01/04/2024
শুনতে আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি পোড়ানোর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরই। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে এক সময়ের আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর-১ আসনে।
ঈগল মার্কার স্বতন্ত্র এমপিপ্রার্থী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক (৮৫ হাজার) ভোট পাওয়ার পর এ আসনে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর মামলার খড়গ নেমে এসেছে। যে ঘটনায় মামলা দেওয়া হয়েছে আদতে তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
কিন্তু এরপরও ভুয়া অভিযোগ এনে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে ফরিদপুর-১ আসনের আলফাডাঙ্গা ২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের, যা নিয়ে রীতিমতো বিব্রত জেলা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।
অভিযোগ আছে, ঈগলের স্বতন্ত্রপ্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করায় এসব মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে খোদ আওয়ামী লীগ নেতাদের। আলফাডাঙ্গা উপজেলার ২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৮ জনকে এমনই এক মিথ্যা মামলায় আসামি বানিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সব অভিযোগ দিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলে মত দিয়েছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, যে অভিযোগ দিয়ে মামলা করা হয়েছে তা মিথ্যা। তদন্ত করে এসব অভিযোগের সত্যতা তারা পাননি।
মার্চ মাসের ৩ তারিখে আলফাডাঙ্গা উপজেলার ২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মোনায়েম খান ও সাধারণ সম্পাদক মো. ফুয়াদ খানসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুর ও পোড়ানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। ২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান ইকু এই মামলা করেন।
মামলার এজাহারে ইকু উল্লেখ করে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া বিবাদীদের সহিত আমার (বাদী) বিরোধ সৃষ্টি হয়।...উক্ত বিরোধের কারণে বিবাদীরা আমাকে মারধরসহ খুন জখমের পাঁয়তারা করিতে থাকে এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।’
এজাহারে মিথ্যা অভিযোগ এনে আরও বলা হয়, ‘১নং বিবাদী মো. মোনায়েম খানের হুকুমে অন্যান্য বিবাদীরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান, নৌকা প্রতীক এবং স্থানীয় নেতাকর্মীর ছবি সম্বলিত টানানো ডিজিটাল ব্যানার বোর্ড ভাঙচুর করে পায়ের নিচে ফেলে অবমাননা করেন। পরে যাওয়ার সময় আগুন ধরিয়ে দিয়ে ভস্মীভূত করেন।'
ঘটনার পর স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে অভিযোগ দায়ের করেন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন ইকু।
তবে মামলার অভিযোগের বিষয়টিকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক বলছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহ মো. ইশতিয়াক আরিফ বলেন, ‘ফরিদপুর অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি আগুনে পোড়ানো হয়েছে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এমন ঘটনা ঘটলে আমরা জানতাম। যারা এসব বলছে মিথ্যা বলছে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি পোড়ানো হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হতো, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশনে নিউজ হতো, কিন্তু তা আমাদের চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যারা এসব বলছে বা করছে এগুলো মিথ্যা, গুজব, অপপ্রচার।’
শাহ্ মো. ইশতিয়াক আরিফ বলেন, আলফাডাঙ্গা উপজেলার ২নং গোপালপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার ও গুজব রটিয়ে যদি কোনো হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয় এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এস এম আকরাম হোসেন বলেন, আলফাডাঙ্গা উপজেলার ২নং গোপালপুর ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি আগুন দিয়ে পোড়ানোর কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু একটি সাইনবোর্ড টানানো ছিল। সেটি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা নামিয়েছেন। তদন্ত করে আমরা এটাই পেয়েছি। আমার জানা মতে প্রশাসন যে তদন্ত করছে তারাও এটা পেয়েছে।
আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম সুজা বলেন, উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এবং বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি আগুনে পুড়িয়েছেন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিন্তু একটা ব্যানার দোকানের সামনে টানানো ছিল, সেটা স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা নামিয়েছেন। সাইনবোর্ড নামানোর বিষয়টি আমরা শুনেছি। স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে আসছিল। কিন্তু আমরা বলেছি রমজানের পরে বিষয়টি সমাধান করার জন্য বসব। এ বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যানার বা পোস্টার আগুনে পোড়ানো হয়নি। প্রতিহিংসাবশত এ মামলা দেওয়া হয়েছে।
'যেহেতু ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নতুন কোনো কমিটি ঘোষণা করেনি, সে ক্ষেত্রে নিজেকে নতুন কমিটির আহ্বায়ক দাবি করাও দলের জন্য বিব্রতকর'- যোগ করেন তিনি।
২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. মোনায়েম খান বলেন, গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি আছে। সেই কমিটি থাকতে আরেকজন নিজেকে নতুন করে আহ্বায়ক দাবি করে, এটা দলকে বিব্রত করা ছাড়া আর কিছুই না। এ বিষয়টি আমরা থানা আওয়ামী লীগকে জানিয়েছি। তারা বলছে, যে নিজেকে আহ্বায়ক দাবি করছে এবং সাইনবোর্ড লাগিয়েছে এটা ভুয়া। তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে আমরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও থানা আওয়ামী লীগের অনুমতি নিই যে মনিরুজ্জামান ইকু নিজেকে আহ্বায়ক দাবি করে যেই সাইনবোর্ড দিয়েছেন সেটা তাকে নামাতে বলব। কিন্তু তার বাসায় গিয়ে না পেয়ে আমরা সাইনবোর্ডটি নামিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে রেখে দিয়েছি। কোনো ছবি পোড়ানো বা সাইনবোর্ড পোড়ানো হয়নি। ছবি পোড়ানোর কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
২নং গোপালপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মামলার বাদী মো. মনিরুজ্জামান ইকুর কাছে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা করেছি, আসামিরা জামিনে আছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন তদন্ত করে ছবি পোড়ানোর সত্যতা পায়নি। তাহলে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কেন মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছেন- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মোবাইলে এসব কথা বলতে পারব না। এরপর তিনি ফোন কেটে দেন। একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর ধরেননি।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আলফাডাঙ্গা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর আলী ভূঁইয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি পোড়ানোর বিষয় নিয়ে একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত করে কোথাও পাইনি যে ছবি পোড়ানো হয়েছে। যে সাইনবোর্ডটি নামানো হয়েছে সেটি আমরা জব্দ করেছি। আমাদের কাছে আছে, রেখে দিয়েছি।
দু-এক দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করবেন বলেও জানান তিনি।
ভুয়া অভিযোগে মামলার বিষয়টি উঠে এসেছে আলফাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (অফিসার ইনচার্জ) সেলিম রেজার কথাতেও। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি আগুনে পোড়ানোর অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত করে কোথাও কোনো ছবি পোড়ানোর সত্যতা পাইনি। চার্জশিট দাখিল করেছি। আমার জানা মতে আসামিরা জামিনে আছেন।
মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানির বিষয়ে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেন, যারা আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত পরীক্ষিত নেতা, তারা কখনো একজন অপরজনের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে পারে না। এ ধরনের কাজ যারা করবে প্রমাণ পেলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের মূল ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের নেতাকর্মী। তাই কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে, সেটা আমরা প্রয়োজনে মনিটরিং করব। প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগতভাবে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারো নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মামলা করলে সেটা টিকবে না।
শুনতে আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি পোড়ানোর...