15/08/2022
একটা মেয়ের গল্প
বিয়ের ৮ বছর পরে ও যখন নিঃসন্তান ছিলাম তখন যেন বেঁচে থাকাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে পরেছিল। আশেপাশের কোন মহিলার ছেলে মেয়েদের কে আমার কাছে আসতে দিত না। কিন্তু আমার ছিল বাচ্চাদের প্রতি লোভ। বাচ্চা দেখলে আমার ভেতরের মাতৃত্ববোধ জেগে উঠত। বাচ্চাদের কোলে নিতে মন চাইতো,আদর করতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু সবাই আমার থেকে তাদের বাচ্চা লুকিয়ে রাখত। সবই আমার কপাল। যেইখানে আমার নিজের ননদ আমার কোল থেকে তার বাচ্চা কেড়ে নিয়ে যায়, সেইখানে পাড়া প্রতিবেশীদের আর কি বলব?
আজকে হঠাৎ করে সেই ৮ বছরের পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। কতো সুখের সংসার ছিল আমার। আমার স্বামী ছিল একজন শিক্ষক।ধন দৌলত , টাকা পয়সা , কোন কিছুর অভাব ছিল না।ছিল শুধু একটা বাচ্চার অভাব। আর একটা বাচ্চার অভাবে আমার সেই সুখের সংসার টা বিষে পরিনত হয়েছিল। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল আমাদের। আমার শ্বাশুড়ি আম্মা নিজে পছন্দ করে আমাকে তার বাড়ির বউ করে নিয়ে আসে।
প্রথম ৩_৪ বছর সব কিছু ঠিক ছিল। কিন্তু এর পর থেকে সবার মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল।
একদিন আমার কাকি শাশুড়ি আম্মাকে বললেন,বউমা কে কবিরাজ দেখাও, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর থেকে শুধু হলো হুজুর, কবিরাজ দেখানো, সাথে পানি পড়া,তেল পড়া,ঝাড় ফুঁক তাবিজ গলায় ঝোলানো । যদিও আমি এসব বিশ্বাস করতাম না কিন্তু আম্মার মুখের উপর কিছু বলার সাহস ছিল না আমার।
রাতে আমার বর জিজ্ঞেস করল,আয়াত তোমার গলায় এইটা কিসের তাবিজ ?
আম্মা কবিরাজের থেকে নিয়ে এসেছে বাচ্চা হওয়ার জন্য।
তুমি একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কিভাবে এসব বিশ্বাস কর? সন্তান দেওয়ার মালিক আল্লাহ। আল্লাহ যেদিন চাইবে সেদিন ঠিকই আমাদের ঘর আলো করে বাবু আসবে।
তবে আমাদের ও চেষ্টা করতে হবে। আমার কলিগের পরিচিত একজন গাইনী ডাক্তার আছে , আমরা কাল সকালে ইনশাআল্লাহ যাবো ওই ডাক্তারের কাছে।
ঠিক আছে।
প্রায় তিন বছর ডাক্তার দেখানোর পরে ও যখন কোন কাজ হয়েছিল না তখন এই সমাজ আমাকে অপয়া, অলক্ষী, বাজা তকমা লাগিয়ে দিয়েছিল। কারো বাচ্চা আমার কাছে আসতে দিত না। একদিন দুপুরে আমার ননদ তার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে গোসল করতে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে বাবুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।বাবু কান্না করতে থাকে। একপর্যায়ে বাবুর কান্না দেখে আমি কোলে তুলি। তখনই আমার ননদ ছুটে এসে বাবুকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে, ভাবি তোমাকে তো বলেছিলাম আমার মেয়েকে তুমি কোলে নিবে না ।
ননদের কথায় আপনা আপনি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়েছিল।আর বেশি কষ্ট লেগেছিল যখন দেখলাম আমার স্বামী সেইখানে উপস্থিত ছিলেন অথচ কোন প্রতিবাদ করে নি।
রুমে এসে আমার কাপড় চোপড় গোছানো দেখে উনি বললেন, কি ব্যাপার আয়াত কাপড় চোপড় গোছাচ্ছ কেন?
