জীবের মধ্যে যেমন দয়া-মায়া-প্রেম ছিল কলিযুগেও সেইরূপই আছে। কলিযুগের দরুন কোন বস্তুরই কিছুমাত্র অবস্থার পরিবর্তন হয় নাই। তবে চঞ্চল প্রতির নিয়মানুসারে সকল বস্তুরই হ্রাস-বৃদ্ধি আছে। ব্যষ্টি প্রকৃতিতে (প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে ) মানুষের দেহ মনের যেরূপ পরিবর্তন হয়, সেইরূপ সমষ্টিগত মানবের মধ্যেও পরিবর্তন আসে। আমরা যাহাকে সত্যযুগ বলি, সেই সময়ে অধিক। সংখ্যক মানবের মন সত্ত্ব গুণান্বিত ছিল। কিন্তু সেই সময়ে যে রজঃ ও তমােগুণান্বিত লােকের সংখ্যা একেবারেই ছিল না তাহা নহে— সেই । সময়েও দেখা যায়, দুবৃত্তগণ মহিষাসুর, শম্ভ-নিশম্ভুরূপে তাহাদের কামবৃত্তি পূরণের জন্য দেবী চণ্ডীকে হিমালয় হইতে তুলিয়া নিজেদের । আলয়ে লইয়া যাইবার জন্য বহু যুদ্ধবিগ্রহ করিয়াছে। দেবগণ ও অসুরগণের মধ্যে বহু যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। তাহাতে অসুরের সংখ্যাও
কম ছিল না। বহুবার দেবগণ অসুরদের নিকট পরাজিত হইয়া স্বর্ণ রাজ্য হইতে ভ্রষ্ট হইয়া গিরিগহ্বরে আশ্রয় নিয়াছিলেন।
ত্রেতাযুগে সত্যযুগ অপেক্ষা মানবের মন আরও নিম্নদিকে গমন করে। সে-যুগেও রামের সীতাহরণকে অবলম্বন করিয়া রাবণ ও তাহার অনুগতদের সহিত যুদ্ধ-বিগ্রহ বড় কম হয় নাই এবং সেই সব যুদ্ধে বহু রাক্ষস যােগদান করিয়াছিল। রাক্ষসদের অগণিত সংখ্যার নিকট রামসনের লাঞ্ছনাও কম হয় নাই। দ্বাপরে ত্রেতা অপেক্ষা সত্যের মান আরও ক্ষীন হইয়া আসে। এই সময়ে আসুরিক শক্তি ত্রেতা অপেক্ষা আরও বৃদ্ধি পায়। অত্যাচারী রাজা কংশ, শ্রীকৃষ্ণের পুতনা রাক্ষসী, অঘাসুর, বকাসুর বধ, কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ প্রভৃতি
বহু আসুরিক শক্তি নিধনের কাহিনীতে দ্বাপরযুগ ভারাক্রান্ত।
বর্তমানের কলিযুগ সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট সময়। এই সময়ে সত্য যুগের বিপরীত অবস্থা ধারণ করিয়াছে । সৎ লােকের সংখ্যা এই যুগে বিরল হইলেও একেবারে নাই বলা চলে না। আচার্য শংকর, স্বামী বিবেকানন্দ, সোহহং স্বামী, রামকৃষ্ণ পরমহংস, চৈতন্যদেব প্রভৃতি বহু মনীষিই কলিযুগের লােক। কলি বলিয়া যদি কোন যুগ থাকিত এবং ঐযুগের প্রভাব যদি সকলের উপরই কিয়া করিত, তবে এই সকল মনযিরাও কখনও সৎ হইতে পারিতেন না, কলির প্রভাবে ইহারাও অসৎ হইয়া যাইতেন। কলি বলিয়া যদি কোন যুগ থাকিত।তবে তার প্রভাব পৃথিবীর সকল দেশের উপরেই পড়িত। এই যুগেও ভারত ছাড়া অন্যান্য অনেক দেশই ধনে, মানে, বিদ্যায়, চরিত্রতায়,আচার-ব্যবহারে শ্রেষ্ঠ। প্রশ্ন জাগে, ভারতের বুকে আজ যে আমরা দেখিতে পাই দিকে দিকে প্রবঞ্চনা, রাহাজানি, মিথ্যাচার, ব্যভিচার ইত্যাদি অভিশাপগুলি -ইহারা কোথা হইতে এবং কেন আসিল ?
পৃথিবীর মধ্যে যে ভারত ধর্মবিষয়ে একদিন শ্ৰেষ্ঠস্থান অধিকার। করিয়াছিল আজ তাহার এই অবনতি কোথা হইতে আসিল ?
