14/12/2023
আমেরিকায় বদরুজ্জামান আলমগীরের গ্রন্থ উদযাপন এবং কিছু কথা । রাজিয়া নাজমী
Excellence is never an accident. It is always the result of high intention, sincere effort and intelligent ex*****on - বলেছিলেন দার্শনিক অ্যারিস্টটল।
ডিসেম্বরের ২ তারিখে কুইন্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে উদযাপিত একটি অনুষ্ঠানের বেলায় এ কথাটি ভীষণভাবে প্রযোজ্য।
আমাদের পরিশ্রম সার্থক হয় তখনই যদি কাজের পিছনে সদিচ্ছা থাকে। অভিজ্ঞতা ছাড়াও high intention, sincere effort এর জন্যই দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে।
সাধারণত কোন অনুষ্ঠান শেষ হলে ফেইসবুকে ছবি বের হয়, লেখা প্রকাশ হয়। সরাসরি মেসেজ আসে,ফোন আসে। তেমনিই হয়েছে কদিন আগে নিউ ইয়র্কের কুইন্স লাইব্রেরীর একটি অনুষ্ঠান নিয়ে।
এই নিয়ে আমার লেখার কথা ছিলো না। তবে কখনো আমাদের অনেক কাজের পিছনে একটা গল্প থাকে যা বলতে ভাল লাগে। বা বলাটা জরুরি হয়ে পড়ে।
শূন্য থেকে শুরু হয়ে শতভাগ পূর্ণ হবার দিন,ক্ষণ অতীত নামে এক পর্দার আড়ালে থেকে যায়। যদিও পূর্ণতা পাবার পিছে এই না দেখা না জানা অতীত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কিভাবে এমন একটি অনুষ্ঠানের শুরু হল তা বলতে গেলে যে নামটি ছাড়া শুরু করা যায় না সে সেলিনা শারমিন - কুইন্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর প্রোগ্রামিং এবং আউটরিচ সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান।
আমার সাথে ওঁর পরিচয় কবে কখন হয়েছিল সে অন্য এক গল্প। সংক্ষেপে বলা যায় আমার সাথে পরিচয়ের সূত্র ছিলো আমার লেখা এবং আমার বই নিয়ে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত। ২০২১ সালের কথা। সেবেলায় সেলিনা পুরো আয়োজন করেছিলেন। নির্ভর করেছিলেন সাপ্তাহিক বাঙ্গালীর সম্পাদক কৌশিক আহমেদ এর সঞ্চালনার উপরে।
ভাল কিছু করার নেশায় যার সকাল হয় সেই সেলিনার সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগলো না। সেলিনা চাইল আমি লাইব্রেরীর একটি প্রোগ্রামে (স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে) ওর সাথে কাজ করি।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালী নারী লেখক হিসাবে আমার ‘অথার টক’ দিয়ে প্রথম এবং শেষ হবে তা হতে পারে না। আরও করতে হবে। তবে প্যান্ডামিকের নির্দয়তা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্যান্ডামিকের ভয়াবহতা শেষ না হতেই ২০২২ সালে সেলিনা চলে গেলো কানেক্টিকাট স্টেটের লাইব্রেরীতে। প্রায় এক বছর পরে ফিরে এলো আবার কুইন্স সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে। এই এক বছর বাঙালীদের কোন অনুষ্ঠান সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে হয়নি।
ফিরে আসার আগেই সেলিনা আমাকে বললো, আমি ফিরে আসছি। গেট রেডি। যা প্লান করেছিলাম তা শুরু করবো। সেলিনা নতুন দায়িত্বে আসার কিছুদিন পরেই বাংলা প্রোগ্রাম শুরু করার কথা জানালো।
আমার নিজের বই শেষ করার ব্যস্ততা, অফিসের ব্যস্ততা, ভাল মন্দ অনেক কিছুর জন্য রেডি হতে আমিই সময় নিলাম কয়েক মাস। শেষমেশ সেপ্টেম্বর মাসে সেলিনা’কে জানলাম কী প্রোগ্রাম এবং কাকে নিয়ে ভাবছি।
'বদরুজ্জামান আলমগীর' নাম বলতেই একটু অবাক হয়ে বলে, এই লেখকের নাম শুনি নাই তবে নিশ্চয় তেমন কেউ হবে নয়তো আমি কেন প্রস্তাব করবো। সেলিনার এটা স্বভাব না আমার উপরে ওর অগাধ বিশ্বাস, জানি না। আমি কিছু বললে সিদ্ধান্ত জানাতে সময় নেয় না। ওর একটা সংক্ষিপ্ত জবাব - Done!
