07/05/2024
Central Park
Md Rashed Khan
Kajal Arefin Ome
Imran Khan
প্রিয় লেখিকা আপনার লিখাটা পোস্ট করলাম... 💚
ভার্সিটির হোস্টেলে উঠার দুই সপ্তাহ পর আমার রুমে আসে রায়হান।
তখন ভোর ছয়টা৷ দুই তিন টা ব্যাগ নিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম সিনিয়ররা ডাকছে। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতে গিয়ে লুঙ্গি প্রায় খুলেই যাচ্ছিলো।
রায়হানের কাঁধে দুইটা আর হাতে দুইটা ব্যাগ।
মেয়েরা এত ব্যাগ নিয়ে আসে জানতাম। ছোট থেকেই মামার বাসায় বড় হওয়ার বিভিন্ন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। অনেক রুমমেট পেয়েছি। কিন্তু এত ব্যাগ পত্তর নিয়ে হোস্টেলে আসতে এই প্রথম রায়হান কে দেখলাম।তাও সব নিজের কাপড় চোপড়।
আমি তাকিয়ে আছি দেখে, চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তাকিয়ে আছিস কেন? আগে নিজের লুঙ্গি ধর তারপর আমার ব্যাগ ধর।
আর রুমে নাস্তা পানি কিছু আছে? নইলে চল হোটেলে গিয়ে নাস্তা করে একটা ঘুম দিবো।
হাতের ব্যাগ গুলো আমার হাতে দিয়ে কাঁধের ব্যাগ গুলো ওর জন্য রাখা অন্য বেডের উপর ফেলল।
ব্যাগ রেখে বসতে না বসতে ওর ফোন এলো। খাটে বসা অবস্থায় ফোন ধরে ধপাস করে বেডে পড়ে গেল। আর বলল,
- হ্যাঁ আম্মু, আমি পৌঁছেছি। এইবার চিন্তা করিও না। সারারাত ঘুমাও নি। জেগে ছিলে আমার সাথে। এইবার ঘুমাও। আমিও ঘুমাব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাস্তা করেই ঘুমাব। টেনশন করিও না।
রুমমেট? হ্যাঁ আছে আছে৷ ভালো হবে না কেন? অবশ্যই হবে, নইলে ভালো করে ফেলব। তুমি চিনো না তোমার ছেলে কে?
রাখো। ঘুমাও কিছুক্ষন।
আমি হাসি দিলাম। হোস্টেলে এলে প্রথম প্রথম সবাই মাম্মাস বয় থাকে। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে এরা মাকে ফোন দিতেই ভুলে যায়৷
কিন্তু রায়হানের ব্যাপারে এই ধারণা টা আমার ভুল ছিলো।
রায়হান সারাদিন ক্লাস শেষে আড্ডা দিয়ে নয় টা থেকে দশটা অবধি একঘন্টা ওর মায়ের সাথে কথা বলতো৷
হে হে করে হাসতো, ওর ঘরের টপের কথা,বিড়ালের কথাও জিজ্ঞেস করতো। সারাদিন কুল হয়ে চলা, রাজনীতির আলোচনা, বির্তক কিংবা গানের আসর জমিয়ে রাখা যে ছেলেকে আমি বাইরে দেখতাম রুমে ঢুকার পর যখন সে তার মায়ের সাথে কথা বলত এই ছেলের সাথে আমি মেলাতে পারতাম না।
শুধু আমি নয় অনেক ছেলেই ওর এই ব্যাপার টা দেখতো।
আমাদের তিন টা শার্ট, দুইটা গেঞ্জি আর দুইটা জিন্স দিয়ে পুরো বছর চলে যায়। এই গুলো দিয়ে ক্লাস, অনুষ্ঠান , প্রাইভেট সব চলতো৷
কিন্তু রায়হানের সব গুলোর জন্য আলাদা আলাদা শার্ট, গেঞ্জি ছিলো।
একটা কাপড় ও সে ধুতো না। এক মাস পরে সব ব্যাগে ভরে বাড়িতে নিয়ে যেত।
আবার এক ব্যাগ ভর্তি ধোয়া, আয়রণ করা শার্ট প্যান্ট নিয়ে আসতো।
আর আসতো একটা সুটকেস। লালচে মেরুন রঙের মাঝারি সাইজের একটা সুইটকেস।
ওটাতে কোন কাপড় চোপড় থাকতো না। থাকতো নানা রকমের খাবারের জিনিস।
বিভিন্ন রকমের শুকনা পিঠা, নানা রকমের আচারের বয়াম, বিস্কিট, বাদাম, চকলেট, ড্রাই ফ্রুটস আরো কত কি। মাছ ভাজা, ভুনা করা মাংস।
আমি প্রথম দিন দেখে বলেছিলাম,
-এইটা কি?