উত্তর –ধর্মহীনতাই ভারতের এই অবনতির কারণ। আজ ভারত তাহার আপন ধর্ম, ঋষিদের ঘােষিত ধর্ম –“ভগবান এক ও অখণ্ড”—এই সত্যধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়া পৌত্তলিক ধর্মকে আশ্রয় করিয়াছে ; সে কতক গুলি অপধর্মকে আশ্রয় করিয়া তাহার সনাতন ধর্মকে বনবাস দিয়াছে। ধর্ম হইতে অর্থ, কাম ও মােক্ষ লাভ হয়। ধর্মহীন মানুষের চরিত্র নষ্ট হয় এবং চরিত্র নষ্ট হইলে সবই নষ্ট হইয়া যায়। এ দেশের বর্তমান অপ-ধর্মনীতিই কলিযুগের স্রষ্টা। ভারত আবার যেদিন তাহার স্বীয় ধর্ম, বেদের ধর্মকে আশ্রয় করিবে সেইদিন
হইতে সত্যযুগের পুনরভূদয় আরম্ভ হইবে, কলিযুগের অবসান হইবে । গীতা বলেন, “স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য তাতে মহতো ভয়াৎ” ২।৪০ - আত্ম ধর্মের অনুশীলন অতি সামান্য মাত্রায় হইলেও ইহা মানবগণকে মহাভয় হইতে ত্রাণ করে।
ব্রহ্মের যেই নামের দ্বারা মন ত্রাণ পায়, তাহাকে তারক ব্রহ্মনাম বলে। প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মের কোন নাম নাই – তিনি অনামী। ব্রহ্ম বলিয়া সসীম কোন দেবতা বা ব্যক্তি নাই -- অসীম, অনন্তব্যাপ্ত সভাস্বরূপের নাম ব্ৰহ্ম। মন তাঁহার অবস্থা প্রাপ্ত হইলেই তাঁহার (ভগবানের) নাম করা হয় এবং তদ্বারাই সে মুক্ত হয়। সসীমবাচক কোন শব্দের অর্থাৎ যেসব শব্দ দ্বারা সীমাবিশিষ্ট কোন দেবতা, ব্যক্তি বা বস্তুকে বুঝায়, সেই সব শকের নিজস্ব কোন শক্তি নাই। যাহার নিজের শক্তি নাই সে অপরকে ত্রাণ করিবে কিরূপে? বৈষ্ণবগণ বলেন –সত্য,
ত্রেতা, দ্বাপর, কলি, এই চারি যুগে চারি প্রকার তারকব্রহ্ম নাম প্রবর্তিত হইয়াছে।
প্রশ্ন জাগে, এইসব নামের প্রবর্তন কে করিয়াছিল ?
গীতা, উপনিষৎ, বেদ প্রভৃতি মূল শাস্ত্রগ্রন্থে ভগবান কি কোথাও। বলিয়াছিলেন যে, তাহার চারিযুগে চারি প্রকার নাম হইবে ।। ভগবানের বাণী এইসব নামের প্রচারকগণ কিরূপে জানিলেন? বিভিন্ন যুগের তারক ব্রহ্ম নাম নিয়ে দেওয়া হইল :
সত্যযুগের তারকব্রহ্ম নাম—
নারায়ণ পরাবেদা, নারায়ণ রাক্ষরাঃ।
নারায়ণ পরামুক্তি, নারায়ণ পরাগতিঃ ।
ত্রেতাযুগের তারকব্রহ্ম নাম--
রাম নারায়ণ অনন্ত মুকল মধুসূদন ।
কৃষ্ণ কেশব কংশারে হরে বৈকুণ্ঠ বামন ॥
দ্বাপরযুগের তারকব্রহ্ম নাম-
হরে মুরারে মধুকৈটভারে, গােপাল গােবিন্দ মুকুন্দশৌরে
যজ্ঞেশ নারায়ণ কৃষ্ণবিষ্ণুঃ নিরাশ্রয়ং মাং জগদীশ রক্ষঃ
কলিযুগের তারকব্রহ্ম নাম-
(১) হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।
(২) জপ হরে কৃষ্ণ, হরে রাম ।
ভজ নিতাই গৌর, রাধেশ্যাম ॥
(৩) ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ, জপ গৌরাঙ্গের নাম রে ।
যে জন গৌরাঙ্গ ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে ॥
(৪) জয় রাধে রাধে, গােবিন্দ জয় জয়।
(৫) বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রাণ গৌরাঙ্গ।