Done - কিন্তু ভাল কাজে বাধা না এলে তা সম্পূর্ণ হয় কী করে বিশেষ করে আমার বেলায়। জীবন ভর বাধা ডিঙিয়ে কাজ করতে করতে সহজে কোন কাজ যদি হয়েও যায় তা নিয়ে আমার সন্দেহ থাকে।
তাই বাধা একবার না বহুবার নানাভাবে এসেছে, যে বাধা আসার কথা ছিলো না তাও এসেছে। আমি তাই জানতাম অনুষ্ঠান ভালোভাবেই শেষ হবে।
একটি সহজ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এতসব ঝামেলার জন্য বোধহয় অনুষ্ঠান 'উতরে গেছে' নয় - নিন্দুকেরাও বলবে - যথেষ্ট উঁচু মানের একটি অনুষ্ঠান হয়েছে। ত্রুটিহীন বা পিকচার পারফেক্ট না হলেও প্রায় পিকচার পারফেক্ট হয়েছে।
অনুষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা প্রথম পেয়েছি সেলিনা শারমিন এর কাছ থেকে। এরপর একে একে প্রায় সকল শ্রোতা দর্শক বলেছে এমন অনুষ্ঠান সহসা হয় না।
আলোচনা অনুষ্ঠান ক্লান্তিকর হয়ে পড়ে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান এমনভাবে সাজিয়েছিলাম যে সেই অবস্থায় যায়নি।
প্রথম পর্বেই ছিলো লেখক বদরুজ্জামান আলমগীর লেখা থেকে পাঠ, নাটকের অংশ বিশেষের প্রদর্শনী, তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা যা উপস্থিত সকলকে মানসিকভাবে তৈরি করে দিয়েছিলো আলমগীরের কথা শোনার জন্য। এবং দ্বিতীয় পর্বে কৌশিক আহমেদ এর সাথে আলাপচারিতায় তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছে সবাই। সংক্ষেপে কিছু কথাও অনেক বলার চেয়ে বেশি বলা হয়, আলাপচারিতায় তা সেদিন প্রমাণ করে দিয়েছে লালন নূর ।
পিনপতন নীরবতায় কী করে সময় চলে গেলো টের পাওয়া গেলো না বলেছে বদরুজ্জামান আলমগীর এর লেখক বন্ধুরা। আবৃত্তি শিল্পীদের কাছেও অনুষ্ঠান ভালো লেগেছ।
ভাল লেগেছে আলমগীরের প্রিয় বন্ধু রাহমান টিটো'র এমন একটি অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নেবার জন্য।
লালন নূর, ৯ ঘণ্টা ড্রাইভ করে এসেছে - সেই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
সাংবাদিক ইব্রাহিম চৌধুরী বলেছেন, নিউইয়র্কে বহুদিন পর ভালো মানের একটি আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম।
সাংবাদিক শামিম আল আমিন, বললেন, এতটা সুন্দর হবে জানলে আমি রেকর্ড করার ব্যবস্থা করতাম (TBN24 থেকে)
কুলদা রায়, যিনি অপ্রিয় সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেন না। যিনি কাউকে খুশি করতে কথা বলেন না। তিনি শুধু অনুষ্ঠানের দিনেই নয়, কদিন পরে ফোনেও আবার বললেন,এমন একটা অনুষ্ঠান কী করে করলেন- একজন লেখক সম্পর্কে আপনার ভূমিকায় যা বলেছেন তা অডিয়েন্সকে হিপনোটাইজ করে দিয়েছে যে এরপরে অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ না করে থাকা সম্ভব হয়নি। একজন লেখক এবং তাঁর সৃষ্টিকে এভাবে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়- এই অসাধ্য কাজটা এত সহজ করে করেছেন। আমি নিউ ইয়র্কে এমন অনুষ্ঠান কম দেখি । একটা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসে আমার মনে হল আমার সময়টা কাজে লেগেছে।
আমি এবং বদরুজ্জামান আলমগীর দুজনেই তাঁর পরিচিত। নেহাৎ আসতে হবে বলেই এসেছিলেন। তবে ফিরে গেছেন ভাল সময় কাটিয়ে।
লেখক বদরুজ্জামান আলমগীর তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন - তাঁর ধারণা ছিল তিনি এত পরিচ্ছন্ন, নিটোল,উন্নত মাপের অনুষ্ঠান করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি বিস্মিত, অভিভূত হয়েছেন দেখে যে এত উন্নত মাপের অনুষ্ঠান করা আমার পক্ষেও সম্ভব।