রায়হান একগাল হেসে বলেছিলো,
- আম্মুর সুটকেস।
রায়হানের এই আম্মুর সুটকেস আমার কাছে ছিলো গুপ্তধনের মতো, ছাপোষা মামার বাড়িতে বড় হওয়ায়, মা কোন দিন ভালোমন্দ দিতে পারে নি। হোস্টলে হোস্টলে বড় হয়েছি , ভালো খাবার আর নাস্তা বলতে টিউশনিতে মাঝেমধ্যে যা পেতাম তাই দুনিয়ায় সেরা খাবারের একটা মনে হতো।
রায়হান একা কিছু খেতো না। আমাকে দিতো। আর বলত যখন খিদে লাগবে খেয়ে নিবি।
তালা থাকত না শুধু চেইন টানা থাকতো। প্রথম প্রথম সংকোচ হলেও পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।
রায়হানের আম্মু সুটকেস টা আমার আর ওর বেডের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় থাকতো। এইটা আমাদের আলনা হিসেবেও ব্যবহার হতো।
মাসের শেষের দিকে সুটকেস খালি হতো৷ রায়হান মাসের শেষ বৃস্পতিবার বাড়িতে যেত। যত কাজ, ক্লাস অনুষ্ঠান থাকুক না কেন ওকে যেতে হতো। ওর পুরো মাসের ময়লা কাপড় আর ওর আম্মুর সুটকেস টা নিয়ে বাড়ি ছুটতো।
এত বড় বড় ব্যগ নিয়ে সে কীভাবে যেত কীভাবে আসতো আমি জানতাম না।
একবার ভার্সিটির সিনিয়রদের ফেয়ারওয়েল ছিলো। সবাই নাচে গানে ব্যস্ত।
সে রাতের এগারোটায় ব্যাগ আর সুটকেস টা নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে কই যাস?দরকার হলে কাল চলে যাবি।
ভীষণ ব্যস্ত ভাবে বলে,
-আম্মুকে জানানো হয় নি যাবো না এইটা। কল ও যাচ্ছে না। সারারাত বসে থাকবে আমার জন্য। আমি ভোরে পৌঁছে যাব।
সে চলে গিয়েছিল। সেদিন রাতে আমার ঘুম হয় নি৷ শুধু মনে হচ্ছিলো রায়হান অনেক ভাগ্যবান। মায়েরা সন্তান দের তো ভালোবাসে আমরা এইটা স্বাভাবিক ভাবে নিই। কিন্তু সন্তানরেরা মাকে এইভাবে ফিরতি ভালোবাসতে পারে এইটা ভাগ্যের ব্যাপার।
কিছু ভাগ্যবান মানুষ ফিরতি ভালোবাসার ভাগ্য নিয়ে জম্মায়।
রায়হানের থেকে দেখে আমিও মাকে প্রায় ফোন দিতাম।
প্রথম প্রথম কথা খুঁজে পেতাম না কি বলব, আস্তে আস্তে বলতে বলতে মনে হলো মাকে অনেক কথায় বলা যায়।
শনিবার সকালে রায়হান ঠিক তার আয়রণ করা কাপড়ের ব্যাগ আর রায়হানের আম্মুর সুটকেস নিয়ে ফিরে আসে।
রায়হান বলে এইবার তোর জন্যেও আলাদা আলাদা সব দিয়েছে আম্মু।
খুলে দেখলাম যা যা দিয়েছে সব দুইটা করে পাঠিয়েছে।
আস্তে আস্তে তা নিয়ম হয়ে গেল। রায়হানের আম্মুকে আমি কখনো দেখি নি। আমার কাছে রায়হানের আম্মুর ভালোবাসা মানেই ছিলো রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা।
আমার অনেক খরচ বেঁচে যাচ্ছিলো, আর আজেবাজে খাবার না খাওয়াতে অসুস্থও কম হচ্ছিলাম।
একদিন দেখলাম রায়হান ওর আম্মুর সাথে অনেক ক্ষন ধরে বকবক করে টাকা চাইছে। ওর এক জোড়া জুতা পছন্দ হয়ে ছাব্বিশ টাকা। ওর সেটা লাগবে।
অনেক বুঝানোর পর ওর মা টাকাটা পাঠাতে রাজি হয়েছে।
রায়হান টিউশনি করে না। করলেও মাস দুই মাসের বেশি না।
যদিও করে তা দিয়ে ওর মায়ের জন্য কিছু নিয়ে যাবে আগে।
রায়হান ফোন রাখার পর আমি ওকে বললাম,
- জুতা কেনার জন্য না বলে বই বা ভার্সিটির ফি এর জন্য বললে তো এত কথা বলতে হতো না।
রায়হান ঘাড় বেঁকিয়ে অবাক হয়ে বলে,
- মিথ্যা বলতাম?