আমি থাকব না আর এই বাড়িতে, অনেক সহ্য করেছি আর নয়। আপনি বরং আমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কোন মেয়ে বিয়ে করে আপনার বংশের বাতি জ্বালান।
আচ্ছা আয়াত,আজ তোমার জায়গায় যদি আমার সমস্যা হতো তুমি কি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে?আর তুমি কি সূরা বাক্বারার ১৫৫ নং আয়াত পড় নি, সেই আয়াতে ছিল "এবং অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা,মাল ও জানের ক্ষতি ও ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করছেন।তাই আমাদের উচিত ধৈর্য ধারন করা। আবার সূরা ত্বলাকের ৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে "আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন।আল্লাহ চাইলে আবার আমরা সুখের দেখা পাবো।
এর কিছুদিন পর আমার ছোট ননদের বিয়ে ঠিক হয়। সকালে খাবার টেবিলে বসে সবাই বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিল।এক পর্যায়ে আম্মা আমার বর কে বললেন,দেখ রায়হান বাড়িতে একটা শুভ কাজ হতে যাচ্ছে, আমি চায় না তোর অপয়া বউ এই শুভ কাজে বাড়িতে উপস্থিত থাকুক। তুই এই অপয়াকে ওর বাপের বাড়ি দিয়ে আসবি।
আম্মা অনেক হয়েছে। আমি অনেক দিন যাবৎ এসব সহ্য করে আসছি। আমি আয়াত কে বিয়ে করে ওর সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়েছি, মাঝপথে এসে ওর হাত ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। আচ্ছা আম্মা আজ যদি সমস্যা টা আয়াতের না হয়ে আমার হতো তাহলে কি আমাকেও সেম ভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে?
তোমাদের যখন ওকে নিয়ে এতো সমস্যা তাহলে আমি সেই সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি। আয়াত এই বাড়ি থেকে চলে যাবে তবে ও একা যাবে না সাথে আমি ও যাবো।
আমি বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পারছি,এই মেয়ে তোকে কালো যাদু করছে।ও খুব ভালো করে জানত একবার ডিভোর্স হলে ওর মতো অপয়াকে আর কেউ বিয়ে করবে না ।তাই তো তোকে বশ করেছে যাতে এই অপয়াকে ছাড়তে না পারিস।
এতো কথা শোনার পর ও আমার বর তার কথা থেকে একটু ও সরে আসে নি। সেদিন আমার ৮ বছরের সংসার জীবনের ইতি টেনে শ্বশুর বাড়ি থেকে তার হাত ধরে চলে আসছিলাম একটুখানি সুখের আশায়।
কেটে যায় ৪ মাস। সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছিলাম। শহরে আমাদের জায়গায় কেনা ছিল।ওই জায়গায় একটা বিল্ডিং এর কাজ শুরু করি। আমাদের একটু টাকার সমস্যা ছিল যার কারনে ৪ মাস লেগে যায় বিল্ডিং কমপ্লিট হতে।৪ মাস পরে নিজেদের বাড়ি উঠি। এইখানে এসে সবই ভালো ভাবে চলছিল কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা সন্তানের হাহাকার সবসময় বিরাজ করত।
আয়াত, আমার মনে হয় আবার ও আমাদের চিকিৎসা শুরু করা উচিত বিচলিত কন্ঠে বললেন আমার বর।
কি হবে আর চিকিৎসা নিয়ে। কম তো আর ডাক্তার দেখালাম না, আল্লাহর কাছে তো কম চাইলাম না। কিন্তু কি লাভ হলো?
আয়াত আমাদের উচিত ধৈর্য ধারন করা। আল্লাহর কাছে আর ও বেশি করে চাওয়া।
এরপর আমরা আবার চিকিৎসা শুরু করি। চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা প্রতিনিয়ত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া শুরু করলাম, দোয়া কবুলের সময়গুলোতে দোয়া করতাম আল্লাহর কাছে একটা সন্তানের জন্য। আমি অবাক হতাম আমার বরের ধৈর্য দেখে। আমার দুঃখের সময় আমাকে সাপোর্ট করেছে, আমার পাশে থেকেছে। আর সবচেয়ে বেশি অবাক করা বিষয় হচ্ছে এর ৫ মাস পর আমি কনসিভ করি। সেদিন মনে হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত সুখ বোধহয় আমার কাছে চলে এসেছে। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তখনই আমার সূরা মারইয়ামের ৪ নং আয়াতের কথা মনে পড়ে গেল।সেই আয়াতে বলা হয়েছিল " হে আল্লাহ! আমি তো কখনো আপনাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি"।
আসলেই তো আমি ৯ মাস আগে একটুখানি সুখের আশায় আমার সংসার ছেড়ে আসছিলাম।আর আজ আল্লাহ আমাকে একটুখানি সুখের বদলে পাহাড় সমান সুখ দিয়েছে।
সমাপ্ত
#একটুখানি সুখ
#অপরাজিতা রহমান
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। আসলে প্রকৃত ভালোবাসা কখনোই ছেড়ে যায় না। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)