বলেই ধারণা করেছিলেন। সেই তিনি বলেছেন, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন আমার সূচনা বক্তব্যে। তিনি প্রশংসা করেছেন সেলিনা শারমিন কর্মদক্ষতার।
ভাল লেগেছে -আবৃত্তি শিল্পীদের তাঁর লেখার পাঠ। তাঁর নাটক থেকে পাঠ, প্রদর্শনী। অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর অতীত দেখেছেন, বর্তমান দেখেছেন।
তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে গিয়েছেন তার ধারণার বাইরে ভালোলাগা নিয়ে। যথাযথ মর্যাদা পেয়ে।
কৌশিক আহমেদ, অবাক হন নাই। সেলিনার আন্তরিক সহযোগিতা এবং আমার নিষ্ঠার উপরে তাঁর বিশ্বাস ছিলো এবং তা মিথ্যে হবে না।
আর আমি বরাবরই বিশ্বাস করি - আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিৎ অনুষ্ঠানকে সফল করা। একটু একটু করে এই অনুষ্ঠানের জন্য সব কাজের উদ্দেশ্য একটাই ছিল - যাকে নিয়ে, যার কাজ নিয়ে এই অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ নিয়েছি - সেটাই যেন তুলে ধরতে পারি।
তবে এও সত্য শতভাগ সফলতার দাবী আমি করবো না কারণ তা সম্ভব হয়নি। তা যে কারণেই হোক। সেই অতৃপ্তি নিয়ে আমি বাড়ি ফিরেছি।
শতভাগ সফল করতে না পারার দায়ভার আমার। যতটুকু সফল হয়েছে তার কৃতিত্ব সেদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত যারা ছিলেন তাঁদের সবার।এই অনুষ্ঠান সফল হতো না যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের ছাড়া। সফল হতো না শ্রোতা দর্শক ছাড়া।
সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের শিরোনাম 'বদরুজ্জামান আলমগির - বৃক্ষ একটি মনোহর' এর বদরুজ্জামান আলমগীর উপস্থিত শ্রোতা দর্শকের প্রায় সকলের পরিচিত। বইটির সম্পাদক লালন নুর কবি হিসাবেও আমাদের কাছে পরিচিত।
‘ বদরুজ্জামান আলমগীর - বৃক্ষ একটি মনোহর’ - এই বইটির লেখক বদরুজ্জামান আলমগীর নন। এই বইটি লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে। যারা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন কবি সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্রকার, সংগীত শিল্পী, সাংবাদিক। আছেন শিক্ষক যারা তাঁর চিন্তা ভাবনার সাথে পরিচিত। লিখেছেন সেই সব লেখক যারা তাকে তাঁর জন্মিটার থেকে চেনেন, যারা এক সময় একই রাজনীতির মাঠে ' চল পাল্টাই' এর অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।
আমাদের অনুষ্ঠান এই বইটির প্রকাশনা উৎসব ছিলো না । তাহলে আমাকে অর্ধ শত লেখকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান করা উচিৎ ছিলো।
তাহলে কেন এই নামে এই অনুষ্ঠান? এর পুরো ব্যাখ্যা আমি সেদিন দেইনি। কারণ অনুষ্ঠানটির শেষে উপস্থিত সকলেই উপলব্ধি করবেন বলে আমার বিশ্বাস ছিলো।
তবে এই বইয়ের নামকরণ দেখে আমি চমকে উঠেছি - আমরা কম বেশি সকলেই জানি বিখ্যাত বাউল কবি জালাল উদ্দীন খাঁ এর একটি গান - কূল নাই দরিয়ার পারে - বৃক্ষ একটি মনোহর। অর্থাৎ দুঃখের মাঝে সুন্দর কিছু পাওয়া - বৃক্ষ একটি মনোহর ।
সম্পাদক বইটির এই নামকরণ কেন করেছেন তা তোলা ছিলো আলাপচারিতা পর্বে উঠে আসার জন্য।
তবে আমি আমার সূচনা বক্তব্যেই প্রশ্ন রেখে গিয়েছিলাম বদরুজ্জামান আলমগীরের কাছে - এই নাম তাঁর কাছে কতটা অর্থবহ মনে হয়েছে এবং কেন?