বাম হাতে মোবাইল ধরে ডান হাতে তুড়ি মেরে বলে,
- আমি মিথ্যা বললে, এইভাবে এইভাবে তুড়ি মেরে ধরে ফেলবে। আর আমি আম্মুকে কোন দিন মিথ্যা বলি নি। সত্য বললে যখন সব পাই মিথ্যা বলার দরকার কি?
কেমন যেন অবাকই হলাম, আমাদের ছাপোষা ঘরেও আমাকে যা চেয়েছি দিয়েছে তাও যখন অতিরিক্ত কোন টাকা লাগে তখন মিথ্যা বলে নিই।
রায়হানকে সারাদিন অন্য সব ছেলের সাথে আলাদা কোন অমিল পেতাম না আমি, ক্লাস, মিছিল, মিটিং, প্রেম করা, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। আড্ডা দেওয়া, ট্যুর দেওয়া। পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে পড়াশোনা করে কোন মতে পাশ করা। সব যেন একই অন্য সব ছেলের মতো।
শুধু ও যখন মায়ের সাথে কথা বলতো আমার তখন মনে হতো আমি আমার ক্লাস টু'য়ে পড়া আমার ছাত্র সাব্বির কে দেখি। সেও পড়তে বসলে তখন এইভাবে গল্প করে ওর মায়ের সাথে।
একদিন সবাই মিলে আমাদের রুমে পার্টি করছিলাম। আমরা দশ বারো জন। আড্ডা হচ্ছিলো, কার্ড খেলা হচ্ছিলো। গান হচ্ছিলো। রায়হান গিটারে সুর তুলে গান গাইছিলো।
ওর ফোন আসায় ও আসর ছেড়ে উঠে এলো। আমাদের কে ইশারায় চুপ হতে বলল,
তাও আওয়াজ হচ্ছিল।
-হ্যালো আম্মু! কে? আব্বু? তুমি? আম্মু -? কি হয়েছে?
ও শোনার চেষ্টা করছে। তখন চেঁচিয়ে উঠলো,
- থামবি তোরা?
-কি? আম্মুর কি হয়েছে? ব্যাথা পাইছে? এ্যাঁ? শুনতে পাচ্ছি না কি বলছো।
পুরো ঘর যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।।আমার বুক কেমন যেন ধুপ ধুপ করছিলো। না চাইতেও মনে কিছু আসছিলো। যেন খুদে কচুরিপানা সড়িয়ে দিলে আবার ফেরত আসছে। আমি তো রায়হানের কাছে ওর মা কী।
আমি তাড়াতাড়ি উঠে যাচ্ছিল। তার আগেই হাত থেকে মোবাইলে ধুম করে ফ্লোরে পড়ে গেল রায়হান।
সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠে এসে ঘিরে ধরলো রায়হান কে।
আমি মোবাইল কানে দিলাম,
ওপাশ থেকে কান্না জড়ানো স্বরে কে যেন বলছে,
- কাল যোহরের পর জানাজা,
বাকি কথা আমি শুনলাম না। সবাই রায়হান কে ডাকাডাকি করছে। মুখে পানি দিচ্ছে।
রায়হানের আম্মুকে আমি কখনো দেখি নি আমার কাছে রায়হানের আম্মু মানেই ছিলে মেরুন রঙের সেই সুটকেস টা। সুটকেস টা রায়হান যেখানে পড়ে আছে তার দুইহাত দূরে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অপলক তাকিয়ে আছি।
যত বার রায়হানের আম্মুর বানানো খাবার খেয়েছি ততবার মনে হতো উনি মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন।
সুটকেস টার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে শার্ট ভিজে যাচ্ছে আমার জানা নেই।
রায়হান কে সবাই ডাকছে কারণ আমরা সবাই ততদিনে যেনে গিয়েছি রায়হান কেমন মা পাগল ছেলে৷ আমরা ওকে মাম্মাস বয় ডাকতাম।
সেদিন রায়হান কে আমরা সবাই কীভাবে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা জানি না। রায়হানের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল আকাশা বাতাস পুরো ঘর।