ভগবান যদি একজনই হইয়া থাকেন, এবং কোন যুগেই তাহার । কোন পরিবর্তন না হয়, তিনি “অজ: নিত্যঃ শাশ্বতহয় পুরাণে -
( গীতা -২।২০ ) -ভগবান জন্মরহিত, সর্বদা এক ভাবে থাকেন,তিনি অবিনাশী ও সৃষ্টির আদিপুরুষ ; তিনি অযোনি সম্ভব –
জীবের মত মাতৃযোনিদ্বার দিয়া তিনি নির্গত হন না—তিনি প্রকৃতির বশে আসেন না। তিনি যদি এই রূপই হইয়া থাকেন, তবে বৈষ্ণবগণ কিরূপে জানিলেন যে, যুগে যুগে তঁাহার রূপের ও নামের পরিবতন হয় ? বেদ, উপনিষং ও গীতার কোথাও কি ভগবানের ভিন্ন ভিন্ন রূপে জন্ম গ্রহণের উল্লেখ আছে ? সুতরাং এই সব নাম যে সাম্প্রদায়িক নাম, কোন সম্প্রদায়ের প্রচারের জন্য করা হইয়াছে। নিম্নের কয়েকটি নামের উল্লেখের দ্বারাই তাহা স্পষ্টতর হইবে ।
(ক) ত্রেতাযুগের তারকব্রহ্ম নামে বলা হইয়াছে “কৃষ্ণ কেশব কংশারে” (যিনি কংশের অবি, কংশকে যিনি নিধন করিয়াছিলেন)। ত্রেতাযুগে তো কংশের জন্মই হয় নাই। কংশ দ্বাপর যুগের লোক। সুতরাং ত্রেতা যুগের লোক কি ভাবে জানিয়াছিলেন যে, ভগবান কংশকে হত্যা করিয়াছিলেন ?
(খ) দ্বাপরযুগের তারকব্রহ্ম নামে বলা হইয়াছে, মধুকৈটভারে’ যিনি . মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের অরি। মধু-কৈটভ তাে আর দ্বাপরযুগে নিধন হয় নাই ? উহা সত্যযুগের কাহিনী। সুতরাং সত্যযুগের পূর্ণ নামটিকে বাদ দিয়া ত্রেতাযুগ পার হইয়া দ্বাপরযুগে
আসিয়া পৃথক একটি নামকে তারকব্রহ্ম নাম বলিবার কি হেতু ছিল ? কলিযুগেই বা এতগুলি তারকব্রহ্মনাম হইবার কারণ কি ? এই যুগে কি একটি তারকব্রহ্ম নামের কাহাকেও মুক্ত করিবার ক্ষমতা ছিল না। বর্তমানে আরও একটি তারকব্রহ্মনাম প্রচার শুরু
হইয়াছে -“রাম নারায়ণ রাম”। ইহ। নাকি পূর্বের সমস্ত নাম হইতে শ্রেষ্ঠ ? ইহা স্বয়ং শিবের মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়াছে। এই টি মনে হয়, পুরাতন মদ নূতন বােতলে ভর্তি করিয়া বিক্রয় হইতেছে (Old wine in new bottle) এই শব্দগুলি বিচার করিলে চারিয়ুগের জন্য যে বিভিন্ন নাম প্রচারিত হইয়াছে, উহারা তারকব্রহ্ম নাম কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ, জাগে। এইসব নাম যদি তারকব্রহ্ম নামই হইত, তবে ইহাদের উচ্চারণের দ্বারা মানুষ মুক্ত হইতে পারিতেছে না কেন ?
শুধু নাম করিলেই যদি মুক্ত। হওয়া যাইত, তবে ইন্দ্রিয়-সংযমের কোন প্রয়ােজন হইত না ; মিথ্যাবাদিতা, প্রবঞ্চনা, ব্যভিচার, চুরি প্রভৃতি অসৎ আচরণগুলি
দুর করিয়া মনকে শুদ্ধ করারও কোন প্রয়ােজন হইত না। ফলত: এইসব নামের ভেক ধরিয়া অপরের নিকটে সাধু সাজিয়া নিজেকে ধার্মিক ৰলিয়া লােক সমাজে প্রচার করিয়া মানুষ অধিকতর পাপকর্মের সুযােগ গ্রহণ করে। তাই ইহার কেহই তারকব্রহ্ম নাম নহে। এক মাত্র সূক্ষ্ম অনাহত নাদই তারকব্রহ্ম নামের যােগ্য। ওঁকার সূক্ষ্মনাদেরই মূল রূপ ।