বৃক্ষের নামকরণ হয় বৃক্ষ আমাদের জন্য পাতা, ফুল, ফল, কী জন্ম দিচ্ছে তার উপরে।
এই বইটির নামকরণের মুল কারণ না জানলেও মোটাদাগে যা আমি দেখেছি তা হলো - এই বইটির মলাটের ভিতরে একজন লেখকের কবিতা, অনুবাদ, প্রবন্ধ, নাটক, নাট্য নির্দেশনা এবং তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। অর্থাৎ এর ভিতরে আছে বদরুজ্জামান আলমগীরের চিন্তা ভাবনার কথা। তাঁর কাজ এবং নানা প্রতিকূলতার পরে তাঁর কাজের সফলতার কথা লিখেছেন বাংলাদেশে, উত্তর অ্যামেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে।
সবার লেখার ভিত্তিতে - আলমগিরের একটি কোন বই নিয়ে নয় - সমগ্র নিয়েই সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিলো।
সাধারণত একজন ব্যক্তির, এবং তার কাজের মূল্যায়ন করা হয় তিনি এই বিশ্ব থেকে চলে যাবার পরে।
বদরুজ্জামান আলমগীরের এর সৌভাগ্য যতটা তারচেয়ে বেশি সৌভাগ্য আমাদের যে তাঁর উপস্থিতিতে আমরা তা কাজের মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছি।
নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীরের চাইতে কবি হিসাবে আমি তাকে বেশি জানি।
তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর, ‘নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো, দূরত্বের সুফিয়ানা, মরিয়ম ফুল দুনিয়া, এবং যে গ্রাম দর্জিকে খলিফা বলে ডাকে।
তিনি লেখেন গদ্যের আদলে পদ্য - poem about everything.
রাজনীতি, মানব প্রেম সুফিবাদ- নিরন্তর প্রেম, ব্যক্তি প্রেম - তবে তার কবিতার ধরণ অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং এর মত। প্রেম, ভালোবাসা আছে তবে উপরে ভাসছে না। অনেক গভীরে।
তাঁর কবিতা সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা যদি বলি তাহলে বলবো, তিনি যখন ভিন ভাষাভাষীর কবিতা বাংলায় তুলে আনেন, তখন অনুবাদ নয়, করেন ভাষান্তর। এক্সরে আর জেরক্স কপির মধ্যে যে তফাৎ আছে। অনুবাদ আর ভাষান্তরের মধ্যেৎ তফাৎ ও তাই। আলমগীর এক্সরে করেন। তাই তাঁর অনুবাদ ঠিক অনুবাদ মনে হয় না। মনে হয় মুল কবির বাংলায় লেখা।
তাঁর কোন কোন মৌলিক কবিতা সম্পূর্ণ আলাদা, বিন্যাসে, ভাবে, গভীরতায়।
গভীর দুঃখবোধ ছেয়ে থাকে তাঁর কবিতায়। যেন নির্জন সমুদ্রের মাঝে একটি দ্বীপ – যেখানে জীবন শূন্যতায় ,একাকীত্বে বাস করে - তবু সেই দ্বীপের মাটি পাথরে আছে ঈহা, আছে স্বপ্ন, অসাধারণ সেই সব কবিতা সেই নির্জনতার মত ছুঁয়ে যায় ! আমাকে নিয়ে যায় শৈশবে কীর্তনখোলায় - বাবার হাত, মায়ের আঁচল ধরে ঢেই দেখি। নিয়ে যায় বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারে - চোখ মেলে দেখি হাডসনের কুল। আমি বুঝি কীর্তনখোলা বুড়িগঙ্গা আমার অতীত - আমার বর্তমান হাডসনের তীরে।
আমি নস্টালজিয়ার চির-অসুখে ভোগা একজন। আসলে আমার মনে হয় আমি যেন বাংলাদেশ আর অ্যামেরিকার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আসাও হলো না যাওয়াও হলো না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হবার জন্য একধরনের গ্লানি নীরবে বাস করে মনের ভিতর। দেশ ছাড়ার কষ্ট পুষে রাখি আড়ালে। আবার এই দেশ ছেড়ে যেতে পারব না বলেই এই দেশকে ভালবাসি তা নয়, অনেকদিন কোথায় বাস করলে সেই মাটির জন্য যে একটা টান পড়ে যায়। মায়া জন্ম নেয় এদেশের অধিবাসীদের প্রতি। আলমগীরের লেখা পড়লে মনে তিনিও এর ব্যতিক্রম নন। জন্মভূমির কষ্ট হতাশার মধ্যে তিনি বাস করেন। তিনিও হতাশা চেপে রেখে থিতু হয়েছেন