রায়হান কখনো না বললেও আমার সব সময় মনে হতো রায়হান অনেক পয়সাওয়ালার ছেলে। ওর কাপড়চোপড় খাবার দাবার দেখে আমার মনে হতো বড়লোক বাপের আদরের ছেলে।
কিন্তু ওদের ঘরে গিয়ে দেখলাম তেমন না। আর পাঁচ টা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ওদের ঘর। চার ভাই তিন বোন। তার মধ্য রায়হান সবার ছোট ছিল। অন্য সব ভাই বোনের সাথে রায়হানের বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ পনের বছরের।
তাই হয়ত মায়ের এত কাছের ছিলো রায়হান।
যার কাছে মা আছে এমন যত্ন করার। সে তো সত্যিই অনেক বড়লোক।রায়হানের বাবা, ভাই বোন, ভাবী সবাই এক সাথেই থাকতো। কারো সাথে কোন খারাপ সর্ম্পক নেই। কিন্তু রায়হানের মুখে কারো নাম কোন দিন শুনি নি। শুধু ওর আম্মুর কথায় বলতো। আমি ভাবতাম মা বাবার আদরের একমাত্র ছেলে সে।
রায়হান কে রেখে এলাম আমরা। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে সেখানে। রায়হান কি করবে এখন?
রুমে ফিরে রায়হানের আম্মুর সুটকেসটার উপর চোখ পড়লেই কেঁপে কেঁপে উঠছি। মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছি।
দশ দিন পর রায়হান ফিরে এলো। উস্কখুস্ক চুল নিয়ে। মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে।
এসেই বিছানায় পড়ে রইলো এক সপ্তাহ, আমি টেনে তুলে খাওয়াতাম। কোন বেলা খেত, কোন বেলা মুখেই খুলতো না। আমিও ওকে ফেলে খুব একটা রুম থেকে বের হতাম না। কিন্তু পরের মাসেই ফাইনাল পরীক্ষা।আমাকে ক্লাসে কোচিং এ ছুটতে হচ্ছে।
এক বিকেলে রুমে ফিরে দেখি বেডে বসে আছে রায়হান।
খুব একটা কথা হয় নি। ওর হাতে খাতা কলম মোবাইল কোন কিছুই উঠে নি পনের দিন। বন্ধুরা এসে রুমে একটু দেখে গেসে। কেউ কথা বলার সাহস করে নি।
আমি ওর পাশে বসে বললাম,
-এইবারের পরীক্ষাটা ড্রপ করবি-
বাকি কথা আমি বলতে পারলাম না। তার আগেই মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলো রায়হান৷
-না। আমার পড়াশোনার জন্য মা আমাকে এইখানে পাঠিয়েছে। পড়াশোনার জন্য মাকে আমি শেষ মূহুর্তে একবার দেখতে পারি নি। এত কিছু করেছে মা।
পরীক্ষা আমি দিব।
বলতে বলতেই উঠে গেল সে। পরের দিন থেকে ঠিকঠাক হয়ে মোটামুটি আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক দেখতে মনে হলেও ওর সেই উচ্ছ্বাস টা আর নেই।
বেপোরোয়ো বেখেয়ালি আচরণ আর নেই। উড়ন্ত প্রজাপতি টা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল।
মাঝেমধ্যে মধ্য রাতে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেতাম। মশারির ভেতর থেকে দেখতাম। রায়হান ওর আম্মুর সুটকেস টার সামনে বসে আছে।
উঠে সান্ত্বনা দেওয়ার সাহস আমার হতো না। আমিও যে তাকিয়ে থাকি মাঝেমধ্যে আমার গুপ্তধন পাওয়া সেই সুটকেসের দিকে।
রায়হান আর মাসের শেষে ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে বাড়ি যায় না। সেটা ভর্তি হয়ে আর আসে না।
এক বিকেলে রায়হান আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বলে,
- শাওন, কাপড় কীভাবে ধোয়? পানি দিয়ে সবান দেয় যে? তারপর কি করতে হয়?