মার্ক্সের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা এই দেশে। যেমন বলেছি আগে, কোথায় বাস করলে সেই মাটির জন্য মায়া জন্মে যায়। আলমগীরের এদেশের মাটি মানুষের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠেছে হয়তো নিজের অজান্তেই। দ্বৈত ভালবাসার দোটানার ভিতর দেখি আলমগীরের কবিতায় অ্যামেরিকা, এদেশের জনগণ -অবলীলায় জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সেই সব লেখার মধ্যেও ভাগাভাগি করে মিসে আছে নিজের রুট। তিনি ফিরে ফিরে যান বাঙলার মাটিতে –ঢাকা, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের গ্রামে - তুলে আনেন মাটি কাঁদা, মানুষের ঘাম ঝরা আর্তনাদ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা – প্রেম। নিজ গ্রামের মাটি, নদী, জনপদের কথা তুলে আনতে ভালবাসেন বাজিতপুরের আঞ্চলিক ভাষায় । এমনকি অনুবাদিত কবিতায় তিনি তাঁর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে ভালোবাসেন -
দ্বৈত ভালবাসায় লেখা তাঁর ইংরেজি কবিতার বইয়ের নাম রেখেছেন - Dhaka stars on Philly sky-
তিনি মার্ক্সের দেখানো পথে এখনও মনে মনে হাঁটেন, কলমে চলে আসে সেই পদচিহ্নের রেখা। আলমগীর প্রবাসী জীবনে বসে তাঁর আত্মজৈবনিক লেখায় লিখেছেন - বালিশ পরিষ্কার করে ঘুমাতে যাই, ঘুম থেকে উঠে বালিশ সরাতে গিয়ে দেখি বালিশের নিচে - লাল রেক্সিনে মোড়ানো চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ্গের বই!
মার্ক্সবাদ-যারা ভীষণভাবে ধারণ করেন তাঁদের চিন্তাভাবনা টিকিয়ে রাখার জন্য যে যুদ্ধ অ-মার্ক্সবাদ দেশে এসে করতে হয়, তিনিও তা করছেন। প্রতিনিয়ত মোকাবেলার রক্তক্ষরণের যন্ত্রণাকে নিয়ে তিনিও যে চলছেন তা তাঁর কবিতায় সেই ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়-
তবে একজন বিপ্লবী দেশলাইর কাঠি দিয়ে যে কবিতা লেখেন, যেভাবে শব্দ, বাক্য পুড়িয়ে আনেন আগুনের শিখায়; তাঁর কবিতায় দহন ধপ করে জ্বলে ওঠে না।
আগেই বলেছি তাঁর কবিতার ধরণ ভিন্ন। দহনও ডিপ ইনসাইড -
নিজের সৃষ্টির প্রতি সন্দেহ নেই তাঁর। তা নাটক বা কবিতা যাই হোক। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা তিনি তাঁর মতে করেই বলেন এবং বিশ্বাস করেন পাঠকের গ্রহণ ক্ষমতার উপর।
তাঁর রচিত হৃদপেয়ারার সুবাস বইয়ের কথা ছাড়া কোন আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না। আমার কথা অসস্পুর্ন থেকে যাবে।
হৃদপেয়ারার সুবাস -এটি প্যারাবল গ্রন্থ। প্যারাবল বলতে আমরা যা বুঝি তা হল মানবসমাজের জন্য উপদেশমূলক পাঠ। এবং এই শিক্ষামূলক পাঠ উপমার ধরণে ধর্মীয় গ্রন্থে দেখা যায়। কবি সাহিত্যিকরা এই ধরণকে অনুসরণ করে তাঁদের নিজস্ব গদ্য বা পদ্যে এর শৈলী ব্যবহার করে, সংক্ষিপ্ত, উপদেশমূলক নীতিগুলিকে চিত্রিত করেন। এবং তাঁদের এই ধারার লেখায়, প্যারাবল ধীরে ধীরে শিল্প সাহিত্যের একটি অংশ হয়ে ওঠে। প্যারাবল বা উপমা রচনায় তাঁরা ফেবল বা কল্পকাহিনী থেকে আলাদা রেখেছেন। হৃদপেয়ারার সুবাস গ্রন্থটি সেই অর্থে একটি খাটি প্যারাবল গ্রন্থ- যেখানে আছে শুধু মানব চরিত্র। এবং প্রতিটি প্যারাবল এক ধরনের ( metaphorical) রূপক উপমা।
আমার জানামতে বদরুজ্জামান আলমগীর সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্যারাবল রচয়িতা।
আলমগিরের লেখার সাথে পরিচয়ের পরে মনে হয়েছে এমন লেখাই তাঁর লেখার কথা। তাঁর চিন্তা ভাবনাকে এখানে খুঁজে পাওয়া সহজ।
তাঁর ভাবনা জগতে তিনি অন্ধকার দেখেছেন, আলো দেখেছেন – ভেবেছেন জীবনের সার কথা কী!