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। হোস্টেল লাইফ প্রায় শেষের পথে এই চার বছরে সে একবার ও কাপড় ধুয় নি আমার মনে হলো এখন। আর কেন সেটা মনে পড়তেই বুক ভারী হয়ে উঠে।
চারিপাশে তাকিয়ে সে বলে,
- সব ময়লা হয়ে আছে, কাল একটা কাজ ছিলো তাই শার্ট টা-
এত দিন সব আম্মু -
বাকি কথা শেষ করতে পারে না।
আমার একবার ও মনে হলো না আন্টি ওকে কিছু শেখায় নি। আমার কেন যেন মনে হলো আন্টি চায় নি ও কিছু শিখুক। আন্টি চাইতো ওর সব কাজে ওর থেকে ওর আম্মুকে লাগুক।
রায়হান কেমন যেন আস্তে আস্তে সব শিখে নিতে শুরু করলো। আমার ভালো লাগার কথা ছিলো কিন্তু আমার বুক ভারী হয়ে আসতো।
রায়হান আর বাড়িতে যেত না। কোন কিছু লাগলে কাউকে ফোন দিতো না।
আমাদের কাছে ধার চাইতো। ওর বাবা নিজ থেকে টাকা পাঠাতো। দিয়ে গেলে নিতো। কিন্তু খুঁজে নিতো না।
টিউশনি শুরু করে। আমারা পরীক্ষার পর হল ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়।
স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য সারাদিন দৌড়াতে থাকে রায়হান।
হয়েও যায় সব। রায়হান যেন দেশ ছেড়ে পালাতে চায়।
যে ছেলে হোস্টেলে এসেছিল চারটা ব্যাগ কাঁধে সে ছেলে দেশ ছেড়ে চলে গেল দুইটা শার্ট আর একটা প্যান্ট একটা ব্যাগে ভরে।
রায়হান যাওয়ার সময় অনেক বার ওর আম্মুর সুটকেস টায় হাত বুলায়। ওর কাছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে এই সুটকেস টা রয়ে গেল। প্রতিমাসে একবার এইটা টেনে টেনে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসতো। তার কাছে এই খালি সুটকেস এখন বিশাল মনে হচ্ছে। এত বড় সুটকেস নিয়ে সে কোথায় যাবে? তাই আমাকে বলল একটু রাখিস তোর কাছে যত দিন পারিস। অন্য কেউ পেলে কি করে, ছিড়ে টিরে ফেলবে।
আমি শক্ত করে ধরে বলি,
-সামলে রাখবো। আমিও যে গুপ্তধনে সন্ধান পেয়েছিলাম এইখানে।
যাওয়ার সময় শুধু আমি দিয়ে আসি রায়হান কে। আর কোন বন্ধু ওর হয়ে উঠে নি। ফ্যামিলির কাউকে আমি আর দেখি নি।
রায়হান যাওয়ার পর আমি একটা মেসে উঠি। তারপর একটা ছোটখাটো চাকরি ধরি৷ এক রুমে বাসা নিই।
বছর তিনেক পর মায়াকে বিয়ে করি।
আমাদের নতুন সংসার শুরু হয় নতুন বাসায়। তখনো আমাদের সংসারের এক কোণায় অথিতি হয়ে থাকতো রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা। মায়া জিজ্ঞেস করলে ওকে রায়হানের কথা বলেছিলাম। ওর মায়ের কথা। ওদের মা ছেলে সে ভালোবাসার কথা।
মায়াও কখনো কোন কাজে লাগায় নি সেটা। ওভাবেই পড়ে রইলো।
রায়হানের সাথে আমার যোগাযোগ এখনো আছে। আমার আর কোন বন্ধু হয় নি তেমন। রায়হান ওখানে বিয়ে করেছে ওর দুইটা মেয়ে। আমারো একটা ছেলে একটা মেয়ে।
ভালো চাকরি হয়েছে। ছোট বাসা ছেড়ে বড় বাসা এরপর নিজস্ব ফ্ল্যাট। সব জায়গায় আমি সাথে নিয়ে গেসি রায়হানের আম্মুর সুটকেস টাকে।
বারো বছর পার হয়ে গেল রায়হানের দেশের বাইরে যাওয়ার। এরপর এদেশ সেদেশ ঘুরে এখন সে কানাডায় সেটেল হয়েছে। আমাদের যেতে বলে। মায়া ও অনেক দিন ধরে বলছিলো। ঠিও করলাম এইবার কানাডায় যাবো।