অবিনশ্বর প্রেমের সুবাস ছড়ানো গদ্যে-পদ্যে লেখা হৃদপেয়ারার সুবাস বদরুজ্জামান আলমগীর বৃক্ষ একটি মনোহর বইটিতে অনেকের লেখায় চলে এসেছে। তাঁরা যেন সাঁতার দিতে গিয়ে ডুব সাঁতারই দিয়েছেন। সেখান থেকে উঠে আসতে সময় লেগেছে।
আমার অনুভূতি - হৃদপেয়ারার সুবাসে যেতে যেতে বহুদূর যাওয়া হয় - বহুক্ষণ থাকা যায়।
একজন স্বর্ণগর্ভা মায়ের তৃতীয় সন্তান বদরুজ্জামান আলমগীর, একজন কবি এবং নাট্যকার। সেই পরিচয়ে নিয়ে তিনি অ্যামেরিকার সংবিধান রচিত হয়েছে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের যে শহরটিতে সেই ফিলাডেলফিয়া বসবাস করছেন প্রায় দুই যুগ ধরে।
লিখে যাচ্ছেন তাঁর পাঠকের প্রত্যাশাকে বুকে ধারণ করে। পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যাক তাঁর লেখায়। সেই কামনা করছি।
তাঁর একটি প্রাপ্তির কথা বলেই সেদিনের অনুষ্ঠানের কথা শেষ হোক। ইশরাত নিশাত নাট্য পুরস্কার ‘২০২২’ বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো অনুষ্ঠিত হলো। এবং শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসাবে বদরুজ্জামান আলমগীর পুরস্কার পেলেন।
রাজিয়া নাজমী : রাজিয়া নাজমী গল্পকার, সেইসাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নির্মোহ ভাষ্যকার তিনি। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও অভিজ্ঞানে প্রাত্যহিক ধারণ করেন এক ভুবন বাঙলাদেশ। তিনি গল্পে বয়ান করেন সময়ের নৈর্ব্যক্তিক বোঝাপড়া, বুননে থাকে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের পলিমাটি, আর এক নির্দয় মায়া। রাজিয়া নাজমী ঘড়ি ধরে ধরে শব্দ গুণে লেখেন না- লেখেন এক অনিবার্য জেরা ও জন্মদানের রোখে।
রাজিয়া নাজমী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। যুক্তিগ্রাহ্য, আইনসঙ্গত একটি সমাজ দেখার প্রত্যয়ে আইনশাস্ত্রে স্নাতক করে বার কাউন্সিলের সনদ নিয়েছিলেন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তিবিদ হিসাবে কাজ করেছেন।বর্তমানে কাজ করছেন নিয়ইয়র্কের একটি আইন সংস্থার সাথে।
লেখালেখির পাশাপাশি নোলক নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত। তিনি নিউইয়র্ক কেয়ার, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক, এবং বাপা'র সদস্য হিসাবে কাজ করেন। নিউইয়র্কের ফ্রেন্ডস অব কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরির হলিস শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট-এর দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রকাশিত বইঃ চৌকাঠের বাইরে, জলাগুন।