রায়হানেই সব ঠিকঠাক করে দিলো। আমার তেমন কিছু করতে হলো না।
আমি শুধু করলাম একটা কাজ। রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা ভরলাম, যেভাবে আসতো আমার গুপ্তধন হয়ে ওটা।
নানা রকম খাবারে। আচারে। রায়হানের পছন্দের সব খাবারে৷যেসব খাবার রায়হানের মা পাঠাতো, যেসব ছোট মাছ, ইলিশ মাছ ভাজি করে দিতো আমি যেন সব নিয়ে নিলাম।
পুরো সময় সুটকেস টা আমি হাতে ধরে ছিলাম। যেন আমার কাছে রাখা গুপ্তধন আমি যক্ষ হয়ে এতোদিন রক্ষা করেছি এখন আমি তার দায়মুক্তি নিচ্ছি।
মেয়ে আমার বলেই উঠে এত ব্যাগ থাকতে আমরা এই পুরানো সুইটকেস টা কেন নিয়ে যাচ্ছি?
আমি চুপ করে থাকি।
কানাডায় পৌঁছার পর রায়হান আমাদের নিতে আসে তার ওর মেয়েরাও আসে।
আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয় সে।
এসে জড়িয়ে ধরে। ওর খুশিটা দেখে পড়ার মতো।
আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ওর চোখ পড়লো সুইটকেস টার উপর।
ও প্রথমে চুপ হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো, ওর মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।
তারপর একবার আমার দিকে তাকালো। আমি আলতো একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুক টা কেমন যে করছে তা বুঝাতে পারছি না।
ওর চোখ ভিজে উঠেছে। কিন্তু তাও সামলাচ্ছে নিজেকে।
আমি খুব যত্ন করে ওর হাতে সুইটকেস টা দিলাম।
ওর গলায় কান্না দলা পাকাচ্ছে। তারপর ও কোন মতে বলল, গাড়িতে উঠ।
ও সামনের সিটে বসে আছে। আমার ছেলে মেয়ে ওর মেয়ে, মায়া। সবাই হাসিতে মেতে উঠেছে। কিন্তু রায়হান চুপ। কোন শব্দ করছে না। আমি জানি এখন ওর বুকে কি গভীর থেকে জমানো ব্যাথা নলকূপের চাপের মতো বের হয়ে আসছে।
ওর ঘরে গিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করল।
মায়া ওদের জন্য নিয়ে যাওয়া জিনিস গুলো বের করে দিতে থাকে।
সব শেষ করে আমি রায়হান কে বললাম,
-সুইকেট টা খোল।
রায়হান ফ্লোরে বসল, আগে যেভাবে হোস্টেলে এসে বসে রায়হান খুলতো ওর মায়ের সুইটকেস টা। পাশে বসতাম আমিও। কি এলো নতুন?
রায়হান কাঁপা কাঁপা হাতে চেইন খুলল, খুলতেই দেখল সব আগের মতো সাজানো।
রায়হান আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। একবার আমার দিকে তাকালো তখন চোখ বেয়ে পড়তে শুরু করেছে, জমানো সব স্মৃতি গুলো৷ কাঁপা কাঁপা হাতে সব ছুঁয়ে দেখছে।
তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর স্ত্রী, মেয়েরা। আমার ছেলে মেয়ে সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
রায়হান হিচকি দিতে দিতে,
-"আম্মু"
বলে ঝাপিয়ে পড়ল, রায়হানের ওর মায়ের সুইটকেস টার উপর। যেটা ছিলো আমাদের গুপ্তধন।
হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোকে তো আমরা ফেরত পেতে পারি না। ওদের স্মৃতি মাখা জিনিস গুলোতে তাদের খুঁজে ফেরাকেই তো মায়া বলে।
সমাপ্ত
#রায়হানের_আম্মুর_সুইটকেসটা
দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
©